কক্সবাংলা ডটকম(২৬ ডিসেম্বর) :: বাঙালি মুসলমান সমাজে মাতৃভাষা, ব্যবহারিক ভাষা নিয়ে প্রশ্ন, দ্বিধা, সংশয় দীর্ঘদিন থেকে ছিল। শেষপর্যন্ত অবশ্য মধ্যযুগীয় মুসলমান কবিগণ তাঁদের সাহিত্যকর্মের মাধ্যম হিসেবে মাতৃভাষা বংলার গুরুত্ব অনুধাবন করেন, মেনেও নেন।
ইংরেজশাসিত ভারতের বঙ্গীয় মুসলমান বিশ শতকের প্রথমদিকে ধর্ম ও ধর্মীয় ভাষা নিয়ে রক্ষণশীলতার পরিচয় কম রাখেনি মুসলমান-পরিচালিত কিছুসংখ্যক পত্রপত্রিকায়। বিশ শতকের আধুনিকতা তাদের চেতনায় যুক্তিবাদী মুক্তচিন্তার আলো জ্বালেনি। মাতৃভাষা বাংলা নিয়ে বাঙালি মুসলমানের বড়সড় অংশের মনে ছোট-বড় নানা উপলক্ষে তৈরি বাধাগুলো ভেঙে ফেলে একুশে ফ্রেব্রুয়ারির (১৯৫২) ভাষা আন্দোলন।
এর প্রভাব পড়ে পাকিস্তানি আমলের পূর্ববঙ্গে সাহিত্য ও রাজনীতিচর্চার ক্ষেত্রে। সে প্রভাব বাহান্ন-উত্তর সময়ে ব্যাপক হলেও শিক্ষিত বাঙালি মুসলমানের শ্রেণীস্বার্থ যে এর ধারাবাহিকতা রক্ষার ক্ষেত্রে সুবিচার করেনি তার প্রমাণ ধরা রয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশে শাসকশ্রেণীর বাংলাভাষার প্রতি অযৌক্তিক উদাসীনতায়, বিশেষ করে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে, আদালতের রাজকার্যে। সেখানে ঔপনিবেশিক রাজভাষা ইংরেজির একাধিপত্য। বাংলা সেখানে ঘরছাড়া অবস্থায়।
কিন্তু যতদিন পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় রাজনৈতিক শক্তির বিরুদ্ধে বাংলাভাষা ও বাঙালির আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক অধিকার আদায়ের লড়াই চলেছে, ততদিন মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা শিক্ষিত বাঙালিমানসে ক্ষুণ্ন হয়নি। এক্ষেত্রে বাঙালি বলতে বাঙালি মুসলমানের কথাই বলা হচ্ছে। তখন বাংলাভাষা ও সাহিত্য-সংস্কৃতির চর্চা ছিল বাঙালির চেতনায় গৌরবের ও গর্বের বিষয়।
কিন্তু আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক শ্রেণীস্বার্থের এমনই শক্তি যে—নিরাপদ, অনুকূল পরিবেশে ক্ষমতার বাড়বাড়ন্ত তার পূর্ব-অঙ্গীকার অস্বীকার করতে বাধেনি। রাষ্ট্রভাষা বাংলা, সর্বস্তরে বাংলার ব্যবহার নিয়ে এমনই এক নিদারুণ স্ববিরোধিতার পরিচয় রেখেছে আমাদের শাসকশ্রেণী স্বাধীন বাংলাদেশে। তাই পুনরুক্তি সত্ত্বেও বলতে হচ্ছে ভাষিক জাতিরাষ্ট্র বাংলাদেশে বাঙালি শাসকশ্রেণীর কল্যাণে উচ্চশিক্ষা ও উচ্চ আদালতের ব্যবহারিক ভাষা বাংলা নয়, ঔপনিবেশিক রাজভাষা ইংরেজি।
এর ধারাবাহিকতা এতটাই যে যতই দিন যাচ্ছে সমাজের বিভিন্ন খাতে পূর্বতন রাজভাষা ইংরেজির প্রচলন ততই বাড়ছে। এবং তা মূলত শিক্ষাঙ্গনে—সরকারি, বেসরকারি উভয় খাতে, এবং তা সরকারি সমর্থনে এবং সংবিধানের রাষ্ট্রভাষা বিষয়ক ধারা লংঘন করে।
সেই পরিস্থিতিতে সমাজে ইংরেজির ব্যাপক ব্যবহার; থাকুক না তাতে অশুদ্ধতা বা মননশীলতার বা পরিশীলিত চর্চার অভাব। কথকতায় বাংলা-ইংরেজির মিশ্রণ এক উদ্ভট সাংস্কৃতিক সংকটের পরিচয় বহন করছে। এ প্রসঙ্গে পরে আসছি। পূর্বপ্রসঙ্গে বলতে হচ্ছে শিক্ষাক্ষেত্রে বাংলা বিতাড়নের আপাত শেষ উদাহরণ ‘ইংলিশ ভার্সন’ নামীয় শিক্ষা বিষয়ক উপদ্রব। সর্বোপরি জীবিকার ভাষাও হয়ে উঠেছে রাষ্ট্রভাষা বাংলা নয়, বিগত ঔপনিবেশিক রাজভাষা ইংরেজি।
দুই.
স্বাধীন বাংলাদেশে মাতৃভাষা বাংলার এহেন বহুমাত্রিক দুর্দশা, দুরবস্থার বিষয়টি পাকিস্তানি আমলে কারো কল্পনায় ছিল না। স্বাধীন বাংলাদেশে শাসক ও তাদের সমপর্যায়ের সামাজিক শ্রেণীগুলোর যেমন পেশাজীবী ব্যবসায়ী, শিল্পপতি, সামরিক বাহিনী প্রভৃতির স্বার্থপূরণের ব্যবস্থা পাশ হওয়ার পর ঔপনিবেশিক রাজভাষা ও তার ভাষিক সংস্কৃতি পূর্ণ দাপটে পূর্বঅবস্থায় ফিরে এল—এল ইংরেজ শাসনামলের শিক্ষিত শ্রেণীর সংস্কৃতি নিয়ে। এল পাকিস্তান আমলের ইংরেজি মহিমা।
এর ফলে বাংলা যে শুধু বাঙালির সাহিত্যের ভাষা, তার দৈনিন্দন মুখের ভাষা হয়ে থাকল তাই নয়, সেই ভাষা শিক্ষার প্রতি অবহেলা ও উদাসীনতা আমাদের মজ্জাগত হয়ে দাঁড়াল। এ অবস্থা সমাজের সর্বস্তরে। তাই বাংলাভাষার নির্ভুল ব্যবহার—উচ্চারণে, বাণিজ্যিক লেখায় অনেকটা অধরা হয়ে উঠেছে সর্বমাত্রিক অশুদ্ধতার দাপটে। সে অশুদ্ধতা নানামাত্রিক। এফ এম বেতারে বাংলার অবমাননা নিয়ে আদালতে যাওয়া চলতে পারে। সে এক অনাচার।
যা দেখা যায় বিজ্ঞাপনে, সাইনবোর্ডের ভুল বানানে, শব্দের ভুল ব্যবহারে, টিভি’র কথকতায়ও ইংরেজি-বাংলার উদ্ভট মিশ্রণে। এককথায় শিক্ষিত শ্রেণীতে বাংলাভাষার ব্যবহারে বাঙালির উদাসীনতা, শুদ্ধতার অভাব, নৈরাজ্যিক প্রভাব প্রকট। ফলে ধারণা হতে পারে বাংলা বাঙালির জীবনে রাষ্ট্রভাষা-জাতীয় ভাষা নয়, সে নিতান্তই দ্বিতীয় ভাষা যার পরিচর্যায় সময় না দিলেও চলে। চলে ঘটা করে প্রতি ফেব্রুয়ারিতে ‘মহান একুশে’ পালন করলেই। যেমন শহীদ দিবসে শহীদ মিনারে তেমনি গোটা ফেব্রুয়ারি মাস জুড়ে বাংলা একাডেমিতে সাহিত্যিক অনুষ্ঠানমালায়।
ভাষার মাস ফেব্রুয়ারিকে বিদায় দিয়ে বছরের বাকি এগারো মাস বাংলাদেশের শিক্ষিত শ্রেণী বাংলাভাষাকে নিয়ে অনাদরে অবহেলায় সময় কাটায়। একুশের দায় পালনে সব শেষ। ভাষার নানামাত্রিক ব্যবহারে আন্তরিকতা ও মননশীলতার অভাব বড় হয়ে দেখা দেয়। তাই বাংলা শব্দের বানানরীতি নিয়ে মতভেদ এখনো দূর হয়নি। বাংলা একাডেমি কর্তৃক প্রবর্তিত প্রমিত বাংলা বানানরীতি এখনো প্রশ্নবিদ্ধ, কোনো কোনো খ্যাতনামা শিক্ষাবিদ বা ভাষাবিজ্ঞানীর কাছে তা অগ্রহণযোগ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে—বিশেষ করে দীর্ঘ উচ্চারণের ক্ষেত্রে এবং বিদেশী শব্দের বানান ব্যবহারে।
দীর্ঘ উচ্চারণ বাংলায় সচল নয়, এ যুক্তিতে দীর্ঘ ঈ বর্জনে সুবিধাই বা কী, লাভই বা কী। ‘তীর’ শব্দটিকে ‘তির’-এ পরিণত না করলে কি মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যেত, কিংবা ‘শ্রেণী’কে ‘শ্রেণি’ বানানে টেনে এনে। আমার কথা হলো ‘তীর’ বা ‘শ্রেণী’ এবং অনুরূপ দীর্ঘ ঈ যুক্ত বানান কি কোনো অসুবিধা তৈরি করছিল শিক্ষিত শ্রেণীর ভাষা শিক্ষার ক্ষেত্রে?
তাছাড়া ইংরেজি শব্দে যেখানে দীর্ঘ বানান যেমন Greek, League, এগুলোর মূল বানান অস্বীকার করে ডানা কাটার পেছনে কী ভাষিক স্বার্থ উদ্ধার হয়েছে? এসব শব্দের বাংলারূপ ‘গ্রীক’ বা ‘তীর’ থাকলে কি ভাষাবিজ্ঞানের খুব একটা ক্ষতি হতো এ প্রসঙ্গে যে সমতার কথা বলা হয়েছে, তা কি সর্বত্র রক্ষা করা গেছে? তাহলে কেন আনন্দবাজারী নব্য রীতি অনুসরণ?
আরো একটি বিষয় বিবেচ্য। আজকাল সাহিত্যের ভাষা ও শব্দ ব্যবহারে, বিশেষ করে তরুণদের মধ্যে আঞ্চলিকতার যে প্রবণতা প্রধান হয়ে উঠেছে তাতে কি প্রমিত বাংলার ভাষিক ও শাব্দিক মানমর্যাদা রক্ষা করা সম্ভব হবে? এ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা হলো প্রমিত বাংলারীতি কি বাংলা ভাষার বানান সমস্যার পুরোপুরি সমাধান করতে পেরেছে? এখনো একাধিক শিক্ষাবিদ, ভাষাবিদ বা অধ্যাপক-সাহিত্যিককে নিজ পছন্দমতো বানান ব্যবহার করতে দেখা যায়।
তিন.
বাংলার ভাষিক ব্যবহারে এই যে প্রমিত বাংলার আধিপত্য, অন্যদিকে ভাষিক নৈরাজ্য (যেমন—দরজা= দরোজা, নরম=নরোম ইত্যাদি), এমনকি ক্ষেত্র বিশেষে দীর্ঘ ঈ’র ব্যবহার যে বিভেদ-বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেছে তার সুষ্ঠু সমাধান কি সম্ভব হবে? আরো একটি কথা, প্রমিত বানানরীতির সংস্কারের যাত্রাপথে কোনো কোনো প্রভাবশালী সংবাদপত্র তো নিজস্ব বানানরীতির পক্ষে পুস্তিকা প্রকাশ করে সেই পথ ধরে চলছে। তেমন সব ক্ষেত্রে সমতা আসবে কীভাবে?
এবার ভাষা প্রসঙ্গে একটি ভিন্ন বিষয় বিচার-ব্যাখ্যার দাবি রাখে। বিস্ফোরক, জনপ্রিয় ভাষাআন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদাব্যঞ্জক অনুচ্ছেদ সত্ত্বেও এই যে সর্বত্র ঔপনিবেশিক বিদেশী ভাষার ব্যাপক বংশবিস্তার এবং শিক্ষিত সমাজে জীবন-জীবিকায় এর পেছনে এককাট্টা সমর্থন, এর নেপথ্য কারণ কী হতে পারে?
তা কি শুধু শিক্ষিত শ্রেণীর অনুসৃত বিদেশী ভাষিক সংস্কৃতির ধারাবাহিকতা রক্ষা, শ্রমসাধ্য পরিবর্তনে অনীহা, নাকি সাম্রাজ্যবাদী শক্তির প্রতি আনুগত্যে ঔপনিবেশিক আমলের দাস মনোভাব অনুসরণ? কোনটা বাঙালি শিক্ষিত মানসের স্ববিরোধী আচরণের নেপথ্য কারণ? যে কারণে বঙালির একসময়কার ভাষিক-জাতীয়তা ভিত্তির পর্ব ও অহংকার আত্মগ্লানির প্রকাশ না ঘটিয়েই উধাও হয়ে গেছে। অবশ্য আনুষ্ঠানিকতার বহিরঙ্গটুকু যথারীতি পালিত হচ্ছে।
আমার বিশ্বাস বাঙালি মানসের বহু উচ্চারিত জাতীয়তাবাদী ধ্যানধারণার গর্ব ও অহংকারের অন্তরালে অন্য একটি শক্তিমান বৈশিষ্ট্য দীর্ঘকালীন বিদেশী শক্তির অধীনে সাংস্কৃতিক দাসত্বজনিত হীনমন্যতা পূর্বোক্ত স্ববিরোধিতার অন্যতম প্রধান কারণ। সেই সঙ্গে রয়েছে পূর্বঅভ্যাস থেকে নিজভাষায় ফেরার শ্রমসাধ্য যাত্রায় অনীহা।
শ্রেণী বিশেষের স্বার্থ তো পূরণ হয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশে। তাই পূর্বধারায় যেমনটা চলছে চলুক না। তাতে ক্ষতি কী? এমনটাই ইংরেজি শিক্ষিত শ্রেণীর মানসিকতা। বাংলা নিয়ে আন্দোলনের প্রয়োজন হয়েছিল তাদের আর্থ-সামাজিক স্বার্থ উদ্ধারের প্রয়োজনে। স্বাধীন বাংলাদেশে সে প্রয়োজন ভালোভাবে মিটেছে শিক্ষিত শ্রেণীর জন্য। তাই বাংলা চুলোয় যাক, ক্ষতি নেই। শুধু তার বিজয়ের স্মৃতিরক্ষা করেই আনুষ্ঠানিকতায় ঋণশোধই যথেষ্ট। কিন্তু প্রকৃত জাতিরাষ্ট্র এ স্ববিরোধিতা স্বীকার করে না।
এর প্রমাণ ইউরোপের জাতিরাষ্ট্রগুলো। যেমন—ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানি, স্পেন ইত্যাদি। তাদের মাতৃভাষা তাদের রাষ্ট্রভাষা ও জাতীয় ভাষা। সেই ভাষাতে তাদের ব্যক্তিজীবন, সমাজজীবন ও জাতীয় জীবনের সর্ববিধ কাজকর্ম চলে। চলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও। এদিক থেকে কোনো ছাড় নেই, ব্যতিক্রম নেই। আধুনিক হয়ে, গণতন্ত্রী বা সমাজতন্ত্রী হয়েও তাদের ভাষিক জাত্যাভিমান প্রবল। কিন্তু আমাদের শ্রেণী-স্বার্থপরতা আমাদের ঠিক এর বিপরীত পথে চালনা করেছে। বৃথাই আমরা ভাষা নিয়ে, একুশে নিয়ে গর্ব করি। বাঙালির জন্য এ এক গভীর স্ববিরোধ, বিশাল তামাসা!