শনিবার ২৭শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১৪ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

শিরোনাম

শনিবার ২৭শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

শিরোনাম

স্বপ্নভঙ্গ হওয়া কাতার বিশ্বকাপের অবকাঠামো নির্মাণকারী প্রবাসী শ্রমিকদের বর্তমান জীবন

শনিবার, ১৯ নভেম্বর ২০২২
193 ভিউ
স্বপ্নভঙ্গ হওয়া কাতার বিশ্বকাপের অবকাঠামো নির্মাণকারী প্রবাসী শ্রমিকদের বর্তমান জীবন

কাতার থেকে অন্ধ হয়ে ফিরেছেন বাবু শেখ। ছবি: এএফপি

কক্সবাংলা ডটকম(১৮ নভেম্বর) :: ২০২২ ফুটবল বিশ্বকাপের আয়োজক দেশ কাতার। গত কয়েক বছরে দেশটিতে হাজার হাজার কর্মী পাড়ি জমিয়েছেন। উদ্দেশ্য, বিশ্বকাপ উপলক্ষে কাতারের অবকাঠামো নির্মাণযজ্ঞে কাজ করা।

কাতারের মোট জনসংখ্যা ২৮ লাখ। তার প্রায় ৯০ শতাংশই অভিবাসী শ্রমিক। ভাগ্য ফেরাতে, একটু বেশি আয়ের আশায় এই কর্মীরা মরুর দেশটিতে পাড়ি জমান।

এই শ্রমিকদের সিংহভাগই যান ভারতীয় উপমহাদেশ ও ফিলিপাইন থেকে। বাকিরা যান কেনিয়া ও উগান্ডাসহ কয়েকটি আফ্রিকান দেশ থেকে।

বিশ্বকাপের জন্য বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণ করতে গিয়ে অনেকসময়ই অনেক বিদেশি শ্রমিক নিহত হয়েছেন, অনেকে আহত হয়েছেন, আবার অনেকে মজুরিও পাননি। এসব নিয়ে নানা সময়ে তুমুল সমালোচনার শিকার হয়েছে কাতার।

তবে কাতারও শ্রমিকদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা উন্নত করতে বড় সংস্কার করেছে। যেসব নিয়োগদাতা নিয়ম লঙ্ঘন করেছে, তাদের শাস্তির আওতায় আনার জন্যও সংস্কার করেছে।

যদিও মানবাধিকারকর্মীদের দাবি, পরিবর্তন খুব একটা আসেনি। যা-ও বা এসেছে, সেটাও অনেক দেরিতে।

বিশ্বকাপের পূর্বমুহূর্তে এএফপি বাংলাদেশ, ভারতের কয়েকজন প্রবাসী কর্মীর সঙ্গে কথা বলেছে। জানতে চেয়েছে তাদের অভিজ্ঞতা, তাদের নিজের ও পরিবারের গল্প।

চলুন জেনে নেওয়া যাক এই প্রবাসী শ্রমিকদের গল্প।

ঋণের বোঝায় জর্জর

দোহা-র খলিফা ইন্টারন্যাশনাল স্টেডিয়ামে হবে বিশ্বকাপের আটটি ম্যাচ। এই চোখ ধাঁধানো স্টেডিয়ামটি নির্মাণে অবদান আছে বাংলাদেশি রাজমিস্ত্রী আপন মিরেরও।

কিন্তু কাতারে চার বছর কাটানো পরই তাকে দেশে ফিরতে হয়। আর এই চার বছরের কাজের বেতনও আপন পাননি।

‘স্টেডিয়ামটা কী সুন্দর!’ এএফপিকে বলেন আপন। ‘কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, এই বিশাল সুন্দর নির্মাণের অংশ হয়েও আমরা বেতন পাইনি। আমার ফোরম্যান আমাদের টাইমশিট কেড়ে নিয়ে আমাদের সমস্ত টাকা তুলে নিয়ে পালিয়ে গেছে।’

কাতারে গিয়েও ভাগ্য ফেরাতে পারেননি আপন মির। প্রতারিত হয়ে দেশে ফিরতে হয়েছে শূন্য হাতে। ছবি: এএফপি

২০১৬ সালে বাংলাদেশের পশ্চিমাঞ্চলের শ্রীপুর থেকে কাতারে পাড়ি জমান আপন, ভাগ্যের চাকা ঘোরানোর জন্য যথেষ্ট অর্থোপার্জনের আশায়।

বাবা ও অন্যান্য আত্মীয়দের কাছ থেকে ধার করে এবং নিজের সঞ্চয়ের টাকায় কাতার যাওয়ার খরচ জুগিয়েছিলেন তিনি।

আপন বিশ্বকাপের সাতটি স্টেডিয়ামে একটি ভারতীয় নির্মাণ সংস্থার হয়ে কাজ করেন। কিন্তু বৈধ ওয়ার্ক পারমিট না থাকায় তাকে ২০২০ সালে গ্রেপ্তার করে দেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

প্রায় ৭ লাখ টাকা খরচ করে কাতার গিয়েছিলেন এই ৩৩ বছর বয়সি যুবক।

‘আর বাড়ি ফিরেছি ২৫ রিয়াল [বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৮০০ টাকা] নিয়ে। আমার জীবনে এ-ই হলো কাতারের অবদান,’ বাড়ির সামনে একটি চায়ের দোকানে দাঁড়িয়ে কথাগুলো বলছিলেন দুই সন্তানের বাবা আপন। ‘স্বপ্ন ছিল একটা ভাল বাড়ি বানাব, একটু ভালো জীবনযাপন করব, আমার সন্তানদের ভালো স্কুলে পাঠাব। কিন্তু কোনো আশাই পূরণ হয়নি। আমার কাঁধে একের পর এক ঋণের বোঝা নেমে এসেছে। এই বোঝাই বয়ে চলেছি।’

আপন জানান, ভোরে বাসে করে তাদেরকে নির্মাণস্থলে নিয়ে যাওয়া হতো। তারপর ১০ ঘণ্টা প্রচণ্ড গরমে কাজ করতে হতো।

টাকা না থাকলে তাকে দিনের পর দিন না খেয়ে থাকতে হতো। এমনকি বাসাভাড়া দিতে না পারলে তাকে মাঝেমধ্যে সৈকতেও রাত কাটাতে হতো।

‘কাজ করার সময় প্রতিদিন আমরা মাথা থেকে পায়ের পাতা পর্যন্ত ঘামতাম,’ তিনি বলেন।

‘আমাদের শরীর রক্ত ঘাম করে স্টেডিয়াম বানিয়েছি। কিন্তু টাকা আর সম্মান ছাড়াই আমাদের দেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।’

স্বপ্ন সত্যি হলো

কাতারসহ অন্যান্য উপসাগরীয় দেশগুলোতে অজস্র শ্রমিক পাড়ি জমান। এসব দেশে তারা যান নিজ দেশে যত আয় করতে পারবেন, তার চেয়ে বেশি আয় করতে। কারও কারও এ স্বপ্ন সত্যি হয়।

আবু ইউসুফ (ছদ্মনাম) ৬ লাখ ৮০ হাজার টাকা খরচ করে কাতার গিয়েছিলেন। সেখানে তিনি নির্মাণ শ্রমিক ও ওয়েল্ডার হিসাবে কাজ করেন। এছাড়া একটি স্টেডিয়ামের মধ্যে এক ফায়ার স্টেশনেও ড্রাইভারের কাজ করেন কয়েক মাস।

ইউসুফ মাসে প্রায় ৭০০ ডলার মজুরি পেতেন। এই বেতনে তিনি দারুণ খুশি ছিলেন।

‘ওরা ভালো লোক। অনেক কাতারি আমাকে সাহায্য করেছে,’ আবু ইউসুফ বলেন।

একজন ঠিকাদার ইউসুফের মজুরির একাংশ চুরি করলেও এই ৩২ বছর বয়সি যুবক কাতারি কর্তৃপক্ষের প্রশংসাই করলেন।

গত মাসে তিনি সদরপুরে নিজের বাড়িতে ফিরে আসেন। এখানেই চরম দারিদ্র্যের মধ্যে তার মা তাকে একাই লালনপালন করেছেন।

কাতারের উপার্জন দিয়ে ইউসুফ একটি দোতলা বাড়ি বানিয়েছেন। একটি নতুন মোটরবাইকও কিনেছেন। মা এবং তার অন্ধ ভাইয়ের পরিবারের খরচও বহন করছেন ইউসুফ।

পাঁড় আর্জেন্টিনা সমর্থক ইউসুফের খুব ইচ্ছা ছিল আল-বায়েত স্টেডিয়ামে বসে বিশ্বকাপের একটি ম্যাচ দেখার। এই স্টেডিয়ামেই তিনি ওয়েল্ডার হিসেবে কাজ করতেন।

তিনি বলেন, ‘স্টেডিয়ামটা সুন্দর। যেসব শ্রমিক স্টেডিয়ামটা বানিয়েছে তাদের মধ্যে আমিও ছিলাম, ভাবতেই গর্ব লাগে। ওখানে বসে যদি একটা ম্যাচ দেখতে পারতাম!’

কাতারে আরও ১০ বছর কাজ করতে পারবেন বলে আশা করছেন ইউসুফ। আগামী মাসেই বিশ্বকাপের আয়োজক দেশে ফিরে যাওয়ার পরিকল্পনা আছে তার।

তিনি জানান, ‘আমার সাথে ভালো আচরণ করা হয়েছিল।’

কাতারের উপহার: অন্ধত্ব

দোহার কাছে একটি নির্মাণ সাইটে বাংলাদেশি শ্রমিক বাবু শেখ ১৪ ফুট ওপর থেকে পড়ে গেলে তার মাথার খুলি ফেটে যায়।

চার মাস হাসপাতালে কোমায় ছিলেন বাবু। কোমা থেকে ফেরার পর দেখেন তিনি অন্ধ হয়ে গেছেন।

বাবু বলেন, ‘জ্ঞান ফিরে পাওয়ার পর আমি কিছুই দেখতে পাচ্ছিলাম না। আমার ভাইকে জিজ্ঞেস করলাম জায়গাটা অন্ধকার কি না। ও আমাকে বলল, আলো জ্বলছে। বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না যে আমি দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলেছি।

‘চারটা মাস কীভাবে কেটে গেল, এসব কীভাবে ঘটল—সে সম্পর্কে আমার কোনো ধারণাই ছিল না।’

১৮ মাস পর হাসপাতাল ছাড়তে পারেন বাবু। হাসপাতাল বিল মেটাতে হয় তার পরিবারকে।

কাতার থেকে অন্ধ হয়ে ফিরেছেন বাবু শেখ। ছবি: এএফপি

কাতারি কর্তৃপক্ষ তার নিয়োগকর্তার বিরুদ্ধে মামলা করে। কিন্তু মামলাটি খারিজ হয়ে যায়। আর বাবুও কোনো ক্ষতিপূরণ পাননি।

বাবুর এখন সময় কাটে তার বাড়ির সামনের উঠানে চুপচাপ বসে থেকে। মাঝে মাঝে তার ছেলে তাকে বাড়ির কাছের বাজারে কিংবা শেষ বিকেলে চায়ের স্টলে নিয়ে যায়। সেখানে তিনি ছোটবেলার বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেন।

বাবু বলেন, ‘আমি এভাবে বাঁচতে চাই না। আমি কাজ করতে চাই। পরিবার, ছেলে আর স্ত্রীর ভবিষ্যতের চিন্তায় সারা রাত আমার ঘুম হয় না।’

বাবুর ছেলের বয়স এখন পাঁচ। তিনি কাতারে থাকার সময় তার জন্ম। ছেলেকে একবারও দেখার ভাগ্য বাবুর হয়নি।

‘আমি শুধু আমার দৃষ্টিশক্তি ফিরে পেতে চাই। আমার ছেলেকে দেখতে চাই। ওর গায়ের রং কি আমার মতো? ও কি দেখতে আমার মতো?’

বাবার লাশ কাঁধে দেশে ফেরা

শ্রাবণ কাল্লাড়ি ও তার বাবা রমেশ কাল্লাড়ি ভারতের নাগরিক। দুজনে একই কোম্পানিরতে কাজ করতেন। কোম্পানিটি বিশ্বকাপ স্টেডিয়ামমুখী রাস্তা নির্মাণ করত।

কিন্তু শ্রাবণ ভারতে ফিরেছেন একা। লম্বা শিফটে কাজ করার পর একদিন তার বাবার ৫০ বছর বয়সি শরীর আর নিতে পারেনি। তারা যে ক্যাম্পে থাকতেন সেখানেই মারা যান রমেশ।

শ্রাবণ বলেন, ‘বাবা যেদিন মারা যান, সেদিন কাজ করার সময় তার বুকে ব্যথা শুরু হয়।’

‘আমরা তাকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলাম…ডাক্তারদের বারবার বলেছিলাম তাকে বাঁচানোর চেষ্টা করতে,’ ধরা গলায় জানান ২৯ বছর বয়সি এই যুবক।

দীর্ঘ কর্মঘণ্টা ও কম বেতনের ওভারটাইমের বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, কর্মক্ষেত্রের পরিবেশ ‘মোটেও ভালো ছিল না।’

তার বাবা রমেশ ছিলেন ড্রাইভার। রমেশ ভোর ৩টায় কাজে যেতেন, ফিরতেন রাত ১১টায়।

শ্রাবণ জানান, ক্যাম্পের একটি কক্ষে তারা ছয় থেকে আটজন থাকতেন। অথচ ওই কক্ষে চারজন মানুষেরও ঠিকমতো বসার জায়গা ছিল না।

তিনি বলেন, ‘চরম আবহাওয়ায় কাজ করতে হতো আমাদের। আর আমাদের যে খাবার দেওয়া হতো, তা-ও ভালো ছিল না।’

একটু উন্নত জীবনের আশায় কাতারে গিয়েছিলেন বাবা-ছেলে।

কিন্তু বাবার মৃতদেহ নিয়ে তেলেঙ্গানা রাজ্যে ফেরার পর শ্রাবণ আর কাতার যাননি।

কোম্পানির পক্ষ থেকে ক্ষতিপূরণ হিসেবে মাত্র এক মাসের বেতন পান তিনি।

একটি অসমাপ্ত বাড়ি এখন তার পরিবারের অপূর্ণ স্বপ্ন ও আর্থিক পঙ্গুত্বের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

বাবার মৃত্যুর পরের ছয় বছরে শ্রাবণ উপসাগরীয় দেশগুলোতে মারা যাওয়া ব্যক্তিদের লাশ ফিরিয়ে আনতে তাদের পরিবারকে সাহায্য করেছেন। কিন্তু তার নিজেরই এখন উপার্জন প্রায় বন্ধ।

তিনি বলেন, ‘জীবিত থাকলে আমরা কোম্পানির, আর মরে গেলে ওদের নই। আমরা ওদের বিশ্বাস করেছিলাম। সে কারণেই ঘর ছেড়ে ওদের জন্য কাজ করতে গিয়েছিলাম। কিন্তু ওরা আমাদের বিশ্বাস রাখেনি।’

193 ভিউ

Posted ১:৩০ পূর্বাহ্ণ | শনিবার, ১৯ নভেম্বর ২০২২

coxbangla.com |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

এ বিভাগের আরও খবর

Editor & Publisher

Chanchal Dash Gupta

Member : coxsbazar press club & coxsbazar journalist union (cbuj)
cell: 01558-310550 or 01736-202922
mail: chanchalcox@gmail.com
Office : coxsbazar press club building(1st floor),shaheed sharanee road,cox’sbazar municipalty
coxsbazar-4700
Bangladesh
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
বাংলাদেশের সকল পত্রিকা সাইট
Bangla Newspaper

ABOUT US :

coxbangla.com is a dedicated 24x7 news website which is published 2010 in coxbazar city. coxbangla is the news plus right and true information. Be informed be truthful are the only right way. Because you have the right. So coxbangla always offiers the latest news coxbazar, national and international news on current offers, politics, economic, entertainment, sports, health, science, defence & technology, space, history, lifestyle, tourism, food etc in Bengali.

design and development by : webnewsdesign.com