কক্সবংলা ডটকম(১৪ জানুয়ারি) :: ঢাকায় বিনিয়োগে সুফল কম মিলছে জেলা ও উপজেলায় বিনিয়োগের চেয়ে। তবে এসব ভাবছে না সরকার। এতে বিনিয়োগে জিডিপি কমে যাচ্ছে ৬ থেকে ১০ শতাংশ। ঢাকার অতিবৃদ্ধি সারা দেশের অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, সারা দেশের প্রায় অর্ধেক কর্মসংস্থান ঘটছে ঢাকায়। অপরিকল্পিত কার্যক্রমের ফলে সবক্ষেত্রে ঢাকার বৃদ্ধির হার ঊর্ধ্বগতির লাগাম টেনে ধরে রাখা যাচ্ছে না।
শনিবার রাজধানীতে ‘স্থায়িত্বশীল নগরায়ণ : সমস্যা ও সমাধান’বিষয়ক বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) এবং বাংলাদেশ পরিবেশ নেটওয়ার্কের (বেন) বিশেষ সম্মেলনে এসব চিত্র উঠে এসেছে।
সম্মেলনের একাধিক উপস্থাপনা ও বিশেষজ্ঞদের বক্তৃতায় বলা হয়েছে, আশির দশক থেকে ঢাকায় বিনিয়োগ বাড়ছে। এর আগে অন্যান্য শহরের মতো বিনিয়োগ হতো ঢাকায়ও। তখন ঢাকার ও দেশের অন্যান্য শহরের মধ্যে তেমন পার্থক্য ছিল না। বেশি বিনিয়োগের পর থেকে ঢাকায় কর্মসংস্থান বাড়তে থাকে। কর্মের প্রয়োজনে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে মানুষ ঢাকায় জড়ো হতে থাকে।
যে হারে ঢাকামুখী বিনিয়োগ বেড়েছে, সে হারে জেলা ও উপজেলা শহরে বিনিয়োগ বাড়েনি। ফলে ঢাকায় জনঘনত্বপূর্ণ শহরে পরিণত হয়েছে। এখন যানবাহনের ঘণ্টায় গতিবেগ ২৩ কিলোমিটার থেকে ৭ কিলোমিটারে নেমে এসেছে। ঢাকার যানজটের কারণে জিডিপির প্রায় ২ দশমিক ৯ শতাংশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
বাংলাদেশ পরিবেশ নেটওয়ার্কের (বেন) প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ও বাপার সহসভাপতি ড. নজরুল ইসলাম বাপা-বেনের বিশেষ সম্মেলনের মূল প্রবন্ধ পাঠ করেন। তার লিখিত প্রবন্ধে বলেন, ১৯৯৭ সালে দেশের নগর অঞ্চলের পরিমাণ ছিল প্রায় ৯ শতাংশ। ২০২২ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৪০ শতাংশ। অর্থাৎ, বিগত ৪৮ বছরে দেশে নগর অঞ্চলের পরিমাণ বেড়েছে প্রায় ৩১ শতাংশ।
জনশুমারি ২০২২-এর তথ্য অনুযায়ী, ঢাকা উত্তর সিটিতে প্রতি বর্গকিলোমিটারে প্রায় ৩১ হাজার মানুষ বসবাস করে। আর ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে প্রতি বর্গকিলোমিটারে বাস করে প্রায় ৪০ হাজার মানুষ। জিডিপির এক-তৃতীয়াংশ আসে ঢাকা থেকে এবং সারা দেশের প্রায় অর্ধেক কর্মসংস্থান ঘটছে ঢাকায়। অথচ ঢাকায় ন্যূনতম নাগরিক সুবিধা নেই। ২৫ ভাগ সড়কের স্থানে রয়েছে মাত্র ৮ ভাগ এবং ৫২ শতাংশ মোটরযানই চলাচলের অযোগ্য। এসব কারণে প্রতিনিয়ত বাড়ছে যানজট।
নগরবাসীর বিভিন্ন মৌলিক নাগরিক সেবা অর্থাৎ, বিদ্যুৎ, পানি, পয়ঃনিষ্কাশন, সড়ক, পরিবহন, বাসস্থানের চাহিদা মেটানো কঠিন হয়ে পড়েছে। এ ছাড়া ক্রমাগত দখল ও দূষণে দেশের শহরগুলোর সবুজ ও জলজ অংশগুলো বিলীন হয়ে পড়েছে।
তিনি বলেন, দেশের জনসংখ্যার ৪০ শতাংশ এখন শহরে বসবাস করে; এর মধ্যে ঢাকাতেই বসবাস করে ৩২ শতাংশ নগরবাসী। ২০৪১ সালে দেশের ৫০ শতাংশ নগর অঞ্চলে রূপ লাভ করবে। সরকার উন্নত দেশ গঠনের ঘোষণা দিলেও উন্নত দেশ যেসব প্রকল্প থেকে সরে আসছে, সেসব প্রকল্প ঢাকায় বাস্তবায়ন করছে। ঢাকায় অপরিকল্পিত প্রকল্প বাস্তবায়নে বিপুল অর্থ বাস্তবায়ন করছে, দেশের অন্যান্য শহরও সেসব প্রকল্প দাবি করছে। সারা দেশ ঢাকাকে অনুসরণ করে।
এসব প্রকল্পের বেশিরভাগই গণমুখী নয়, কিছু প্রকল্প শুধু মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তের কথা বিবেচনা করা হচ্ছে। এসব কার্যক্রম থেকে সরে এসে সরকারকে গণমুখী প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হবে, তাহলে তা পরিবেশবান্ধব হবে। গুটিকয়েক শহর নয়, দেশের ৬৪টি জেলাকে গুরুত্ব দিয়ে কাজ করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, সরকার ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল গঠনের বিষয়ে গুরুত্ব দিয়েছে। এটি ভালো উদ্যোগ যদি সবগুলো একত্রে নাও হয়, অন্তত ৬৪টি জেলায় ১টি করে অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলা হয়, তাতেও জেলাভিত্তিক কর্মসংস্থান বাড়বে। কমবে ঢাকামুখী জনস্রোত। ঢাকা প্রশাসনিক ও আবাসিক শহর হওয়ার কথা থাকলেও অপরিকল্পিত ভূমি ব্যবহারের কারণে এই শহর শিল্পনগরে পরিণত হয়েছে। ঢাকা ও আশপাশের এলাকায় পোশাক খাতের প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিক কাজ করছেন।
নতুন সরকারের কাছে দাবি জানাব, দেশের নগর-পরিকল্পনা নিয়ে নতুন করে ভাবুন। নইলে ক্রমবর্ধমান দেশের নগর অঞ্চল বড় সমস্যার সৃষ্টি করবে, যেটার ব্যবস্থাপনা করা সম্ভব হবে না। বর্তমানে দেশে ১২টি সিটি করপোরেশন, ৩২৭টি পৌরসভা ও ৫৭০টি নগর কেন্দ্র রয়েছে।
বাপা-বেনের সম্মেলনে উপস্থাপিত মূল প্রবন্ধে বলা হয়েছে, দেশের মানুষের মধ্যে আয়বৈষম্য আগের চেয়ে বেড়েছে। দেশের মোট আয়ের ১৮ শতাংশ ৫০ শতাংশ হতদরিদ্রের হাতে। আর ধনী ৫ শতাংশের হাতে মোট আয়ের ৩০ শতাংশ। সরকার গ্রামকে শহরে রূপান্তরের ঘোষণা দিলেও এর সুনির্দিষ্ট রূপরেখা দেয়নি।
নগর গবেষণা কেন্দ্রের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. নজরুল ইসলাম বলেন, প্রতিবছর ঢাকায় ৫ লাখ মানুষ নতুন করে যুক্ত হচ্ছে; এর মধ্যে প্রায় ৪ লাখই দরিদ্র। অতিরিক্ত বৃদ্ধি শহরকে সমস্যাগ্রস্ত করছে। তিনি বলেন, সরকারের নগর উন্নয়নের দায়িত্ববোধ নেই। বঙ্গবন্ধুর সময়েই অবকাঠামো পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাব করেছিলেন স্থপতি মাজহারুল ইসলাম। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর হঠাৎ মৃত্যুর কারণে তা আলোর মুখ দেখেনি। গ্রামীণ প্রকৃতির দেশটি নগররাষ্ট্র হওয়ার দৌড়ে থাকলেও দেশে নেই কোনো নগর উন্নয়ন মন্ত্রণালয়।
ড. নজরুল ইসলাম আরও বলেন, সরকারের পরিকল্পনা ও প্রকল্পে নগর-দরিদ্ররা উপেক্ষিত থাকছে। পাকিস্তান সময়ে দরিদ্রদের জন্য মিরপুরে বিশাল আবাসিক এলাকা গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়। সেখানে পরিকল্পনার চেয়েও ২০ গুণ বেশি মানুষ বসবাস করছে। তবু সেখানে তেমন কোনো সমস্যা নেই। কেননা, কাজটি সেখানে পরিকল্পিত উপায়ে তৈরি করা হয়েছিল। সে সময় অভিজাতদের জন্য ধানম-ি ও মোহাম্মদপুর আবাসিক এলাকা গড়ে তোলা হয়। সরকারের পরিকল্পনায় দরিদ্রদের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) এবং গণপরিবহন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. সামছুল হক বলেন, ‘কারিগরিভাবে ঢাকার গণপরিবহন সমস্যার সমাধান করা সম্ভব। আমাকে দায়িত্ব দিলে আমি ৬ মাসে কারিগরি কাজের সমাধান দেখাতে পারব। তবে এ কাজ করতে রাজনৈতিক নেতৃত্ব দরকার। ঢাকার গণপরিবহনের সমস্যা সমাধানের দায়িত্ব ঢাকার দুই মেয়রের হাতে রয়েছে। কিন্তু গণপরিবহনের শৃঙ্খলা ফেরানোর কাজ যাদের দিয়ে করানো হচ্ছে, গণপরিবহনের শৃঙ্খলা ফেরানোর কাজের জন্য তারা যোগ্য লোক নন। ভুলপথে হেঁটে সমস্যার সমাধান মিলবে না।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ এস এম মাকসুদ কামাল নগরায়ণ ও দুর্যোগ :
