কক্সবাংলা ডটকম(১৬ জানুয়ারি) :: যুক্তরাষ্ট্র হঠাৎ কোনও সিদ্ধান্ত নেয় না। একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়াতেই বড় বড় সিদ্ধান্তগুলো নেয়। এই দীর্ঘ সূত্রতার সঙ্গে তাল মেলাতেই অসুবিধা হচ্ছে বাংলাদেশের। সাবেক রাষ্ট্রদূত, পররাষ্ট্র সচিব ও সংশ্লিষ্ট বিশ্লেষকদের সঙ্গে কথা বলে এমনটাই স্পষ্ট হয়েছে।
উদাহরণ হিসেবে বিশ্লেষকরা বলছেন, ২০০৭ সালে বাংলাদেশ নিয়ে জিএসপির অভিযোগের কথা। এর ছয় বছর পর ২০১৩ সালে রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির পরই জিএসপি সুবিধা বাতিল হয়।
র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞার বিষয়টিও রাতারাতি আসেনি। ২০০৮ সাল থেকে মার্কিন প্রশাসন র্যাবের কার্যকলাপ নিয়ে প্রশ্ন তুলে আসছে। ২০২০ সালের জুলাইতে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে তারা জানিয়েছিল, র্যাবকে তারা কোনও অর্থ সহায়তা দেবে না। এর প্রায় দেড় বছর পর ২০২১ সালের ডিসেম্বরে দেওয়া হয় নিষেধাজ্ঞা।
এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের এ ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন পক্ষ জড়িত থাকে। প্রক্রিয়াটি যৌক্তিক। সব পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বছরের পর বছর ধারাবাহিক আলোচনার পর একটি চূড়ান্ত রূপ সামনে আসে।’
তিনি বলেন, ‘দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় যুক্তরাষ্ট্র অনেক বিষয়ই উত্থাপন করে। অনেক দেশ কিছু বিষয় বিবেচনায় নেয়, আবার অনেক দেশ গুরুত্ব দেয় না।’
যুক্তরাষ্ট্র কী চায়?
দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের জটিল সমীকরণে চাওয়া-পাওয়া থাকে অনেক। এসবের পাশাপাশি অন্যান্য দেশে মূল্যবোধের বিষয়গুলোও দেখতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। যে তালিকায় আছে— গণতন্ত্র, সুষ্ঠু নির্বাচন, আইনের শাসন, বাক ও ধর্মীয় স্বাধীনতা, সন্ত্রাসবাদ দমন, মানবপাচার ও মাদক চোরাচালান প্রতিরোধ ইত্যাদি।
হুমায়ুন কবির বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের যে সিস্টেম, তাতে মূল্যবোধকে গুরুত্ব বেশি দেওয়া হয়। অনেকে উদাহরণ হিসেবে বলে, অগণতান্ত্রিক দেশ সৌদি আরবকে কিছু বলে না যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু বাস্তবে সৌদি আরবের সমালোচনা তাদের অনেক রিপোর্টে আছে।’
‘যুক্তরাষ্ট্র কোনও দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে সিঙ্গেল ফ্রেমে দেখে না’ এমনটা জানিয়ে সাবেক এ রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘সম্পর্কোন্নয়নের ক্ষেত্রে অনেকগুলো বিষয় তারা বিবেচনায় নেয়।তবে কয়েকটি বিষয়ে তাদের আপত্তি থাকে। যেমন, যদি কোনও দেশ চীনের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক রাখতে চায়, তা নিয়ে মার্কিন প্রশাসনের মাথাব্যথা নেই। কিন্তু কেউ যদি কৌশলগত সম্পর্ক রাখতে চায় বা চীনা মূল্যবোধ অনুসরণ করতে চায়, সেখানে তাদের আপত্তি আছে।’
নির্বাচনই বড় চ্যালেঞ্জ
২০০৮ সালের অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পর সবার মনোযোগ আকর্ষণ করে বাংলাদেশ। বিশ্বের অধিকাংশ মুসলিম দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা মসৃণ না হলেও বাংলাদেশের ওই নির্বাচন দেশের ভাবমূর্তি অনেকটা বাড়িয়ে দেয়।
কিছুটা ছন্দপতন হয় ২০১৪ সালে। ওই সময় বিরোধী দল নির্বাচনে অংশ না নেওয়ায় ১৫৩টি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ায় বাংলাদেশের সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে সংশয় প্রকাশ করে যুক্তরাষ্ট্র। ২০১৮ সালের নির্বাচনেও ৩০০ আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ প্রায় ২৬০ আসনে জয়লাভ করে। ওই নির্বাচনের ফলাফলও অনেক দেশকে বোঝাতে বেগ পেতে হয়েছিল বাংলাদেশকে।
হুমায়ুন কবির বলেন, ‘২০০৮ সালে আমি রাষ্ট্রদূত হিসেবে ওয়াশিংটনে ছিলাম। ওই বছরের নির্বাচনের পর বাংলাদেশের ভাবমূর্তি অনেক বেড়েছিল। একটি মুসলিম প্রধান দেশে গণতান্ত্রিক চর্চাকে যুক্তরাষ্ট্র অনেক মূল্য দেয়। এটাকে ভাবমূর্তির বড় উপাদান বিবেচনা করে তারা।’
সামনে কী হবে?
সাবেক পররাষ্ট্র সচিব মো. শহীদুল হক বলেন, ‘আমরা যখন তাদের সঙ্গে আলোচনায় বসেছি, তখন তারা গণতন্ত্র, মানবাধিকার, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিয়ে অভিযোগ, মানবপাচার, মাদক চোরাচালান, সন্ত্রাসবাদ দমনসহ বিভিন্ন বিষয় তুলেছে। আমাদের পক্ষ থেকে যথাযথ জবাব দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘এখন কীভাবে আরও আলোচনা ও সম্পৃক্ততা বাড়ানো যায় সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় এসেছে।’
‘যেকোনও সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া বেশ জটিল। বিভিন্ন পক্ষের একটি মিথষ্ক্রিয়ার মাধ্যমে এটা হয়।’ এমনটা জানিয়ে সাবেক পররাষ্ট্র সচিব বলেন, বাংলাদেশ সবসময়ই শক্তিধর দেশগুলোর সঙ্গে ভারসাম্যের নীতি অবলম্বন করে আসছে। তবে এই ভারসাম্য স্থির নয়। জাতীয় স্বার্থের প্রেক্ষাপটে বদলে যায়। এর মধ্যে নতুন ভারসাম্য নীতির প্রকাশ ঘটে।’
উল্লেখ্য, সম্প্রতি পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বলেছেন, ‘কোনও কোনও দেশ আমাদের ওপর অসন্তুষ্ট। আমরা এর কারণ খুঁজছি। তাদের অসন্তুষ্টি দূর করার চেষ্টা করছি।’
যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা শাস্তি নয়, সতর্কতার জন্য
র্যাবের সাবেক ও বর্তমান সাত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা দিয়ে বাংলাদেশকে শাস্তি নয় বরং সতর্ক করেছে বলে জানিয়েছেন কৃষিমন্ত্রী মো. আব্দুর রাজ্জাক। মার্কিন রাষ্ট্রদূত আর্ল আর. মিলারের সঙ্গে সাক্ষাতের পর তাকে উদ্ধৃত করে কৃষিমন্ত্রী এই কথা বলেন।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, রাষ্ট্রদূত মিলার আজ রোববার সচিবালয়ে কৃষিমন্ত্রীর সঙ্গে বিদায়ী সাক্ষাৎ করেন। তাদের আলোচনায় দুই দেশের কৃষি, অর্থনীতি, বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক নানা ইস্যুর সঙ্গে র্যাবের বর্তমান ও সাবেক সাত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞার বিষয়টিও উঠে আসে।
বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের এগ্রিকালচারাল অ্যাটাশে মেগান ফ্রান্সিস উপস্থিত ছিলেন। পরে কৃষিমন্ত্রী সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন।
তিনি বলেন, ‘অনেকক্ষণ ধরে কথা বলেছি। তারা বলেছে, যুক্তরাষ্ট্র সরকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তাদের উপর নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি বাংলাদেশকে শাস্তি দেওয়ার জন্য নয়, সতর্ক করার জন্য করা হয়েছে।’
নিষেধাজ্ঞার জন্য উত্তর কোরিয়া ও মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশকে একইভাবে বিবেচনা করায় হতাশা প্রকাশ করেন কৃষিমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘আমি বলেছি বিষয়টি খুবই দুঃখজনক। যুক্তরাষ্ট্র সরকার মানবাধিকারের বিষয়টিকে খুবই গুরুত্ব দিয়েছে।’
দুজনের বৈঠকে বাংলাদেশে জঙ্গিবাদে দমনের প্রসঙ্গ উঠে আসার ব্যাপারে কৃষিমন্ত্রী জানান, ‘বাংলাদেশ সফলভাবে জঙ্গি দমন করতে পেরেছে বলে তারা প্রশংসা করেছেন। তাদের ধারণা কিছু কিছু ক্ষেত্রে মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়েছে। সেটার উন্নতি হওয়া দরকার। তারা আশা করে এটা হবে।’
মন্ত্রী বলেন, ‘আমি তাদের বলেছি, আমাদের দেশে মানবাধিকার পরিস্থিতি ভালো। মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেনি। বাংলাদেশ কঠোরভাবে জঙ্গিবাদ মোকাবিলা করেছে। কিছু জায়গায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী হয়তো ভুল করেছে, সেজন্য ১৯০ জন র্যাব কর্মকর্তার শাস্তি হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে রাষ্ট্রদূত যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের সঙ্গে কথা বলবেন। যাতে দ্রুত এই নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়।’
নারায়ণগঞ্জে সিটি করপোরেশন নির্বাচন নিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হচ্ছে। আশা করি শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হবে। আমাদের সরকারের বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়ানোর জন্য আমরা মনে করি নির্বাচনটা সুন্দর ও সুষ্ঠু হওয়া উচিত।
তিনি বলেন, ‘নির্বাচনে যে ফল আসবে সেটা যদি আমাদের বিরুদ্ধেও যায়, তা আমরা গ্রহণ করব। একটা সিটি নির্বাচনে হেরে গেলে কিছু যায়-আসে না। কিন্তু জনগণের বিজয় হবে।’