কক্সবাংলা ডটকম(৬ নভেম্বর) :: সাম্প্রদায়িক হামলাকারীদের বিশেষ ক্ষমতা আইন ও সন্ত্রাস দমনের আওতায় এনে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে বিচারের দাবি জানিয়েছেন বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত।
শনিবার দুপুরে আন্দরকিল্লা চত্বরে অনুষ্ঠিত গণ–অনশন ও বিক্ষোভ মিছিলে প্রধান অতিথির বক্তব্য দেন রানা দাশগুপ্ত। সেখানে তিনি এসব কথা বলেন। পূজা উদ্যাপন পরিষদের ৪ নভেম্বর শ্যামাপূজায় দীপাবলি উৎসব বর্জনের ডাক ও কালো কাপড়ে মুখ ঢেকে মন্দিরে অবস্থান কর্মসূচির সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ।
রানা দাশগুপ্ত শারদীয় দুর্গোৎসব চলাকালীন দেশের বিভিন্ন জেলায় মন্দির ও পূজামণ্ডপে হামলার ঘটনায় নিহতদের পরিবারের একজন সদস্যকে সরকারি চাকরি, ২০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দানসহ ১১ দফা দাবি তুলে ধরেন। দুর্গাপূজায় মণ্ডপ ও মন্দিরে প্রতিমা ভাঙচুর, ঘরবাড়িতে লুটপাট এবং হত্যার প্রতিবাদে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ সারা দেশে এ কর্মসূচির ডাক দেয়।
সকাল ছয়টা থেকে আন্দরকিল্লা চত্বরে গণ–অনশন কর্মসূচি পালন করা হয়। খণ্ড খণ্ড মিছিলসহ বিভিন্ন ব্যানার–ফেস্টুন নিয়ে তাঁরা গণ–অনশনে যোগ দেন। এ সময় আশপাশের সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।
দাবিনামা উত্থাপন করে রানা দাশগুপ্ত বলেন, সাম্প্রদায়িক সহিংসতা তদন্তে সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত একজন বিচারপতির নেতৃত্বে বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করতে হবে। সাম্প্রদায়িক হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত সব মন্দির, বাড়িঘর পুনর্নির্মাণের পাশাপাশি আহতদের চিকিৎসা ও নিহতদের পরিবারকে ২০ লাখ টাকার ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের যদি গাফিলতি থাকে, তা তদন্ত করে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে।
রানা দাশগুপ্ত আরও বলেন, যারা উসকানি দিচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে দ্রুত আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানাচ্ছি। পাশাপাশি সাম্প্রদায়িক হামলা ও সহিংসতার সময় যেসব জনপ্রতিনিধি এগিয়ে আসেননি, তাঁদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রীর প্রতি তিনি আহ্বান জানান। এ ছাড়া বাহাত্তরের সংবিধান পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে দেওয়া প্রতিশ্রুত সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন প্রণয়ন, সংখ্যালঘু কমিশন গঠনের দ্রুত বাস্তবায়ন দাবি করেন এই নেতা।
সমাবেশ থেকে ফেব্রুয়ারিতে এসব দাবির সমর্থনে চলো চলো ঢাকা চলো শীর্ষক প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় অভিমুখে পদযাত্রার কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়।
পরিষদের নেতা ইন্দু নন্দন দত্ত বলেন, ৭৪ বছরে এই প্রথম সংখ্যালঘুরা রানা দাশগুপ্তের নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। এই ঐক্য এগিয়ে নিয়ে অধিকার আদায় করতে হবে। নির্যাতনের বিচার করতে হবে।
ইসকনের চট্টগ্রাম বিভাগীয় সভাপতি চিন্ময় দাস ব্রহ্মচারী বলেন, গণতন্ত্র ও মানবতা আজ বিপন্ন। বিচারহীনতার কারণে সাম্প্রদায়িক ঘটনা মাথাচাড়া দিয়েছে। অতীতের সহিংসতার বিচার এখনো হয়নি।
রণজিত দে বলেন, দেশের সব উপজেলায় মডেল মসজিদের মতো হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টধর্মাবলম্বীদের জন্য উপাসনালয় করতে হবে।
চট্টগ্রাম জেলা পূজা উদ্যাপন পরিষদের সভাপতি শ্যামল পালিত বলেন, ‘সাম্প্রদায়িক হামলার সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীর ঘোষিত জিরো টলারেন্স নীতির বাস্তবায়ন চাই আমরা।’
সমাবেশে আরও বক্তব্য দেন ওয়ার্ড কাউন্সিলর জহরলাল হাজারী, পরিষদ নেতা চন্দন তালুকদার প্রমুখ। সমাবেশ শেষে বিশাল এক বিক্ষোভ মিছিল নগরের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে।
২৭ জেলায় সাম্প্রদায়িক হামলা হয়েছে: রানা দাশগুপ্ত
সাম্প্রতিক হামলার তথ্য তুলে ধরে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ বলছে, গত ১৩ অক্টোবর থেকে ১ নভেম্বর পর্যন্ত দেশের ২৭টি জেলায় সাম্প্রদায়িক হামলা হয়েছে। এ সময় ১১৭ মন্দির-পূজামণ্ডপ ভাঙচুর হয়েছে, ৩০১টি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও বসতবাড়ি হামলা-লুটপাটের শিকার হয়েছে এবং এ সময়ে ৯ জন নিহত হয়েছেন।
শনিবার জাতীয় প্রেসক্লাবে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত এই তথ্য তুলে ধরেন।
সংবাদ সম্মেলনে পরিষদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনের বিবৃতিতে তারা ‘ভীষণভাবে ক্ষুব্ধ ও ব্যথিত’। এই বিবৃতির প্রতিবাদে ১২ নভেম্বর শুক্রবার সারা দেশে তারা ‘ধিক্কার মিছিল’ করবে।
সম্প্রতি পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিবৃতিতে বলেছেন, সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় যে দুজন হিন্দু মারা গেছেন, তাঁদের একজনের স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে এবং অন্যজন পানিতে ডুবে মারা গেছেন। কেউ ধর্ষণের শিকার হননি।
রানা দাশগুপ্ত বলেন, ‘পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্য এক নয়। এখান থেকেই আমরা মনে করি, সরকারের অভ্যন্তরে দুটি ধারণা কাজ করছে। একটি হচ্ছে সাম্প্রদায়িক হামলাকে লঘু করে দেখানো এবং তুচ্ছতাচ্ছিল্যের সঙ্গে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ব্যবহার করা। অন্যটি ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্য। যেখানে তিনি বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার কথা স্বীকার করেছেন।
তিনি অপশক্তিকেই দায়ী করেছেন।’ রানা দাশগুপ্ত বলেন, গত ১৫ অক্টোবর চৌমুহনীতে ইসকন মন্দিরের ভক্ত যতন সাহা মন্দির রক্ষা করতে গিয়ে সন্ত্রাসীদের ধারালো অস্ত্রের আঘাতে মৃত্যুবরণ করেন। একই দিন ইসকন মন্দিরের সন্ন্যাসী প্রান্ত দাসকে কুপিয়ে পুকুরে ফেলে দেয় সন্ত্রাসীরা। পরদিন তাঁর মরদেহ পুকুরে ভেসে ওঠে। তাঁর মাথা ও শরীরে কোপের দাগ ছিল।
রানা দাশগুপ্ত বলেন, ‘আইনমন্ত্রীর ইউটার্ন আমাদের হতবাক ও বিস্মিত করেছে। সম্প্রতি এক সেমিনারে আইনমন্ত্রী বলেছিলেন, সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন ও জাতীয় সংখ্যালঘু কমিশন আইন প্রণয়ন করা হচ্ছে এবং দ্রুততম সময়ের মধ্যে তা সংসদে উত্থাপন করা হবে। এর চার দিন পর আইনমন্ত্রী বলেন, সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন নয়, সাক্ষী সুরক্ষা আইনের কথা বলেছেন। আর প্রধানমন্ত্রী বিবেচনা করলে সংখ্যালঘু কমিশন গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হবে। বিষয়টিকে দ্বিচারিতা।’
ইসকন বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক চারু চন্দ্র দাস ব্রহ্মচারী বলেন, ‘পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য আমাদের হতাশ করেছে। সাম্প্রদায়িক হামলার বিচার পাওয়া নিয়ে আমাদের আশার আলোতে জল ঢেলে দিয়েছেন তিনি।’ হামলার বিচার না পাওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন তিনি।
সংবাদ সম্মেলনের সভাপতিত্ব করেন হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ঊষাতন তালুকদার। তিনি বলেন, বাংলাদেশ বহু জাতি ও বহু ভাষার দেশ, এটা মেনে নিতে হবে। সাম্প্রদায়িক সব মামলার বিচার করে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় সরকারের দ্বিচারিতা দেখছেন বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
সংগঠনটির আরেক ভারপ্রাপ্ত সভাপতি নিম চন্দ্র ভৌমিক বলেন, দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে সাম্প্রদায়িক হামলার বিচার করতে হবে।
সংবাদ সম্মেলনে সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন প্রণয়ন, জাতীয় সংখ্যালঘু কমিশন গঠন, বৈষম্য বিলোপ আইন প্রণয়ন, অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইন, পার্বত্য শান্তিচুক্তি ও পার্বত্য ভূমি কমিশনের বাস্তবায়ন এবং সমতলে আদিবাসীদের জন্য ভূমি কমিশন গঠনের দাবি জানানো হয়।