ভূমিকম্প ও অগ্নি অভিঘাত বিষয়ে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। তিনি বলেন, কাছাকাছি সময়ে বাংলাদেশে বড় মাত্রার ভূমিকম্পের আশঙ্কা দেখছি না। অর্থাৎ, ৩৫০ থেকে ৬৫০ বছরের মধ্যে এমন আশঙ্কা লক্ষ করা যাচ্ছে না। সর্বোচ্চ ৫.৬ তীব্রতার ভূমিকম্প হতে পারে। সেসব ভূমিকম্প তেমন কোনো ক্ষতি করবে না। তবে এজন্য ভূমিকম্পের সময় আতঙ্কিত না হয়ে কী পদক্ষেপ গ্রহণ করা দরকার, সেদিকে মনোনিবেশ করতে হবে।
তিনি বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে ভূমিকম্পের সচেতনতা বিষয়ে লিফলেট, পোস্টার লাগানো থাকে। রুমের দরজা-জানালায় স্টিকার দেওয়া থাকে। এর পরও সম্প্রতি হয়ে যাওয়া ভূমিকম্পের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সূর্যসেন হলের এক শিক্ষার্থী তিনতলা থেকে নিচে পড়ে পা ভেঙেছেন। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের একজন শিক্ষার্থী এ ধরনের কা- ঘটালে অন্যরা কী করবেন।
তিনি আরও বলেন, ডাউকি ফল্টে (আসাম, মেঘালয়, সিলেট অঞ্চল) ভূমিকম্প হয় এক হাজার বছর আগে। সেখানে ভূমিকম্প হলে ৮ মাত্রার ওপরে হবে, তখন বিল্ডিং কোডও কোনো কাজ করবে না। সেখানে ৮ মাত্রার ওপরে ভূমিকম্প হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। সেটা হলেও ৩৬০ থেকে ৬৫০ বছরের মধ্যে হতে পারে বলে ধারণা করা হয়। আর মধুপুর ফল্টে ৭ দশমিক ৫ মাত্রার ভূমিকম্প হলে ঢাকার অন্তত ৯৪০টি স্পটে আগুনের ঘটনা ঘটবে। নগরায়ণের আরেক নাম বিপদ। ভূমিকম্পের প্রতিরোধকব্যবস্থা ও সচেতনতা সৃষ্টিতে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
প্রধান অতিথির বক্তৃতায় সিপিডির চেয়ারম্যান অধ্যাপক রেহমান সোবহান বলেন, ঢাকায় অতি নগরায়ণের ফলে যানজট বেড়েছে। নগরের নানা ধরনের ঝুঁকি বাড়ছে। সমন্বয় না থাকায় নগর দ্রুত বাড়ছে। আবাসন কোম্পানির চটকদার বিজ্ঞাপনের ফলে দেশের মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়ছে। তিনি বলেন, ঢাকার আশপাশের এলাকা আবাসন কোম্পানিগুলো ভরাট করে প্রকল্প গড়ে তুলেছে। এসব নিয়ন্ত্রণে সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলো যথাযথ ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হয়েছে।
এজন্য সরকারকে নগর-সংশ্লিষ্টদের ভূমিকম্প প্রতিরোধকব্যবস্থা ও সংশ্লিষ্টদের এসব বিষয়ে দৃষ্টিপাত করার অনুরোধ রাখব। তিনি আরও বলেন, নিউ ইয়র্কসহ বিশে^র উন্নত শহরগুলোয় মেয়রদের হাতে অনেক ক্ষমতা থাকে। এজন্য তারা নগর উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণে বড় ভূমিকা রাখতে পারেন। বাংলাদেশের মেয়রদের ক্ষমতা বাড়ানো দরকার। তাহলে তারা কাজগুলো সঠিকভাবে করতে পারবেন।
বাপা-বেনের বিশেষ সম্মেলনের সভাপতিত্ব করেন অধ্যাপক নুর মোহাম্মদ তালুকদার। বাপার সহসভাপতি স্থপতি ইকবাল হাবিব সম্মেলনের সঞ্চালনা করেন। সম্মেলন উদযাপন কমিটির সদস্য সচিবের দায়িত্ব পালন করেন অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার। দিনব্যাপী সম্মেলনে ৫টি সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়।
এসব সেমিনারের আলোচনায় অংশ নেন বাপার সহসভাপতি অধ্যাপক ড. আতিউর রহমান, বাপার সহসভাপতি প্রকৌশলী তাকসিম এ খান, বাপার সাধারণ সম্পাদক আলমগীর কবির, বেলার প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, নগর গবেষণা কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক সালমা এ শফি, বুয়েটের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ড. আফসানা হক প্রমুখ।
Posted ১২:১১ অপরাহ্ণ | রবিবার, ১৪ জানুয়ারি ২০২৪
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta