কক্সবাংলা ডটকম(৩০ মার্চ) :: দেশের বেসরকারি অনেক মেডিকেল কলেজেই প্রয়োজনীয় শিক্ষক নেই। ঘাটতি আছে আধুনিক শিক্ষা সরঞ্জামের। আসন সংখ্যার অনুপাতে নির্দিষ্ট শয্যার হাসপাতালের বাধ্যবাধকতা থাকলেও অনেকেরই সেদিকে মনোযোগ নেই। কোনো কোনো মেডিকেল কলেজে হাসপাতাল থাকলেও রোগী থাকছে না।
স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন উঠছে বেসরকারি এসব মেডিকেল কলেজের শিক্ষার মান নিয়ে। শিক্ষার মান প্রশ্নবিদ্ধ রেখেই বাড়ানো হচ্ছে শিক্ষার্থীদের ফি। আগামী শিক্ষাবর্ষের জন্য শিক্ষার্থীপ্রতি ফি এরই মধ্যে প্রায় ৩ লাখ টাকা বাড়ানো হয়েছে।
এর আগে ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষ থেকে বেসরকারি মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজে এমবিবিএস ও বিডিএস কোর্সে শিক্ষার্থীপ্রতি ১৯ লাখ ৯০ হাজার টাকা ফি নির্ধারণ করে দেয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। এতদিন পর্যন্ত এ হারেই শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ফি আদায় করত বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলো।
২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষ থেকে এ ফি বাড়িয়ে করা হয়েছে ২২ লাখ ৮০ হাজার টাকা। ফি বাড়িয়ে এরই মধ্যে প্রজ্ঞাপনও জারি করেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। এসব ফির মধ্যে ভর্তি ফি ধরা হয়েছে ১৬ লাখ ২০ হাজার টাকা। এর বাইরে ইন্টার্নি ফি নির্ধারণ করা হয়েছে ১ লাখ ৮০ হাজার ও টিউশন ফি ৪ লাখ ৮০ হাজার টাকা।
শিক্ষার মান না বাড়িয়ে ফি বৃদ্ধির এ সিদ্ধান্তকে অযৌক্তিক মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, অধিকাংশ বেসরকারি মেডিকেল কলেজে শিক্ষক থেকে শুরু করে শিক্ষা উপকরণ, ল্যাবরেটরি ও যন্ত্রপাতির সংকট রয়েছে। এসব সংকট দূর না করে ফি বৃদ্ধি মেডিকেল শিক্ষার মানকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে। সেই সঙ্গে ভালো মানের চিকিৎসক তৈরি ব্যাহত হবে।
এ অবস্থায় বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ফি বৃদ্ধির বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বলেন, গত কয়েক বছর বেসরকারি মেডিকেল কলেজের ভর্তি ও অন্যান্য ফি বাড়ানো হয়নি। কিন্তু বিভিন্ন শিক্ষা উপকরণ ও শিক্ষকদের বেতন বেড়েছে। এ কারণে ফি বাড়ানো হয়েছে।
সম্প্রতি সরেজমিন বেশকিছু বেসরকারি মেডিকেল কলেজ ঘুরে অব্যবস্থাপনার ছাপ দেখা গেছে। মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগরে ৫০ আসনবিশিষ্ট বিক্রমপুর ভূঁঁইয়া মেডিকেল কলেজে ২৫০ শয্যার হাসপাতাল থাকার কথা থাকলেও আছে ১০০ শয্যার। শয্যাগুলোর অধিকাংশই খালি। যদিও ৭০ শতাংশ শয্যায় ভর্তিকৃত রোগী থাকার বাধ্যবাধকতা আছে। রাজধানীর ধানমন্ডিতে নর্দান ইন্টারন্যাশনাল মেডিকেল কলেজটি প্রতিষ্ঠা হয় ২০০৬ সালে। অপ্রতুলতা নিয়ে চলছে এটিসহ আরো অনেক বেসরকারি মেডিকেল কলেজই।
বেসরকারি বেশকিছু মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজ পরিদর্শনে গত বছর একটি কমিটি গঠন করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। ওই কমিটির অন্যতম সদস্য সৈয়দ আবুল মকসুদ। বেসরকারি মেডিকেল কলেজের শিক্ষার মান না বাড়িয়ে ফি বাড়ানোকে অনৈতিক মন্তব্য করে তিনি বলেন, এটা করা হয়েছে নিছক ব্যবসায়িক স্বার্থে। এতে সার্টিফিকেট বিক্রি ছাড়া ভালো চিকিৎসক তৈরি হবে না। দেশে সার্টিফিকেটসর্বস্ব চিকিৎসকের দরকার নেই।
তবে যে পরিমাণ ফি বাড়ানো হয়েছে, তাকে যৌক্তিক বলেই দাবি করছেন বেসরকারি মেডিকেল কলেজের উদ্যোক্তারা। জানতে চাইলে বাংলাদেশ প্রাইভেট মেডিকেল কলেজ অ্যাসোসিয়েশনের অর্থ সম্পাদক ইকরাম হোসেন বিজু বলেন, শুধু ভর্তি ফি বাড়ানো হয়েছে। অন্যান্য ফি একই আছে। একজন শিক্ষার্থী ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই প্রতি মাসে ১৫-২০ হাজার টাকা টিউশন ফি গুনতে হচ্ছে। সে তুলনায় মেডিকেল কলেজে অনেক কম নেয়া হচ্ছে।
বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলোয় শিক্ষার মান নিয়ে বিভিন্ন সময় আলোচনা হয়েছে সরকারের শীর্ষপর্যায়েও। সর্বশেষ ১৮ মার্চ এক অনুষ্ঠানে বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলোয় শিক্ষার গুণগত মান বজায় রাখার তাগিদ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, বেসরকারি খাতেও মেডিকেল কলেজ হচ্ছে। সেখানে শিক্ষার মানটা যথাযথ আছে কিনা সেদিকে নজর দেয়া দরকার। কারিকুলামগুলো ঠিকমতো আছে কিনা সেদিকেও বিশেষভাবে নজর দেয়া প্রয়োজন।
বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ফি বৃদ্ধির পাশাপাশি বাড়ানো হয়েছে আসন সংখ্যাও। আগামী শিক্ষাবর্ষ থেকে বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলোয় ৫৫টি আসন বাড়িয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। যদিও এমনিতেই এখন অতিরিক্ত চিকিৎসক রয়েছে দেশে।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষণার তথ্য বলছে, ২০১৬ সালে ৬৩ হাজার ৩৯৫ জন চিকিৎসকের চাহিদার বিপরীতে জোগান ছিল ৭৪ হাজার ৯২৪ জনের। অর্থাৎ চাহিদার তুলনায় বছরটিতে উদ্বৃত্ত চিকিৎসক ছিলেন ১১ হাজার ৫২৯ জন। ২০২১ সালে ৬৭ হাজার ২৬৫ জনের চাহিদার বিপরীতে দেশে চিকিৎসকের জোগান দাঁড়াবে ৭৪ হাজার ৯২৪ জন।
এ হিসাবে ২০২১ সালেই চাহিদার অতিরিক্ত চিকিৎসকের সংখ্যা দাঁড়াবে ৫৩ হাজার ৪০২। এর পাঁচ বছর পর উদ্বৃত্ত চিকিৎসকের সংখ্যা বেড়ে হবে ১ লাখ ২২ হাজার ৯৬৫। ৭১ হাজার ৩৭০ জনের চাহিদার বিপরীতে ২০২৬ সালে দেশে চিকিৎসকের সংখ্যা দাঁড়াবে ১ লাখ ৯৪ হাজার ৩৩৫।
এর মধ্যেও যেসব মেডিকেল কলেজের আসন বাড়ানো হয়েছে, সেগুলোর একটি ইবনে সিনা মেডিকেল কলেজ। ৫১টির সঙ্গে আরো পাঁচটি বাড়িয়ে আসন সংখ্যা ৫৬টিতে উন্নীত করা হয়েছে মেডিকেল কলেজটিতে। সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজের আসন ১২০টির স্থলে বাড়িয়ে করা হয়েছে ১২৫টি।
এছাড়া মগবাজারের সিরাজুল ইসলাম মেডিকেল কলেজের আসন ৯৫টি থেকে বাড়িয়ে ১০০, শহীদ মনসুর আলী মেডিকেল কলেজে ১৩০টির স্থলে ১৪০, শাহবাগে ইব্রাহিম মেডিকেল কলেজে ১১০টির স্থলে ১১৫, মগবাজারের হলি ফ্যামিলি মেডিকেল কলেজে ১৩৫টির স্থলে ১৪০, বগুড়ার টিএমএসএস মেডিকেল কলেজে ১৩০টির স্থলে ১৩৫ ও সিলেটের পার্কভিউ মেডিকেল কলেজে ৫০টির স্থলে ৬০টি করা হয়েছে।
চিকিৎসা শিক্ষাবিদ ও ওয়ার্ল্ভ্র ফেডারেশন ফর মেডিকেল এডুকেশনের সিনিয়র অ্যাডভাইজার অধ্যাপক ডা. মোজাহেরুল হক বলেন, বাংলাদেশের বর্তমানে মেডিকেল শিক্ষার মান সর্বকালের সর্বনিম্নে। এ অবস্থায় আসন বৃদ্ধি মেডিকেল শিক্ষার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। শিক্ষক সংকট ও অন্যান্য সমস্যা সবার আগে দূর করতে হবে।
Posted ১২:৩০ অপরাহ্ণ | শুক্রবার, ৩০ মার্চ ২০১৮
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta