কক্সবাংলা ডটকম :: হুন্ডির বাজার শক্তিশালী হয়ে ওঠায় দেশে বৈধ পথে রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয় প্রবাহে বিপর্যয় নেমে এসেছে। গত আগস্টে দেশে রেমিট্যান্স প্রবাহ কমেছে ২১ দশমিক ৪৮ শতাংশ। এর আগে জুলাইয়েও রেমিট্যান্স ৫ দশমিক ৮৮ শতাংশ কম এসেছিল। সব মিলিয়ে চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসেই রেমিট্যান্স কমল ১৩ দশমিক ৫৬ শতাংশ। যদিও গত দুই বছরে প্রায় ২০ লাখ নতুন শ্রমিক কাজের সন্ধানে বিদেশ গেছেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, আগস্টে প্রবাসী বাংলাদেশীরা ব্যাংকিং চ্যানেলে ১৫৯ কোটি ৯৪ লাখ ডলার দেশে পাঠিয়েছেন। গত বছরের আগস্টে দেশে রেমিট্যান্স এসেছিল ২০৩ কোটি ৬৯ লাখ ডলার। সে হিসেবে গত মাসে দেশে রেমিট্যান্স প্রবাহ কমেছে ২১ দশমিক ৪৮ শতাংশ। এর আগে জুলাইয়ে দেশে ১৯৭ কোটি ৩১ লাখ ডলারের রেমিট্যান্স দেশে এসেছিল, যা গত বছরের একই মাসের তুলনায় ৫ দশমিক ৮৮ শতাংশ কম। সে সময় প্রবাসী বাংলাদেশীরা ২০৯ কোটি ৬৩ লাখ ডলার রেমিট্যান্স দেশে পাঠিয়েছিলেন।
প্রায় দুই বছর ধরে দেশে বৈদেশিক মুদ্রার সংকট চলছে। আমদানি দায় ও বিদেশী ঋণের কিস্তি পরিশোধে হিমশিম খাচ্ছে দেশের ব্যাংকগুলো। এ অবস্থায় প্রবাসী আয় দেশের অর্থনীতিতে রক্তসঞ্চার করে আসছিল। তবে চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসেই রেমিট্যান্স প্রবাহে বড় বিপর্যয় ব্যাংকগুলোর বিদ্যমান সংকট বাড়িয়ে তুলেছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ব্যাংক খাতের সঙ্গে খুচরা বাজারে (কার্ব মার্কেট) ডলারের দরে বড় ধরনের ব্যবধান তৈরি হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী ব্যাংকগুলো রেমিট্যান্সের জন্য প্রতি ডলারের দর দিচ্ছে সর্বোচ্চ ১১০ টাকা। যদিও কার্ব মার্কেটে এখন প্রতি ডলার ১১৮-১১৯ টাকা দরে লেনদেন হচ্ছে। দুই বাজারের মধ্যে বড় ধরনের ব্যবধান তৈরি হওয়ায় রেমিট্যান্সের উল্লেখযোগ্য অংশ হুন্ডিতে চলে যাচ্ছে। আবার কিছু ব্যাংক নিজেদের ঘোষিত দরের চেয়ে বেশি মূল্যে ডলার কেনাবেচা করছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
রেমিট্যান্স ও রফতানি আয়ের ক্ষেত্রে ডলারের সর্বোচ্চ দর বেঁধে দেয়া শুরু হয় গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনের সঙ্গে যুক্ত ব্যাংকগুলোর সংগঠন বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলারস অ্যাসোসিয়েশন (বাফেদা) ও ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি) যৌথভাবে এ দর নির্ধারণ করে দিচ্ছে। এর পর থেকেই দেশে রেমিট্যান্স প্রবাহে বিপর্যয় শুরু হয়। গত বছরের আগস্টে ২০৩ কোটি ডলার রেমিট্যান্স দেশে এলেও সেপ্টেম্বরে এক ধাক্কায় তা ১৫৩ কোটিতে নেমে আসে।
রেমিট্যান্স প্রবাহ উল্লেখযোগ্য হারে কমে গেছে, এমন ব্যাংকগুলোর একটি বেসরকারি খাতের দ্য সিটি ব্যাংক লিমিটেড। ব্যাংকটির মাধ্যমে আগস্টে মাত্র ৯২ লাখ ডলারের রেমিট্যান্স দেশে এসেছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সিটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসরুর আরেফিন বলেন, ‘বাফেদা ও এবিবির নির্ধারণ করে দেয়া দর অনুসরণ করতে গিয়েই আমাদের ব্যাংকের মাধ্যমে রেমিট্যান্স এতটা কমে গেছে। আগে সিটি ব্যাংকের মাধ্যমে ৮-১০ কোটি ডলার রেমিট্যান্স আসত। এখন সেটি এক কোটিতে নেমে গেছে। সব ব্যাংক ঘোষিত দর অনুসরণ করে রেমিট্যান্স আনছে না। কিছু ব্যাংক বেশি দরে রেমিট্যান্স আনার কারণে অন্য ব্যাংকগুলোর পাশাপাশি দেশের অর্থনীতিও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
কভিড-১৯ সৃষ্ট দুর্যোগের সময় তথা ২০২০-২১ অর্থবছরে প্রবাসীরা রেকর্ড ২ হাজার ৪৭৭ কোটি বা ২৪ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন ডলার দেশে পাঠিয়েছিলেন। এরপর ২০২১-২২ অর্থবছরে রেমিট্যান্স কমে ২ হাজার ১৩০ কোটি ডলারে নেমে আসে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে রেমিট্যান্স প্রবাহ ২ দশমিক ৭৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়। গত অর্থবছরে দেশে মোট রেমিট্যান্স এসেছিল ২ হাজার ১৬১ কোটি ডলার। গত দুই অর্থবছরে রেমিট্যান্স প্রবাহে স্থবিরতা চললেও এ সময়ে বিদেশগামী অভিবাসীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে।
বাংলাদেশ জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য বলছে, শুধু চলতি ২০২৩ সালের প্রথম ছয় মাসে (জানুয়ারি-জুন) ৬ লাখ ১৭ হাজার ৫৭৬ জন বাংলাদেশী অভিবাসী শ্রমিক হিসেবে বিদেশ গেছেন। ২০২২ সালে বিদেশগামী শ্রমিকের সংখ্যা ছিল ১১ লাখ ৩৫ হাজার ৮৭৩ জন। এর আগে ২০২১ সালেও ৬ লাখ ১৭ হাজার ২০৯ বাংলাদেশী শ্রমিক অভিবাসী হয়েছেন। এত বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশী বিদেশ গেলেও রেমিট্যান্স প্রবাহে সেটির প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না।
এদিকে রেমিট্যান্স প্রবাহে বিপর্যয়ের প্রভাব দেখা যাচ্ছে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে। গত এক বছরে দেশের রিজার্ভ প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। গত ৩০ আগস্ট আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী (বিপিএম৬) দেশের রিজার্ভ ছিল ২৩ দশমিক শূন্য ৬ বিলিয়ন ডলার। চলতি সপ্তাহেই বাংলাদেশ ব্যাংককে এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) দায় পরিশোধ করতে হবে। গত জুলাই-আগস্ট সময়ের জন্য সুদসহ এ দায়ের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ১১৫ কোটি ডলার। সে হিসাবে চলতি সপ্তাহেই দেশের রিজার্ভ ২২ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে যাবে বলে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
Posted ১২:৩৩ অপরাহ্ণ | সোমবার, ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta