কক্সবাংলা ডটকম(১ ডিসেম্বর) :: ১ম বিশ্বযুদ্ধের চেয়ে বহুলাংশে ধ্বংসাত্মক ও ভয়াবহ ছিল ২য় বিশ্বযুদ্ধ। ৭৩ বছর পেরিয়ে গেছে, এখনও সেই মরণযজ্ঞের ছাপ রয়ে গেছে পৃথিবীর আনাচে কানাচে। এখনও সেই মহাযুদ্ধের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব রয়েছে সমগ্র বিশ্বজুড়ে। পৃথিবীর ইতিহাসে এর চেয়ে বড় ধ্বংসযজ্ঞ আগে কখনো সংঘটিত হয়নি।
সময়ের সাথে ভূ-রাজনীতির স্বার্থে অনেক রাষ্ট্রই পুরনো শত্রুতা ভুলে বন্ধু হয়েছে, কিন্তু পৃথিবীর বুকে যে আঁচড় ফেলে গেছে ২য় বিশ্বযুদ্ধ, তা মুছে ফেলা কি আদৌ সম্ভব? হয়তো আরেক নতুন ধ্বংসযজ্ঞই বিস্মৃত করতে পারে এই মহাধ্বংসলীলার স্মৃতি। কিন্তু আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সার্বিক সতর্কতা ও সামগ্রিক ব্যবস্থা গ্রহণের পরেও ১ম বিশ্বযুদ্ধের পরে কী করে পৃথিবী মাত্র দু’যুগের মধ্যেই আরেকটি নতুন বিশ্বযুদ্ধের পথে পা বাড়ালো, তা অবশ্যই শুধু জানার নয়, ভেবে দেখারও বিষয়। চলুন একবার চোখ বোলানো যাক ইতিহাসের পুরনো বাঁকগুলোতে।
১৯৩০ এর গোড়া থেকেই ইউরোপ ও এশিয়ার আন্তঃরাষ্ট্রীয় পরিস্থিতি ক্রমশ উত্তেজিত হয়ে উঠতে থাকে। ১৯৩১ এর সেপ্টেম্বরে চীনের মাঞ্চুরিয়া আক্রমণ করে জাপান লিগ অব নেশনসের মর্যাদায় আঘাত হানে। জাপানের এই অন্যায় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে কার্যত কোনো ভূমিকা নিতে পারেনি লিগ অব নেশনস। এই ঘটনা থেকে শিক্ষা নিতে ভুল করলো না ইতালি ও জার্মানি। তারা বুঝতে পেরেছিল, আগ্রাসনের বিপরীতে লিগ অব নেশনস অসহায়। এমনকি ইউরোপের বৃহৎ শক্তিবর্গ ব্রিটেন ও ফ্রান্সেরও অক্ষমতা প্রকাশ পায় এই ঘটনায়। দূর প্রাচ্যে আগ্রাসন নীতি প্রতিহত করতে যুক্তরাষ্ট্রও বিশেষ উদ্যোগ নিলো না।
আন্তর্জাতিক নিরস্ত্রীকরণ সমস্যার সমাধান করার ক্ষেত্রেও লিগ অব নেশনস চূড়ান্ত ব্যর্থতা দেখায়। ১৯৩৩ সালে জাপান ও জার্মানি লিগ অব নেশনস থেকে বেরিয়ে যায়। জার্মানির বেরিয়ে যাওয়া নিরস্ত্রীকরণের শেষ আশাটুকুও শেষ করে দেয়। এদিকে ১৯৩৫ সাল থেকেই ১ম বিশ্বযুদ্ধে চাপানো ভার্সাই চুক্তি লঙ্ঘন করে হিটলার সামরিক শক্তি বৃদ্ধিতে মনোযোগ দেন। ওদিকে ১৯৩৬ সালে ইতালির মুসোলিনি ইথিওপিয়া দখল করে নেন। এই আগ্রাসনে নিহত হয় ৫ লক্ষ ইথিওপিয়ান। ইথিওপিয়ার দখলে হিটলার মুসোলিনিকে পূর্ণ সমর্থন ও মদদ দেন।
ব্রিটেন ও ফ্রান্সের বিপরীতে নিজেদের অবস্থান শক্তিশালী করতে থাকেন দুই স্বৈরশাসক। ১৯৩৬ সালে স্পেনের গৃহযুদ্ধকে কেন্দ্র করে আরও কাছাকাছি আসেন এই দুই নেতা। স্পেনের গৃহযুদ্ধের আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া সুদূরপ্রসারী ছিল। সামরিক অভ্যুত্থান ও তার বিরুদ্ধে প্রজাতন্ত্রের প্রতিরোধ স্পেনের অভ্যন্তরীণ বিষয় হিসেবে সীমাবদ্ধ থাকেনি। মুসোলিনি ও হিটলার উভয়ের কাছেই স্পেনের গৃহযুদ্ধ ছিল কমিউনিস্ট মতাদর্শ ও ফ্যাসিবাদের মধ্যে সংঘাত। আর তাই তারা যেকোনো মূল্যে স্পেনের সামরিক অভ্যুত্থানকারীদের জয় চেয়েছিলেন। ১৯৩৯ এর জানুয়ারিতে বার্সেলোনার পতন হলে ব্রিটেন ও ফ্রান্স ফ্রাঙ্কোর নেতৃত্বাধীন সামরিক ফ্যাসিস্ট সরকারকে স্বীকৃতি দেয়।
অ্যালান বুলক, এলিজাবেথ উইস্কেম্যান প্রমুখ ঐতিহাসিকের মতে হিটলার তার রাজনৈতিক জীবনের প্রাথমিক পর্যায়েই একটি বিশ্বযুদ্ধের পরিকল্পনা করেছিলেন। তাদের বক্তব্যের সত্যতার প্রমাণ হিসেবে তারা ১৯২০ এর দশকের শেষের দিকে গৃহীত নাৎসি কর্মসূচিসমূহ ও ১৯২৫ সালে প্রকাশিত হিটলারের আত্মজীবনী ‘Mein Kampf’ এর উপর গুরুত্বারোপ করেন। তার আত্মজীবনীতে ও ১৮২৮-২৯ সালের নাৎসি কর্মসূচি সংক্রান্ত দলিলগুলোতে স্পষ্টত বলা ছিলো, বর্ধিত জার্মান জনসংখ্যার স্থান সংকুলান ও বাসস্থানের জন্য জার্মানিকে একটি আগ্রাসী পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করতে হবে এবং এই আগ্রাসন হবে অবশ্যই প্রাচ্যমুখী। কাজেই ২য় বিশ্বযুদ্ধ ছিল হিটলারের অভিপ্রেত ও পূর্বপরিকল্পিত।
অপরদিকে ঐতিহাসিক জে. পি. টেইলর মনে করেন, ব্যাপারটি হিটলারের পূর্ব পরিকল্পিত ছিল না। টেইলর মনে করেন, হিটলার ঘটনার জন্য অপেক্ষা করার এক অভিনব কৌশল আয়ত্ত করেছিলেন, আর পশ্চিমের শক্তিগুলো একের পর এক হিটলারের সামনে সুযোগ উন্মুক্ত করেছিল। ব্রিটেন ও ফ্রান্সকে ১ম বিশ্বযুদ্ধের ভয়ানক অভিজ্ঞতা তখনও আতঙ্কিত করে রেখেছিল। তাই তারা হিটলারের বিরুদ্ধে কোনো কড়া পদক্ষেপ নিতে আগ্রহী ছিল না। ফ্যাসিস্ট শক্তিগুলোর প্রতি ব্রিটেন ও ফ্রান্স যে নীতি গ্রহণ করেছিল, তা ইতিহাসে তোষণ নীতি নামে পরিচিত। ফ্রান্স ও ব্রিটেনের নেতারা মনে করতেন ভার্সাই চুক্তি দ্বারা জার্মানির উপর চরম অন্যায় করা হয়েছিল, হিটলারের ভার্সাই চুক্তির ধারাবাহিক লঙ্ঘন ছিল সেই অন্যায়ের প্রতিবাদ মাত্র। এই তোষণ নীতিই পরবর্তীতে ২য় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপট তৈরি করতে সহায়ক হয়।
হিটলারের আগ্রাসন নীতি চলতে থাকে। ১৯৩৮ এর গোড়ার দিকে অস্ট্রিয়ার নাৎসিবাদীদের আইনী স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য অস্ট্রিয়ার চ্যান্সেলর শুসনিগের উপর চাপ সৃষ্টি করেন। শুসনিগ জানান, একটি গণভোটের মাধ্যমে বিষয়টির নিষ্পত্তি হবে। হিটলার তৎক্ষণাৎ জার্মান বাহিনীকে অস্ট্রিয়া আক্রমণের নির্দেশ দেন। অস্ট্রিয়া জার্মান নাগরিকদের সাথে দুর্ব্যবহার করেছে ও চেকোস্লোভাকিয়ার সাথে হাত মিলিয়ে জার্মান বিরোধী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে- এই দুটি অজুহাত দাঁড় করানো হয়। ১৯৩৮ সালের ১২ মার্চ জার্মান সেনাদল অস্ট্রিয়া দখল করে নেয়। হিটলার কর্তৃক জার্মানির সাথে অস্ট্রিয়ার এই সংযুক্তিকরণকে ‘আনশ্লুস’ (Anschluss) বলা হয়। নাৎসিরা অস্ট্রিয়ান ইহুদীদের উপর চরম অত্যাচার চালায়।
এরপর ১৯৩৮ সালেই হিটলার চেকোস্লোভাকিয়ার প্রেসিডেন্ট এডওয়ার্ড বেনেসের বিরুদ্ধে বিদ্বেষমূলক প্রচারণা চালাতে থাকে। তার প্রধান অভিযোগ ছিল, চেকোস্লোভাকিয়ার সরকার সুদেতান অঞ্চলে বাসরত জার্মানদের সুরক্ষিত রাখতে ব্যর্থ হয়েছে। হিটলার সরাসরি সুদেতান অঞ্চল দাবি করে বসেন। বেনেস ফ্রান্স ও ব্রিটেনের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করে, কিন্তু তোষণ নীতির কারণে দুটি দেশই সাহায্য করতে অস্বীকৃতি জানায়। কিন্তু এই তোষণ নীতি শেষমেশ শান্তি নিয়ে আসতে পারেনি।
১৯৩৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর জার্মানি পোল্যান্ড আক্রমণ করলে তোষণ নীতির অবসান ঘটে। ব্রিটেন ও ফ্রান্স যৌথ শক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে জার্মানির বিরুদ্ধে। ৩ সেপ্টেম্বর ব্রিটেন যুদ্ধ ঘোষণা করে জার্মানির বিরুদ্ধে। শুরু হয়ে যায় ২য় বিশ্বযুদ্ধ। জার্মান আক্রমণের মুখে পতন হয় পোল্যান্ডের। এদিকে প্রতিরোধ গড়ে তোলে সোভিয়েত ইউনিয়ন। ১৭ সেপ্টেম্বর সোভিয়েত ইউনিয়নের লাল ফৌজ দখল করে নেয় পূর্ব পোল্যান্ড। সেপ্টেম্বর মাসেই হিটলার ফ্রান্স আক্রমণের ঘোষণা দেন। তবে সেটি পরে ১৯৪০ এর বসন্তকাল পর্যন্ত পেছানো হয়। ১৯৪০ এর ১০ মে পশ্চিম ইউরোপে যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। জার্মানি ফ্রান্সের উপর আক্রমণ শুরু করে ও তাদের আক্রমণের মুখে ইঙ্গ-ফরাসি প্রতিরোধ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। ১৫ মে নেদারল্যান্ড ও ২৮ মে বেলজিয়াম জার্মানির কাছে আত্মসমর্পণ করে। জার্মানির আক্রমণে পর্যুদস্ত হয়ে ফ্রান্স রাজধানী প্যারিস থেকে বর্দোতে স্থানান্তরিত করে। ১৪ জুন প্যারিসের পতন ঘটে।
১৯৪০ সালের ১০ মে উইনস্টন চার্চিল ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর পদ গ্রহণ করেন। একই বছর ৩১ জুলাই জার্মানি ব্রিটেনের বিরুদ্ধেও যুদ্ধ ঘোষণা করে। ওদিকে ইতালিও একের পর এক ব্রিটিশ শাসিত অঞ্চলগুলো আক্রমণ করে দখল করতে শুরু করে। ১৯৪১ সালের ২২ জুন রুশ-জার্মান অনাক্রমণ চুক্তি লঙ্ঘন করে জার্মানি সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণ করে বসে। ডিসেম্বরের মধ্যেই ইউক্রেনের একটি বিরাট অংশসহ প্রায় অর্ধ মিলিয়ন বর্গ মাইল সোভিয়েত ভূখণ্ড জার্মানির অধীনে চলে যায়। এরপর এক দ্রুত পরিবর্তন আসে আন্তর্জাতিক মহলে। গ্রেট ব্রিটেন, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্র একটি অক্ষশক্তি বিরোধী চুক্তিতে আবদ্ধ হয়। তেল রপ্তানির নিষেধাজ্ঞা নিয়ে জাপান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে চলমান উত্তেজনার প্রেক্ষিতে ১৯৪১ এর ৭ ডিসেম্বর হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জের পার্ল হারবারে মার্কিন নৌবহরের উপর জাপান হামলা চালায়। ফলে যুক্তরাষ্ট্রও ২য় বিশ্বযুদ্ধ জড়িয়ে পড়ে। এভাবেই ছড়িয়ে পড়ে ২য় বিশ্বযুদ্ধের আগুন।
২য় বিশ্বযুদ্ধের তাণ্ডব ও ধ্বংসলীলা ১ম বিশ্বযুদ্ধের চেয়ে সবদিক দিয়ে বেশি ছিল। নতুন প্রযুক্তি, নতুন নতুন অস্ত্রের ব্যবহার, আকাশপথে যুদ্ধ ও পারমাণবিক বোমার ব্যবহারের মতো বিষয়গুলো ২য় বিশ্বযুদ্ধকে আরও ভয়াবহ করে তোলে। প্রায় ৬০ মিলিয়নের উপর মানুষ মারা যায় এ মহাযুদ্ধে, যা তখনকার বিশ্ব জনসংখ্যার ৩% ছিল। ২য় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা ও ধ্বংসলীলা নিয়ে কথা হবে নতুন কোনো লেখায়।
Posted ৩:১৮ পূর্বাহ্ণ | রবিবার, ০২ ডিসেম্বর ২০১৮
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta