কক্সবাংলা ডটকম(১০ আগস্ট) :: চিত্রনায়িকা পরীমনি ও মডেল পিয়াসার কাছ থেকে জব্দ করা মোবাইল ফোন ও ল্যাপটপের ফরেনসিক পরীক্ষা করছে সিআইডি। মোবাইল ফোন থেকে এই দুইজন কাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতেন তার একটি ধারণা পেয়েছেন তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। এ ছাড়া কিছু তথ্য, ছবি ও ভিডিও পাওয়া গেছে। এসব তথ্য, ছবি ও ভিডিও তদন্তে সহায়ক হবে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। পরীমনি ও পিয়াসার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল এমন ব্যক্তিদের বিষয়ে খোঁজ নেয়া হচ্ছে।
তদন্তকারী কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, পরীমনি ও পিয়াসার প্রতারণা ও ফাঁদে ফেলার প্রধান অস্ত্র ছিল তাদের ল্যাপটপ ও মোবাইল। যাদের সঙ্গে তারা সময় কাটাতেন তাদের বিতর্কিত স্থিরচিত্র ও ভিডিওগুলো তারা নিজেদের ল্যাপটপে সংরক্ষণ করতেন। সংরক্ষণের আসল উদ্দেশ্য ছিল ব্ল্যাকমেইল করে টাকা আদায়।
টাকা না দিলে ভিডিওগুলো ছেড়ে দেয়ার হুমকি প্রদান করা হতো। পিয়াসা ও পরীমনির কাণ্ডে গাজীপুরের একটি রিসোর্ট আলোচনায় এসেছে। ওই রিসোর্টে যাতায়াত করতেন পরীমনি ও পিয়াসা। গ্রেপ্তার হওয়া মডেল মৌ ২ বার ওই রিসোর্টে গিয়েছেন। শক্ত নিরাপত্তা বলয় ও উঁচু প্রাচীর ঘেরা ওই রিসোর্টে মূলত ভিআইপিদের অবকাশযাপনের জন্য প্রিয় জায়গা।
রয়েছে একাধিক প্রেসিডেন্ট স্যুট। যার এক রাতের ভাড়া ২৫ হাজার টাকা। রাত হলেই জমতো আড্ডা। এ ছাড়াও পিয়াসা গ্রেপ্তার হওয়ার পর বড় অনলাইন ক্যাসিনো ব্যবসায়ী সেলিম প্রধানের নাম এসেছে। পিয়াসার ল্যাপটপে তার সঙ্গে একাধিক ছবি পাওয়া গেছে।
পরীমনির সঙ্গে ডিবির অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) গোলাম সাকলায়েনের সম্পর্কের বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএমপি কমিশনার বলেন, আমি এসব কাজকে একেবারে প্রশ্রয় দিই না। বিসিএস পাশ করা একজন অফিসার এ ধরনের কাজ করবে তা মেনে নেওয়া যায় না। তার স্ত্রী-সন্তান আছে। পরীর সঙ্গে যদি তার মনের মিল হয়ে থাকে, যদি তাকে বিয়ে করতে হয়, তাহলে তো সামাজিক রীতি-নীতি মেনে করতে হবে। তিনি যা করেছেন তার ফল তাকে ভোগ করতে হবে। পুলিশ সদর দপ্তরের পক্ষ থেকে তদন্ত কমিটি হয়েছে। তদন্তে অভিযোগ প্রমাণিত হলে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হবে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সাকলায়েনের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ প্রমাণে সিসি ক্যামেরার ফুটেজই যথেষ্ট। তিনি আরও বলেন, পরীমনি ডিএমপিতে দায়ের হওয়া কোনো মামলার বাদী না। তিনি মামলা করেছেন সাভার থানায়। পরীমনি ইস্যুতে ব্যবসায়ী নাসিরের বিরুদ্ধে যে মাদক মামলা হয়েছে সেটির বাদী পুলিশ। পরীর মামলার তদন্ত বা তদারকি কর্মকর্তা সাকলায়েন না। তাহলে তিনি কেন পরীর কাছ যাবেন? সাকলায়েনের সাহসের তারিফ করে তিনি বলেন, পুলিশ কর্মকর্তাদের সরকারি বাস ভবনে তিনি পরীকে নিয়ে গেছেন। যার চরিত্র নিয়ে চারদিকে নানা কথাবার্তা রয়েছে, তাকে কেন বাসায় আনতে হবে?
ডিএমপি কমিশনার আরও বলেন, এই মুহূর্তে পুলিশের যত তদন্ত ইউনিট আছে সেসবের মধ্যে সবচেয়ে ভালো এবং দক্ষ তদন্ত ইউনিট হলো ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। এ বিষয়ে প্রশ্ন ছিল- এত ভালো তদন্ত ইউনিট থাকার পরও মডেল-অভিনেত্রীদের মামলা কেন তদন্তের জন্য সিআইডিতে পাঠানো হলো? এ বিষয়ে ডিএমপি কমিশনার বলেন, বিতর্ক এড়াতে এটা করা হয়েছে। কারণ একজন ডিবি কর্মকর্তাকে নিয়ে এরই মধ্যে বিতর্ক তৈরি হয়েছে। এ বিষয়ে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম) কৃষ্ণপদ রায় বলেন, মামলা সিআইডিতে যাওয়া ম্যানেজমেন্টের একটি কৌশল।
গ্রেফতারকৃত মডেল-অভিনেত্রীদের মাধ্যমে যারা ব্ল্যাকমেইলিংয়ের শিকার হয়েছেন তারা কোনো অভিযোগ করছে না। তারপরও তাদের বিরুদ্ধে কেন অভিযান পরিচালনা করা হলো-জানতে চাইলে ডিএমপির দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, কোনো ব্যবসায়ী-শিল্পপতি তাদের পার্টিতে গিয়ে ব্ল্যাকমেইলিংয়ের শিকার হয়েছেন বলে তারা মৌখিকভাবে জানিয়েছেন। পরীমনি, পিয়াসা, মৌদের কিছু ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর বিষয়টি নিয়ে আমরা খোঁজখবর নিতে শুরু করি। জানতে পারি, রাজধানীর অভিজাত এলাকার বিভিন্ন ক্লাব-বার বা বাসা অনৈতিক কার্যকলাপ চলছে। এর প্রেক্ষাপটে অভিযান শুরু হয়। অভিযান শুরুর পর কোনো ভিকটিম মামলা করতে রাজি হননি।
তারা জানিয়েছে, সম্পর্কের ভিত্তিতেই গ্রেফতার মডেল-অভিনেত্রীদের সঙ্গে তাদের লেনদেন হয়েছে। তাই তারা কোনো মামলা করেননি। অভিযানের পর যেসব আলামত পাওয়া গেছে, সেসবের ভিত্তিতে মামলা করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। সমাজের সার্বিক অবস্থার প্রেক্ষাপটে এই অভিযানের প্রয়োজন ছিল। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নৈতিক দায়িত্ব থেকে অভিযান চালিয়েছে বলে উল্লেখ করে সূত্রটি জানায়, সব সমাজেই এ ধরনের কার্যকলাপ চলে। তাই এটিকে সমূলে উৎপাটন করা যাবে না। সমাজকে আবদ্ধ করে ফেলা যাবে না। ময়লা ফেলার জন্যই নর্দমার প্রয়োজন উল্লেখ করে সূত্র জানায়, সবকিছুরই একটি সীমারেখা থাকা দরকার।
এদিকে কথিত মডেল পিয়াসা, মৌ, রাজ মাল্টিমিডিয়ার নজরুল ইসলাম রাজ, মিশু হাসান ও জিসানের অঢেল সম্পদের সন্ধান পাচ্ছে গোয়েন্দারা। এর মধ্যে গত রবিবার পুলিশের অপরাধ ও তদন্ত বিভাগ সিআইডি পিয়াসা এবং রাজের চারটি বিলাসবহুল গাড়ি জব্দ করেছে। এগুলো হচ্ছে দুটি বিএমডব্লিউ, একটি হ্যারিয়ার এবং একটি মাজদা গাড়ি। এর মধ্যে একটি বিএমডব্লিউ ও একটি মাজদা গাড়ি পিয়াসার। তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গ্রেফতারদের সুনির্দিষ্ট কোনো ব্যবসা না থাকলেও কীভাবে অঢেল সম্পদের মালিক বনে গেলেন, তা তদন্ত করতে গিয়ে হতবাক করার মতো তথ্য পাওয়া গেছে। ভয়াবহ এই সিন্ডিকেট মাদকের আসরে বিত্তশালীদের শুধু ব্ল্যাকমেলিং করেনি, তাদের বিরুদ্ধে গুরুতর আরও ভয়ংকর অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। অস্ত্র ও সোনা-হীরা চোরাচালান এবং অর্থ ও নারী পাচারের বেশ কিছু তথ্য তদন্তে বেরিয়ে আসছে।
অপরদিকে পরীমনি, ফারিয়া মাহবুব ও মরিয়মের সঙ্গে সমাজের বিশিষ্টজনদের ছবি বা ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে একটি গ্রুপ ব্ল্যাকমেইল করার চেষ্টা করছে বলে জানিয়েছেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার মো. শফিকুল ইসলাম বিপিএম(বার)। ব্ল্যাকমেইলের সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে পুলিশ আইনগত ব্যবস্থা নেবে বলেও জানিয়েছেন তিনি।
ডিএমপির সদর দপ্তরে সোমবার দুপুরে একাধিক দৈনিক পত্রিকার সাংবাদিকদের সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক আলাপকালে এসব কথা বলেন ডিএমপি কমিশনার। এ সময় উপস্থিত ছিলেন ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশনস্) কৃষ্ণপদ রায় বিপিএম(বার), পিপিএম(বার) ও উপ-পুলিশ কমিশনার (মিডিয়া) মো. ফারুক হোসেন।
ডিএমপি কমিশনার বলেন, মডেলদের সাথে সম্পর্ক রয়েছে এমন ব্যক্তিদের তালিকার কথা বলে একটি চক্র চাঁদাবাজিতে নেমেছে। এই চক্রটি সমাজের বিশিষ্টজনদের কাছে ফোন করে তালিকার তাদের নাম থাকাসহ তাদের ছবি বা ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে চাঁদাবাজি করছে বলে তথ্য পেয়েছে পুলিশ। কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তি এই ধরনের চাঁদাবাজির শিকার হওয়ার কথা পুলিশকে জানিয়েছে। এমনকি একজন ব্যবসায়ীর কাছে চাঁদা চেয়ে চিঠি দেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। চাঁদা না দিলে গণমাধ্যমে তার নাম প্রকাশ করার হুমকি দেওয়া হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, কেউ যাতে মিডিয়া ট্রায়ালের শিকার না হন সে জন্য সবাইকে দায়িত্ব নিয়ে কাজ করতে হবে। যারা ইতোমধ্যে গ্রেফতার হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট কিছু আইনে মামলা হয়েছে। সেই মামলাগুলোই তদন্ত করছে পুলিশ।
তিনি চাঁদাবাজদের কল রেকর্ড করতে ভুক্তভোগীদের পরামর্শ দেন। এসব কল রেকর্ড পরে পুলিশের কাছে জমা দিতে বলেন। পাশাপাশি এই চাঁদাবাজদের বিষয়ে স্থানীয় থানা বা ডিএমপিকে তথ্য জানাতে অনুরোধ করেন ডিএমপি কমিশনার।
Posted ৩:৪১ পূর্বাহ্ণ | মঙ্গলবার, ১০ আগস্ট ২০২১
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta