কক্সবাংলা ডটকম(২৭ মে) :: ভারতে ১৯৮৪ সালের পর প্রথমবারের মতো সুস্পষ্ট সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ ক্ষমতা গ্রহণের পর প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নরেন্দ্র মোদি মাত্র তিন বছর সম্পন্ন করলেন।
মোদির তিন বছরে উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো পাকিস্তান ও মিয়ানমারে বিদ্রোহী ঘাঁটিগুলোর ওপর প্রবল বিক্রমে ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’ হানার মহাসাফল্য; নাগরিক, ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ, আমলা-সবাইকে ঘোরে ফেলে দেয়া নোট বাতিলকরণের মতো নজিরবিহীন আর্থিক পদক্ষেপ; এবং ব্যাপক বিতর্ক সৃষ্টিকারী আরো কিছু পদক্ষেপ।
এই তিন বছরে মোদি বিজেপির একক মাস্কট হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছেন, রাজ্য পর্যায়ে এবং এমনকি পৌর নির্বাচনে জয়ের জন্যও তার নাম ব্যবহার করতে হয়।
অনেক সময় তা কাজও করে। যেমন আসাম ও উত্তর প্রদেশে হয়েছে। তবে বিহার, দিল্লি, পাঞ্জাব ও পশ্চিমবঙ্গের মতো আরো অনেক জায়গায় হয়নি।
প্রধান সহকারী অমিত শাহের পরিচালনায় থাকা দল নিয়ে তার নেতৃত্বে বিজেপি অরুনাচল প্রদেশ, মনিপুর এবং গোয়ায় ক্ষমতায় যেতে পেরেছে। তবে তা হয়েছে পক্ষ ত্যাগ এবং কেনাবেচার মাধ্যমে। এসব রাজ্যে বিজেপি একক বৃহত্তর দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে ব্যর্থ হওয়া সত্ত্বেও ক্ষমতাসীন জোট সৃষ্টি করা সম্ভব হয়েছে।
রাজস্তান ও মধ্যপ্রদেশের মতো রাজ্য আওতাভুক্ত থাকায় ভারতীয় রাজনৈতিক দৃশ্যপটে প্রধান দল হিসেবে কংগ্রেসকে হটিয়ে বিজেপির অভ্যুদয় ঘটেছে।
তবে মোদি তার গোলপোস্ট পরিবর্তন করেছেন। ভোটারদেরকে আকাশের চাঁদ এনে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়ার মাধ্যমে যে বিপুল প্রত্যাশার সৃষ্টি করেছিলেন, সেটার ভারেই তাকে এমনটা করতে হয়েছে।
এখন তিনি বলছেন, ‘আচ্ছে দিন’ (সুসময়) আসতে আরো ‘কয়েকটা বছর’ দরকার। তিনি তার সময় কাঠামো ২০২২ সাল পর্যন্ত টেনে নিচ্ছেন। ওই সময়টাতে ভারত তার স্বাধীনতার ৭৫ বছর পূর্তি পালন করবে।
ফলে ভারতীয়দেরকে অপূর্ণ প্রতিশ্রুতি নিয়ে বেঁচে থাকতে হবে এবং ২০১৯ সালে কিংবা মোদি যদি প্রতিপক্ষকে অপ্রস্তুত করে নির্বাচন এগিয়ে আনেন তবে ২০১৮ সালে মোদি এবং বিজেপিকেই ভোট দিতে হবে।
মোদি ‘মেড ইন ইন্ডিয়া’র প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু চীনের সাথে তার সরকারের ক্রমাবনতিশীল সম্পর্কের কারণে ভারত উচ্চতর চীনা বিনিয়োগ প্রত্যাখ্যান করেছে। চীন বিশেষজ্ঞ জবিন জ্যাকবের মতে, ‘মেইড ইন ইন্ডিয়া’ স্লোগানকে সফল করার সামর্থ্য মাত্র একটি দেশেরই আছে, আর সেটা হলো চীন।
আবার মোদি ভারতকে যতটা যুক্তরাষ্ট্রের কাছাকাছি নিয়ে এসেছেন, ততটা আর কোনো ভারতীয় নেতা করেননি।
মোদির এই বিশ্বাসের পুরস্কার হিসেবে ট্রাম্প জোরালোভাবে ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতি ঘোষণা করেছেন, এইচ১বি ভিসার সংখ্যা কমিয়ে দিয়েছেন। এর অর্থ হলো ইনফোসিসের মতো কোম্পানিগুলোকে ভারতে ২০ হাজার চাকরি কমাতে হয়েছে, আমেরিকায় ব্যবসা বহাল রাখতে ওই দেশে আমেরিকানদের জন্য ১০ হাজার চাকরি সৃষ্টি করতে হয়েছে।
তাহলে কেন কয়েক বছর আগে পর্যন্ত ভারতের প্রধান সামরিক সম্ভার রফতানিকারক হিসেবে থাকা রাশিয়ার স্থানে যুক্তরাষ্ট্রকে অনুমোদন করা হলো? কেন আঙ্কেল শ্যামের ‘এশিয়া ভরকেন্দ্রের’ জন্য জোট বাধলো? উইঘুর, তিব্বতি, ফালাঙগুন এবং তিব্বতবিরোধী ভিন্নমতালম্বীদের প্লাটফর্ম সৃষ্টির জন্য কেন চীনকে খোঁচানো হলো?
ট্রাম্প যখন কাশ্মির প্রশ্নে জাতিসঙ্ঘ ও মার্কিন মধ্যস্থতার সুপারিশ করছেন, তখনো আমেরিকাকে আরো প্রবলভাবে গ্রহণ করার মাধ্যমে ভারত কী পেল, সে জবাব তাকে দিতে হবে।
নেহরুর (যার উদারবাদ মোদি অপছন্দ করেন) মতো মোদিও জাতির পররাষ্ট্রনীতির প্রতি বেশ আগ্রহী। আর এর মাধ্যমে তিনি মেধাবী পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে পররাষ্ট্র দফতরের টুইটার ম্যানেজারে নামিয়ে এনেছেন।
মোদির কিছু সাফল্য আছে। ইসরাইলের আরো ঘনিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও তিনি মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলোর সাথে আরো ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক সৃষ্টি করেছেন। জাপান ও আসিয়ানের সাথেও আরো গভীর সম্পর্ক সৃষ্টি করেছেন।
বাংলাদেশের সাথে সম্পর্ককে তিনি নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছেন (এটা ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দাবি) প্রধানমন্ত্রী হাসিনা বেপরোয়া চেষ্টা করা সত্ত্বেও বাংলাদেশ এখনো অভিন্ন নদীর পানির হিস্যা পায়নি। আর হাসিনা যদি ক্ষমতায় ফিরতে ব্যর্থ হন, তবে দিল্লি ও ঢাকার দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক ভবিষ্যতে কত দূর যাবে, তা নিয়ে খোলামেলা প্রশ্নের সৃষ্টি হবে।
মোদি ইসলামাবাদে অপ্রত্যাশিত সফর করা সত্ত্বেও পাকিস্তানের সাথে সম্পর্ক সর্বকালের সর্বনিম্ন অবস্থায় নেমে গেছে। আবার কাশ্মিরে ইন্তিফাদার সৃষ্টি হয়েছে। পাকিস্তানের সাথে কথা না বলে কাশ্মিরের উত্তাপ সামাল দেয়ার উপায় দিল্লি এখনো পায়নি। অন্যদিকে মোদির কট্টর সমর্থকরা পর্যন্ত কাশ্মিরের অবনতিশীল পরিস্থিতি সংযত করা যাবে কিনা তা নিয়ে সন্দীহান।
বিজেপি-আরএসএস-ভিএইচপি’র কট্টরপন্থীরা ভারতকে ‘হিন্দু রাষ্ট্রে’ পরিণত করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করায় (এবং মোদি তা করার অনুমোদন করছেন) মুসলিমরা আগের চেয়ে অনেক বেশি নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে।
অল ইন্ডিয়া রেডিওতে তার বিশেষ অনুষ্ঠান ‘মান কি বাত’ (হৃদয়ের কথা)-এ গরুর গোশত খাওয়া কিংবা গরু ব্যবসার জন্য অভিযুক্ত মুসলিম ও দলিতদের হত্যা করা নিয়ে নীরব থাকেন তিনি।
মোদি আরো চাকরির প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন (তার সরকার চাকরি সৃষ্টিতে যে ব্যর্থ হয়েছে, তা নিয়ে ইতোমধ্যেই ব্যাপক আলোচনা হয়েছে)। কিন্তু উত্তর প্রদেশে তার সহকর্মী, মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ সেখানকার দু’টি গুরুত্বপূর্ণ শিল্প (গোশত ও ট্যানারি শিল্প) পুরোপুরি বন্ধ করে দিয়েছেন।
দাঙ্গা ও সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় কূটকৌশলী এই গুরুত্বহীন লোকটিকে কে অধিকার দিল আমাদেরকে ঐতিহ্যবাহী লখনৌয়ের ঝালোটিয়াকাবাব থেকে আমাদের বঞ্চিত করার এবং সেই মহান নবাব ওয়াজিদ আলী শাহের আমল থেকে চলে আসা নগরীর উদার মূল্যবোধকে ধ্বংস করার?
কিন্তু আপনি এ ধরনের নেতা নির্বাচিত করলে তার কাছ থেকে ২১তম শতকে প্রয়োজনীয় চাকরি ও শিক্ষা সৃষ্টি করার প্রত্যাশা করতে পারবেন না। তার কাছ থেকে আপনি বরং ‘রাম রাজ্য’ প্রতিষ্ঠার প্রত্যাশাটি করতে পারেন।
মোদির প্রকৃত অবদান সম্ভবত অনধিকারমূলক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার, যেখানে মোগল-ব্রিটিশ রাজের চেয়েও বেশি ক্ষমতা তার হাতে পঞ্জিভূত হচ্ছে। অথচ তিনি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন সহযোগিতামূলক ফেডারেলব্যবস্থার।
স্বচ্ছতার অভাব আরেকটি বৈশিষ্ট্য। মোদি সংবাদ সম্মেলন ঘৃণা করেন, জনগণের সামনে সরাসরি কথা বলার জন্য সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার করার একমুখী সড়ক পছন্দ করেন। সেটা একবার ফুটো হয়ে গিয়েছিল পৃষ্ঠপোষক এক টিভিকে দীর্ঘ সাক্ষাৎকার দেয়ার সময়।
বন্ধু ও ফেলো অক্সফোর্ড মেট সাগরিকা ঘোষ তার টাইমস অব ইন্ডিয়ার কলামে ক্রমবর্ধমান স্বৈরতান্ত্রিক প্রবণতাকে চ্যালেঞ্জ করতে উদারমনা ভারতীয়দের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়ে তাদেরকে জরুরি অবস্থার সময় ভারতীয় মধ্যবিত্ত সমাজের ঘুরে দাঁড়ানোর সংগ্রামের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন।
কেউ হয়তো এটাকে অরন্যে রোদন ভাবতে পারেন। কারণ মধ্যবিত্ত শ্রেণী প্রকটভাবে সাম্প্রদায়িক এবং গণতান্ত্রিক অধিকারের বিরুদ্ধে। সামাজিক মাধ্যমে বিষয়টি ভয়াবহভাবে ধরা পড়ে।
‘রাম রাজ্যের’ ভ্রান্ত দর্শন বেশির ভাগ বিরূপ স্থানে জয়ের পতাকা উড়িয়েছে এবং ২০১৯ সালের নির্বাচনে বিজেপিকে ফের ক্ষমতায় আনতে পারে। উত্তর প্রদেশের বিপুল বিজয় গেরুয়া ব্রিগেডকে অস্ত্র তুলে দিয়েছে।
এর মাত্রাটি বোঝা যায় নাগা নেতা মুইভার দাবিতে। তিনি বলেছেন, মোদি সরকার তার গ্রুপ এনএসসিএনের সাথে চূড়ান্ত সমঝোতা করতে প্রস্তুত ‘অভিন্ন সার্বভৌমত্বের’ নীতিমালার ভিত্তিতে। মূল ভারতের কেউ তাতে আপত্তি তুলছে বলে মনে হচ্ছে না।
কেউ এই প্রশ্নও তুলছে না, অভিন্ন সার্বভৌমত্বের ভিত্তিতে যদি নাগা বিদ্রোহ দমন করা যায়, তবে তা কেন কাশ্মিরের বেলায় প্রযোজ্য হবে না?
মনে হচ্ছে, দেশ সবকিছু মোদির ওপর ছেড়ে দিয়ে এই বিশ্বাস করে বসে আছে, তিনি দেশকে ডুবাবেন না।
তাকে বিশ্বাস করাটা ক্ষমতাসীন দলের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ এমন ধারণা জাতিকে (কিংবা সংখ্যাগরিষ্ঠ ভারতীয়দের মধ্যে) দিতে পারার মধ্যেই মোদির সাফল্য নিহিত রয়েছে।
এমনকি সেনাবাহিনীও ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’ পরিচালনা করার সক্ষমতা অর্জন করেছে, কারণ তারা আরএসএস প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নেতাদের নেতৃত্বে রয়েছেন। এই দাবিটি করেছেন সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী মনোহর পারিকর। অবশ্য এতে সেনাবাহিনীর অনেকে কষ্ট পেয়েছে। সেনাবাহিনীর অফিসাররা এখনো তাদের পেশাগত সংস্কৃতি এবং বৈচিত্র্যের মূল্যবোধে বিশ্বাস করেন।
মোদিকে বাগ্মী কিংবা সফল কমিউনিকেটর (তিনি উভয়টাই) হিসেবে অভিহিত করা যায়। জাতিকে তিনি তার ওপর বিশ্বাস স্থাপন করাতে সক্ষম হয়েছেন।
তবে তিনি নিশ্চিতভাবেই জানেন, অন্য কিছু নয়, স্রেফ কর্ম সম্পাদন দক্ষতাই তার প্রতি ভারতীয়দের আস্থা অটুট রাখতে পারে।
মোদির ৩ বছর : জরিপে নানা মাত্রিক চিত্র
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির দায়িত্ব পালনের তিন বছর এবং ২০১৯ সালে অনুষ্ঠেয় পরবর্তী নির্বাচনে তার সম্ভাবনা নিয়ে টাইমস অব ইন্ডিয়া গ্রুপের ইংরেজি ও প্রাদেশিক ভাষার ওয়েবসাইটগুলোর করা জরিপে তার সমর্থন ঘাঁটি সম্পর্কে উল্লেখযোগ্য কিছু চিত্র ফুটে ওঠেছে।
সার্বিকভাবে এক কথায় বলা যায়, ভারতে নরেন্দ্র মোদি সম্পর্কে জনসাধারণের উচ্চ ধারণা রয়েছে। সব সূচকেই দেখা যাচ্ছে, ২০১৯ সালের নির্বাচনে তার জয়ের সম্ভাবনা খুবই ভালো। অবশ্য যদি ভারতের জনগণের সাথে তার মধুচন্দ্রিমা অব্যাহত থাকে।
অবশ্য তার বর্তমান সমর্থন ঘাঁটির ব্যবধান সময়মতো পূরণ করা না হলে সেটা আরো বড় হয়ে তার সম্ভাবনা শেষ করে দিতে পারে।
জরিপে দেখা যায়, ইংরেজিভাষী এলিটদের মধ্যে মোদির সমর্থন অনেক বেশি, তবে ইংরেজিভাষী সাধারণ মানুষের মধ্যে তার সমর্থন বেশ কম। পশ্চিম ভারতের তুলনায় উত্তর ভারতে তিনি বেশি জনপ্রিয়। দক্ষিণে তিনি কর্নাটক ও কেরালায় খুব জনপ্রিয়, তবে অন্ধ্রপ্রদেশে তার জনপ্রিয়তা বেশ কম। তামিলনাড়ুতে তিনি উল্লেখযোগ্য মাত্রায় অজনপ্রিয়।
অনলাইন জরিপটি পরিচালনা করে টাইমস অব ইন্ডিয়া ও মুম্বাই মিরর (ইংরেজি); নবভারত টাইমস (হিন্দি), মালায়াম সামায়াম (মালায়ালাম), ইয়াম গুজরাট (গুজরাটি), মহারাষ্ট্র (মারাঠি), এই সময় (বাংলা), তেলুগু সময়াম (তেলেগু), বিজয় কর্নাটক (কানাড়া) এবং তামিল সময়ম (তামিল)। এসব পত্রিকার সবই বেশ প্রতিষ্ঠিত মিডিয়া।
ইংরেজি ভাষার ওয়েসবাইটগুলো (উত্তর ও পশ্চিম ভারতে) জানায়, ৬১ ভাগ বলেছে, মোদির সরকারের আগামী নির্বাচনে জয়ের সম্ভাবনা আরো বেশি, ২৮ ভাগ বলেছে ২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার সময়ের মতো একই রয়েছে। মাত্র ১৬ ভাগ বলেছে, তার সম্ভাবনা শেষ হয়ে গেছে।
হিন্দি ভাষার নবভারত টাইমসের (উত্তর ভারতীয় রাজ্যগুলোর অ-এলিটদের মধ্যে জনপ্রিয়) মতে, ৪৯ ভাগ উত্তরদাতা বলেছে, তার সম্ভাবনা বেড়েছে, ১৬ ভাগের মতে, আগের মতোই আছে এবং ৩৫ ভাগের মতে কমেছে।
সার্বিকভাবে ভারতে ৭১.৭ ভাগ বলেছে, পরবর্তী নির্বাচনে মোদি সরকারের সম্ভাবনা বেড়েছে কিংবা আগের মতোই রয়েছে। ৪৯.৬ ভাগ বলেছে, বেড়েছে।
মারাঠিভাষী পশ্চিমাঞ্চলীয় রাজ্য মহারাষ্ট্রে টাইমস অব ইন্ডিয়া জানায়, ৪৪ ভাগের মতে সরকারের সম্ভাবনা আগের চেয়ে বেশি। আর ১৯ ভাগ মনে করে, আগের মতোই আছে। কিন্তু ৩৭ ভাগ মনে করছে, তার সম্ভাবনা শেষ হয়ে গেছে। মনে রাখতে হবে, মোদির বিজেপিই মহারাষ্ট্রে ক্ষমতাসীন। ক্ষমতাসীনদের প্রতি বিরূপ থাকার প্রবণতার কারণেই এখানকার অনেকে তার সম্পর্কে নেতিবাচক কথা বলেছে।
আর মোদির নিজ রাজ্য গুজরাটে (গুজরাটি ভাষার ওয়েবসাইট আই অ্যাম গুজরাটের মতে) জনমত অনেকটা মহারাষ্ট্রের মতোই। গুজরাট দীর্ঘদিন ধরে মোদির পকেটেই রয়ে গেছে।
গুজরাটে ৪২ ভাগ মনে করছে, সরকারের সম্ভাবনা বেড়েছে, ৩১ ভাগ মনে করে আগের মতোই আছে। আর ২৭ ভাগ মনে করে কমেছে।
পশ্চিমবঙ্গে ঊর্ধ্বগত
পশ্চিমবঙ্গে মোদি সরকার ক্রমাগত জনপ্রিয় হচ্ছে। বাংলা ভাষার এই সময়ের জরিপ অনুযায়ী, ৫৭ ভাগ মনে করে, মোদির জয়ের সম্ভাবনা বেড়ে গেছে, ১৭ ভাগ মনে করে একই আছে। কমার কথা বলেছে ২৬ ভাগ।
পশ্চিমবঙ্গেই বিজেপির সম্ভাবনা বেশ বেড়েছে বলে মনে হচ্ছে। দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকা কমিউনিস্টরা নিস্তেজ হয়ে পড়ায় এবং জাতীয় কংগ্রেস ও তৃণমূল কংগ্রেস এরপর ক্ষমতাসীন হওয়ায় জনগণ এখন সম্ভবত মোদির বিজেপিকে পরীক্ষা করতে চাইছে।
দক্ষিণ ভারতের কর্নাটকে মোদি বেশ ভালো অবস্থায় আছেন। ৭১ ভাগ মনে করছে, মোদির সম্ভাবনা আরো উজ্জ্বল হয়েছে, ১৮ ভাগের মতে আগের মতোই আছে। মাত্র ১১ ভাগ মনে করছে তার জনপ্রিয়তা কমেছে।
কেরালাতেও মোদির সম্ভাবনা ভালো। তবে তা কর্নাটকের মতো তত নয়। মালয়ালা সামায়াম ওয়েবসাইটের মতে, ৪২ ভাগ কেরালাবাসী বলেন, মোদির সম্ভাবনা বেড়েছে। আর ২৮ ভাগের মতে তা আগের মতোই আছে। ২৯ ভাগ মনে করেন, তার অবস্থা আগের চেয়ে খারাপ হয়েছে।
অন্ধ্রপ্রদেশের তেলুগু ভাষার লোকজনের মধ্যে মোদির অবস্থা বেশ খারাপ। সেখানকার মাত্র ৪০ ভাগ মনে করে, মোদির সম্ভাবনা বেড়েছে, ১৮ ভাগের মতে আগের মতোই আছে। আর ৪২ ভাগের মতে, সরকারের জনপ্রিয়তা কমেছে।
তামিল নাড়ুতে সবচেয়ে কম
মোদি সবচেয়ে দুর্বল তামিলনাড়ুতে। তামিল সময়ামের মতে, মাত্র ২৬ ভাগ মনে করে মোদির সম্ভাবনা বেড়েছে। ৩০ ভাগের মতে তা আগের মতোই আছে। কিন্তু ৪৪ ভাগের মতে, তার সম্ভাবনা আগের চেয়ে কমেছে।
যারা পড়তে পারে এবং ইন্টারনেট ব্যবহার করে, তাদের ওপরই এই জরিপ চালানো হয়েছে। ফলে এই জরিপে সাধারণ মানুষের মতামত প্রতিফলিত হয়েছে যথাযথভাবে তা মনে করার কারণ নেই।
এলিট শ্রেণী এবং জাতীয়তাবাদ
তবে এই সীমিত নমুনাতেও পুরোপুরি পরিষ্কার, মোদি এখনো বেশ জনপ্রিয়, প্রতিদ্বন্দ্বিদের চেয়ে অনেক এগিয়ে। তার প্রধান সমর্থকরা উচ্চাকাংক্ষী এবং নাক-উঁচু ইংরেজি ভাষাভাষী এলিট শ্রেণী। বড় ধরনের অর্থনৈতিক উন্নয়নের (গরিবদের জন্য তা কল্যাণ না হলেও) প্রতি এই শ্রেণীর ঝোঁক রয়েছে। দক্ষিণ এশিয়া এবং বিশ্বে ভারতকে তারা বৃহৎ শক্তির মর্যাদায় দেখতে চায়।
আর এসব কারণেই তামিলনাড়ু অবশিষ্ট ভারত থেকে আলাদা। ১৯৬৭ সাল থেকে কংগ্রেস, জনতা দল বা বিজেপির মতো ‘জাতীয়’ বা সর্বভারতীয় দলের চেয়ে দ্রাবিড় মুনেত্রা কাজাগাম (ডিএমকে) এবং অল ইন্ডিয়ান আন্না দ্রাভিড় মুনেত্রা কাজাগাম (এআইএডিএমকে) মতো দলকে গ্রহণ করছে।
মনে রাখা দরকার, ১৯৬৭ সালের আগে তামিলনাড়ুতে কঠোর বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন হয়েছিল। তারা স্বাধীন ‘দ্রাবিড় নাড়ু’ প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন করেছিল। ‘দ্রাবিড় পার্টিগুলো’র নেতৃত্বাধীন তামিলনাড়ু বারবার দেখিয়েছে, তারা ধর্ম ও বর্ণভিত্তিক রাজনীতি পছন্দ করে না।
প্রগতিশীল ও উন্নয়নমুখী তামিলনাড়ু শিল্প ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রতি আগ্রহী। মোদিও শিল্প ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে আগ্রহী। তবে তামিলনাড়ু অন্যান্য ভারতীয় রাজ্যের চেয়ে (কেরালা বাদে) সমাজ কল্যাণে অনেক অগ্রসর। তারা উন্নয়নের জন্য উন্নয়ন নয়, বরং সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য উন্নয়ন চায়।
মোদি কিন্তু তার উন্নয়ন প্রকল্পে সামাজিক সাম্য ও ন্যায়বিচারের বিষয়টি গুরুত্ব দেন না। তিনি পাকিস্তান, চীন এবং ভারতের অন্য প্রতিবেশীদের তুলনায় ভারতের শক্তিশালী অবস্থানটি তুলে ধরতে আগ্রহী। তিনি উত্তর ও পশ্চিম ভারতের অর্থনৈতিক এলিট এবং দেশের অন্যান্য অংশের সাধারণ মানুষ যারা জাতীয়তাবাদ ছাড়া অন্য কিছুই বিবেচনা করতে নারাজ, তাদের কাছে আবেদন রাখেন।