কক্সবাংলা ডটকম(১ সেপ্টেম্বর) :: রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে একের পর জঙ্গি হামলা ও জঙ্গিবিরোধী অভিযানের মধ্যেই তিন দিনে অন্তত ২০ জঙ্গি জামিনে মুক্তি পেয়েছে। এ নিয়ে চলতি বছরে এখন পর্যন্ত জামিনে মুক্তি পাওয়া জঙ্গির সংখ্যা দুইশ ছাড়িয়েছে।
এত জঙ্গির জামিনে মুক্তি পাওয়া নিয়ে বিস্ময় জানিয়েছেন খোদ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাই।
এদিকে, জামিনে মুক্তি পাওয়া জঙ্গিদের অনেকেই আবারও জঙ্গি কার্যক্রমে জড়িয়ে পড়েছে। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা গেছে এসব তথ্য।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলছেন, একজন জঙ্গিকে ধরতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কোনও কোনও ইউনিটকে কয়েক মাস ধরে কাজ করতে হয়। অথচ এসব জঙ্গিরা সহজেই জামিনে মুক্ত হয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে দেশ থেকে জঙ্গি নির্মূল করা কোনোভাবেই সম্ভব হবে না।
কর্মকর্তারা বলছেন, জামিনে মুক্তি পাওয়া জঙ্গিরা জামিনে মুক্ত হয়ে আগের মতো পালিয়ে যাবে, নয়তো আত্মগোপনে থেকে নতুন করে জঙ্গি কার্যক্রমে জড়িয়ে পড়বে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত তিন দিনে কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি কারাগার থেকে অন্তত ২০ জঙ্গি জামিনে মুক্তি পেয়েছে। কারা কর্মকর্তারা বলছেন, আদালত থেকে জামিন পেলে তাদের আর কিছু করার থাকে না। আসামি যত বড় সন্ত্রাসী বা জঙ্গিই হোক, আদালতের আদেশে জামিন পেলে তাদের ছেড়ে দিতে হয়।
কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি জেলের সিনিয়র জেল সুপার প্রশান্ত কুমার বলেন, ‘আদালত থেকে জামিনের আদেশ এলেই আমরা মুক্তির প্রক্রিয়া শুরু করি। তবে নিষিদ্ধঘোষিত কোনও সংগঠন কিংবা আলোচিত সন্ত্রাসীদের জামিনে মুক্তি দেওয়ার আগে আইনশৃঙ্খলার কথা চিন্তা করেই তা সবগুলো গোয়েন্দা সংস্থাকে জানানো হয়। জামিনে মুক্তি পাওয়ার বিষয়ে আসলে কারা কর্তৃপক্ষের কিছু করার নেই।’
জানা গেছে, গত বৃহস্পতিবার (৩১ আগস্ট) সকাল ১১টার দিকে কাশিমপুর কারাগার থেকে মুক্তি পায় নিষিদ্ধঘোষিত জঙ্গি সংগঠন হিযবুত তাহরিরের আব্দুল বাতেন। তার বিরুদ্ধে মানিকগঞ্জের দৌলতপুর থানায় দু’টি মামলা রয়েছে। এছাড়া রাজধানীর শেরেবাংলানগর থানায় সন্ত্রাসবিরোধী আইনে একটি মামলা ও বিশেষ ক্ষমতা আইনে একটি মামলা রয়েছে তার নামে।
একই দিন দুপুর ১২টার দিকে কারাগার থেকে একসঙ্গে জামিনে বের হয় তিন জঙ্গি আবুল কালাম, মিজানুর রহমান ও সেলিম মিয়া। আবুল কালামের গ্রামের বাড়ি গাইবান্ধার বহরমপুরে। রাজধানীর দারুস সালাম থানায় তার বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবিরোধী আইনের একটি মামলা রয়েছে।
অন্য দু’জনের মধ্যে মিজানুরের গ্রামের বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জে। সেলিমের বাড়িও একই এলাকার আজমতপুরে। তাদের দু’জনের বিরুদ্ধে রাজধানীর দারুস সালাম থানায় সন্ত্রাসবিরোধী আইনের ৬(২)ই/৯/১০/১২ ধারায় মামলা রয়েছে।
কারা সূত্র জানায়, শুক্রবারও (১ সেপ্টেম্বর) জামিন পেয়ে জেএমবির তিন সদস্য কারাগার থেকে ছাড়া পেয়েছে। তারা হলো— শরীয়ত উল্লাহ ওরফে শুভ, আশিকুল আকবর ও নাজমুস সাকিব। শুভর বাড়ি নড়াইলের শেখহাটি এলাকায়, আশিকুলের রংপুরের শাহজামাল রোড এলাকায় ও সাকিবের বাড়ি যশোরের বারাদিপাড়ায়। তাদের বিরুদ্ধে রাজধানীর ডেমরা থানা ও গাজীপুরের টঙ্গী থানায় সন্ত্রাসবিরোধী আইনে দু’টি মামলা রয়েছে।
শুক্রবার দুপুরেই ১২টার দিকে জামিনে মুক্তি পায় আরও চার জঙ্গি। তারা হলো— মামুনুর রশিদ, ইয়াসিন, জাহিদুল ইসলাম ও মোর্শেদ ওরফে মাসুম। এর মধ্যে মামুনুর রশিদের গ্রামের বাড়ি গাজীপুরের জয়দেবপুর থানার সালনায়, ইয়াসিনের গ্রামের বাড়ি পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জে, জাহিদুলের বাড়ি চাঁদপুরের হাইমচরে ও মাসুমের বাড়ি ফেনীর সোনাগাজীতে।
এই চার জনের মধ্যে মামুনুর রশিদ ও ইয়াসিনের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে ঢাকার যাত্রাবাড়ী থানায় একটি মামলা রয়েছে। এছাড়া, জাহিদুলের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে গেন্ডারিয়া থানায় ও মাসুমের বিরুদ্ধে মিরপুর থানায় একটি মামলা রয়েছে।
এর আগে, গত বুধবার (৩০ আগস্ট) সকাল ১১টায় একই জেল থেকে মুক্তি পায় আমিনুল ইসলাম নামে এক জেএমবি সদস্য। শেরপুরের নালিতাবাড়ি নিশ্চিন্তপুর এলাকায় তার বাড়ি। আমিনুলের বিরুদ্ধে রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানায় সন্ত্রাসবিরোধী আইনের ৯(১)/১০/১১/১২ ধারায় একটি মামলা রয়েছে। একই দিন সন্ধ্যা ৬টার দিকে মুক্তি পায় আরেক জঙ্গি সদস্য মনির হোসেন। তার বাড়ি ভোলার লালমোহনের বাদরপুরে। টঙ্গী থানায় সন্ত্রাসবিরোধী আইনের ৬(১)এ/৬(২)/৮/৯/১০/১১/১২/১৩ ধারায় মামলা রয়েছে তার নামে।
জঙ্গিদের জামিনে মুক্তি পাওয়া প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের পাবলিক প্রসিকিউটর জানান, তার কোর্টে সাম্প্রতিক সময়ে জামিন মঞ্জুর হওয়ার বিষয়টি জানা নেই।
যোগাযোগ করা হলে রাষ্ট্রের উপ-প্রধান আইন কর্মকর্তা মোতাহার হোসেন সাজু বলেন, ‘জঙ্গি বা নিষিদ্ধঘোষিত দলের কোনও সদস্যের জামিন পাওয়ার কথা না। এরকম কেউ জামিন পেলেও অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিস থেকে তা স্থগিতের জন্য সঙ্গে সঙ্গে আবেদন করা হয়ে থাকে।’
মোতাহার হোসেন সাজু বলেন, ‘সাধারণত বিভিন্ন বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে জামিন পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এর মধ্যে দীর্ঘ সময় ধরে জেলে থাকা আসামিদের মামলা বিচারাধীন বা তদন্তাধীন হলেও অনেক সময় আদালত জামিন মঞ্জুর করেন। জঙ্গি বিষয়ে আমাদের কাছে জিরো টলারেন্সের নির্দেশনা রয়েছে। আমরা জঙ্গিদের বিষয়ে কোনও ছাড় দিই না। জামিন হয়ে গেলেও আমরা তা স্থগিত করার জন্য আবেদন করে থাকি।’
জঙ্গি প্রতিরোধ নিয়ে কাজ করেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এমন একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘নিষিদ্ধঘোষিত দলের একজন সদস্যকে ধরতে কী পরিমাণ কষ্ট করতে হয়, তা ওই কর্মকর্তা ছাড়া আর কেউ বুঝবে না। দিনের পর দিন ম্যানুয়াল সোর্স ও প্রযুক্তিগত সোর্সের মাধ্যমে জঙ্গিদের শনাক্ত করে তারপর তাকে আটক বা গ্রেফতার করা হয়।
সন্ত্রাসবিরোধী আইন ও বিশেষ ক্ষমতা আইনের এসব আসামিরা যদি সহজেই জামিনে মুক্তি পেয়ে যায়, তাহলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির স্থিতিশীলতা ধরে রাখতে অনেক কষ্ট হবে। কারণ জামিনে মুক্তি পাওয়া জঙ্গিরা আত্মগোপনে গিয়ে আবার কার্যক্রম শুরু করে।’ অপরাধীর কার্যক্রম বিবেচনা করে জামিন দেওয়া উচিত বলে মন্তব্য করেন তিনি।
কারাগার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একটি সূত্র জানায়, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত পর্যন্ত কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে ১৪৮ জঙ্গি জামিনে মুক্ত হয়। জুলাই ও আগস্ট মাসের জন্য এই সংখ্যা সুনির্দিষ্টভাবে পাওয়া না গেলেও এই সংখ্যা দুইশ ছাড়িয়েছে বলে জানিয়েছে একটি সূত্র।
জামিনে মুক্তি পাওয়ারা আইএস মতাদর্শের অনুসারী নব্য জেএমবি, পুরোনো জেএমবি (জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ), আনসারুল্লাহ বাংলা টিম, হরকাতুল জিহাদ (হুজি-বি) ও হিযবুত তাহরিরের সদস্য। তাদের বিরুদ্ধে রাজধানীর বিভিন্ন থানা ও ঢাকার আশেপাশের জেলাগুলিতে সন্ত্রাসবিরোধী আইন ও বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলা রয়েছে।
Posted ৬:৫১ পূর্বাহ্ণ | শনিবার, ০২ সেপ্টেম্বর ২০১৭
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta