মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম,উপজেলা নির্বাহী অফিসার,টেকনাফ :: কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলা একটি বহুমুখী দুর্যোগপ্রবণ এলাকা। এখানকার উল্লেখযোগ্য আপদ হলো সাইক্লোন, অতিবর্ষণ, ভূমিধস ও আকস্মিক বন্যা। দুর্যোগ মোকাবিলায় এ অঞ্চলে বিশেষ কিছু সংবেদনশীল দিক রয়েছে। উপজেলার মূল জনগোষ্ঠী তিন লক্ষাধিক হলেও আটটি ক্যাম্পের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী যোগ হয়ে বর্তমানে এ সংখ্যা প্রায় পাঁচ লাখে দাঁড়িয়েছে। জনসংখ্যার এ চাপ গড়ে অন্য উপজেলার স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি। তা ছাড়া, এই উপজেলার পশ্চিমে বঙ্গোপসাগর উপকূল এবং পূর্বে নাফ নদের উপকূল বিস্তৃত। বর্তমান প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন কারণে দুর্যোগপ্রবণ এলাকাগুলোর মধ্যে টেকনাফ বাংলাদেশের অন্য যে কোনো উপজেলার চেয়ে বেশি গুরুত্ব বহন করে।
আর্থ-সামাজিক দিক থেকে টেকনাফ সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া ৫০টি উপজেলার মধ্যে অন্যতম। এ উপজেলার অধিকাংশ লোক দারিদ্র সীমার নিচে বসবাস করে বিধায় তাদের ঘরবাড়ি মজবুত ভিত্তির উপর গড়ে তুলতে সক্ষম নয়। আবার অনেক পরিবার পাহাড়ের পাদদেশে ঘরবাড়ি তৈরি করে অবস্থান করছে যা নিরাপদ নয়। এছাড়া, রোহিঙ্গা ক্যাম্পের শেল্টারগুলোর নির্মাণ কাঠামো যথেষ্ট শক্তিশালী নয়। এখানকার বেশিরভাগ লোকজন কৃষিজীবী, মৎস্যজীবী ও শ্রমজীবী। রোহিঙ্গারা কম মজুরিতে কাজ করে বিধায় স্থানীয় জনগোষ্ঠীর নিম্ন শ্রেণির বিশাল অংশ কর্মহীন হয়ে পড়ায় পরিস্থিতি আরও নাজুক। রোহিঙ্গা আগমন ও মাদক পাচার রোধে ২০১৭ সাল হতে নাফ নদে মাছ ধরা নিষিদ্ধ থাকায় প্রায় ১৫ হাজার জেলে পরিবারের লক্ষাধিক মানুষ আর্থিকভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে যা দুর্যোগ মোকাবিলায় চ্যালেঞ্জ বটে। শিক্ষার হারেও তুলনামূলক পিছিয়ে টেকনাফ উপজেলা। সংগত কারণেই বেশির ভাগ মানুষ আশানুরূপ সচেতন নয়। তাছাড়া, বিশাল রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী ও স্থানীয় জনগণের মধ্যে মাঝে মাঝে স্বার্থ-সংশ্নিষ্ট কারণে পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকে না। উপর্যুক্ত সংবেদনশীল কারণগুলো একত্রিত হয়ে দুর্যোগ ঝুঁকি আরও বাড়াচ্ছে।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ নীতিমালা অনুযায়ী উপজেলা, পৌরসভা, ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড পর্যায়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটি বিভিন্ন সময়ে প্রশিক্ষণ ও সিমুলেশন অনুশীলনের মাধ্যমে সকলকে দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন ও দক্ষ করে তোলা হচ্ছে। এ ছাড়া, দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাসের লক্ষ্যে এবং দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষদের সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য খাদ্য নিরাপত্তাসহ দুর্যোগ-পূর্ব প্রস্তুতি, দুর্যোগকালীন ও দুর্যোগ-উত্তর অবস্থা মোকাবিলার ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। স্থানীয় প্রশাসনের নেতৃত্বে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সহযোগী সংস্থা ও দেশি-বিদেশি এনজিও সচেতনতা বৃদ্ধি, জীবিকার মান উন্নয়ন, লজিস্টিক সাপোর্ট দিয়ে সার্বিক সহযোগিতা করছে।
টেকনাফ উপজেলায় দুর্যোগ ঝুঁকি ব্যবস্থাপনায় প্রচুর কার্যক্রম বর্তমানে দৃশ্যমান। সরকারি-বেসরকারি সহযোগিতায় ৭৬টি সাইক্লোন শেল্টার ওয়াশ ব্লকসহ নির্মিত হয়েছে, যেগুলোর ধারণ ক্ষমতা প্রায় ৭০ হাজারেরও বেশি। এখানে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় জেন্ডার সংবেদনশীলতার অংশ হিসাবে ৬৬ ইউনিটে ৩২০ জন নারী স্বেচ্ছাসেবকসহ মোট ১৩২০ জন সিপিপি (কমিউনিটি প্রিপেয়ারডনেস প্রোগ্রাম) স্বেচ্ছাসেবক রয়েছেন, যাদের প্রশিক্ষণ, ড্রিল, সিমুলেশন অনুশীলন ও ওয়ার্কশপের মাধ্যমে সচেতন ও দক্ষ করে তোলা হচ্ছে।
গত কয়েক বছরে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ঝুঁকি হ্রাসের ক্ষেত্রে নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপের পাশাপাশি এখানকার মানুষের সাহস ও কঠোর মনোবল তাদের দুর্যোগ সহনশীল জনগোষ্ঠীতে পরিণত করেছে। তবুও টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক চুক্তি ও সনদে প্রতিশ্রুত অঙ্গীকারগুলো প্রতিপালনে আরও বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। সেগুলো হচ্ছে সরকারি-বেসরকারি সহযোগিতায় মাঠ পর্যায়ে থেকে সমন্বিতভাবে দুর্যোগ ঝুঁকিপূর্ণ বসতি ও মানুষের তথ্য সংগ্রহ, আশ্রয়কেন্দ্রের সংখ্যা বৃদ্ধি, বিকল্প বিদ্যুতের ব্যবস্থা, উপকূলীয় সিগন্যাল পোস্ট, জলযানে পর্যাপ্ত লাইফ জ্যাকেট, স্থায়ী বিল বোর্ড ও জীবিকা উন্নয়নের পরিধি বৃদ্ধির ব্যবস্থা। তবে সবচেয়ে বেশি জরুরি হচ্ছে কার্যকর সমন্বয়ের মাধ্যমে তদারকি ও মূল্যায়ন নিশ্চিত করা যা বাস্তবায়নে প্রয়োজন পর্যাপ্ত দক্ষ মানব সম্পদ। তাই দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় স্থানীয় প্রশাসনে বর্তমান জনবল আরও বাড়িয়ে সরকারি-বেসরকারি সহযোগিতার অধিকতর সুফল নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, টেকনাফ, কক্সবাজার
unoteknaf@gmail.com
Posted ২:৩০ অপরাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ০৫ নভেম্বর ২০২০
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta