কক্সবাংলা ডটকম(১ জানুয়ারি ) :: বিদায় নিল ২০১৮ সাল। শুরু হলো নতুন বছর। এখন সময় পুরনো বছরে প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির খাতায় নজর বোলানোর। ২০১৮ সাল দেশের অর্থনীতির জন্য কেমন ছিল তা এক ঝলকে দেখে নেয়া যাক—
উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের প্রাথমিক যোগ্যতা অর্জন
অর্থনৈতিক উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় গত বছর বড় একটি ধাপ পেরিয়েছে বাংলাদেশ। আর তা হলো জাতিসংঘের তালিকায় স্বল্পোন্নত (এলডিসি) থেকে উন্নয়নশীল দেশের স্তরে নাম লেখানোর প্রাথমিক যোগ্যতা অর্জন। অবশ্য প্রাথমিক ধাপটি পেরোলেও চূড়ান্ত স্বীকৃতি অর্জনে আরো কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। জাতিসংঘের ওয়েবসাইট সূত্র অনুযায়ী, এলডিসি থেকে উন্নয়নশীল দেশের স্তরে চূড়ান্তভাবে উত্তরণ নিশ্চিত করতে হলে বাংলাদেশকে তিন বছর নির্দিষ্ট কিছু সূচকে অর্জনের ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে হবে।
গত মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহে জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসির (সিডিপি) বৈঠক হয়। এ বৈঠকের সিদ্ধান্তে বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদায় উত্তরণের জন্য প্রাথমিকভাবে যোগ্য ঘোষণা করা হয়। এলডিসির তালিকা থেকে বেরিয়ে আসতে নির্ধারিত তিনটি সূচকের শর্ত পূরণের মাধ্যমে বাংলাদেশ এ যোগ্যতা অর্জন করে। সূচকগুলোর মধ্যে রয়েছে মাথাপিছু আয়, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে যা ওই সময়েই ১ হাজার ২৪২ মার্কিন ডলার পেরিয়ে যায়। একই সঙ্গে মানবসম্পদ উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক ঝুঁকি নিরসন—এ দুটি মানদণ্ডেও উত্তীর্ণ হয় বাংলাদেশ। ১৫ মার্চ সিডিপি বাংলাদেশের প্রাথমিক উত্তরণের বিষয়টি চূড়ান্ত করে।
এলডিসি থেকে উত্তরণ ও জিএসপি সুবিধা: অর্জনেও হারানোর আশঙ্কা
এলডিসি থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ বাংলাদেশের জন্য যেমন মর্যাদা ও সম্ভাবনার বিষয়, তেমনি কিছুটা উদ্বেগেরও। কারণ স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে বাংলাদেশ রফতানি পণ্যের প্রধান ক্রেতা দেশগুলোর কাছ থেকে যে বাণিজ্য সুবিধা পেত, উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের পর তা আর নাও পাওয়া যেতে পারে। কারণ একটি দেশ অর্থনৈতিক উন্নয়নের কোন স্তরে রয়েছে, তার ওপর নির্ভর করে সে দেশকে অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য সুবিধা দেয়া হয়।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) জোটগতভাবে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের সবচেয়ে বড় ক্রেতা। একক দেশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র শীর্ষ দুইয়ের একটি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উন্নয়নশীল দেশে চূড়ান্তভাবে উত্তরণের পর বাংলাদেশ তৈরি পোশাক ও বস্ত্র খাতে যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউতে শুল্ক, কোটা ও অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য (জিএসপি) সুবিধা হারানোর মতো কিছু চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে। এছাড়া বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) বিধান অনুযায়ী বাজার অভিগম্যতায় স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে যে বিশেষ সুবিধা পেত, তাও হারাতে হবে বাংলাদেশকে।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) গবেষণা অনুসারে, বাংলাদেশ এলডিসি হিসেবে যেসব সুযোগ-সুবিধা পেত, উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের পর সেগুলোর শর্তে পরিবর্তন আসবে। বিষয়টি দেশের অর্থনীতির জন্য, বিশেষ করে রফতানি খাতের জন্য খানিকটা উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ইইউতে অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য সুবিধা হারানো।
বাংলাদেশ ইইউতে বিদ্যমান এভরিথিং বাট আর্মস (ইবিএ) সুবিধা হারানোর পর জিএসপি প্লাস না পেলেও স্ট্যান্ডার্ড জিএসপির সুবিধা পেতে পারে। এর জন্য বাংলাদেশের এখনই প্রস্তুতি গ্রহণ শুরু করতে হবে বলে মনে করে পিআরআই। উল্লেখ্য, স্বল্পোন্নত দেশগুলোর জন্য ইবিএ কর্মসূচির অধীনে শুল্কমুক্ত বাজার সুবিধা ও শিথিল রুলস অব অরিজিন সুবিধা প্রদান করে ইইউ।
ইইউতে জিএসপি প্লাস সুবিধার আওতায় বিশ্বজুড়ে অগ্রাধিকারমূলক বাজার ব্যবস্থার দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সুবিধা প্রদান করা হয়। এর আওতায় পোশাকসহ ৬৬ শতাংশ পণ্য শুল্কমুক্ত বাজার সুবিধা পায়।
পিআরআই বলছে, এলডিসি থেকে উত্তরণের পর বাংলাদেশ জিএসপি প্লাসের জন্য আবেদন করতে পারে। কিন্তু বিদ্যমান জিএসপি মানদণ্ডে বাংলাদেশের জিএসপি প্লাস সুবিধা পাওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। সেক্ষেত্রে স্ট্যান্ডার্ড জিএসপি বাংলাদেশের জন্য একমাত্র ভরসা হতে পারে।
তবে ব্যবসায়ীরা কিন্তু এখনই আশা হারাতে চান না। বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সাবেক সভাপতি ফজলুল হকের মতে, বাংলাদেশের এতে ভীত হওয়ার কিছু নেই। এক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়ার পূর্ব অভিজ্ঞতাসহ বেশকিছু যুক্তি রয়েছে বলে জানান তিনি।
নিট রিজার্ভে পতন
দেশে আমদানি ব্যয় অনেক বেড়ে গেছে। সে তুলনায় বাড়েনি রফতানি আয় ও রেমিট্যান্স প্রবাহ। ফলে চলতি হিসাবে বড় ধরনের ঘাটতি তৈরি হয়েছে। এ ঘাটতি নেতিবাচক ধারায় নিয়ে গেছে ব্যালান্স অব পেমেন্টকেও। অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ এ দুটি নির্দেশকের নিম্নমুখিতায় কমতে শুরু করেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অ্যাকাউন্টস অ্যান্ড বাজেটিং বিভাগের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, অক্টোবর শেষে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার নিট রিজার্ভের আকার দাঁড়ায় ২ হাজার ৮৬০ কোটি ডলার। এক বছর আগে এর পরিমাণ ছিল ৩ হাজার ১৫৩ কোটি ডলার।
নিট রিজার্ভ কমার পাশাপাশি আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় রয়েছে। আর তা হলো গ্রস রিজার্ভ ও নিট রিজার্ভের পার্থক্য। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৩ হাজার ২০৭ কোটি ডলার। এ রিজার্ভের মধ্যে এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) মাধ্যমে ১১১ কোটি ২০ লাখ ডলার আমদানি ব্যয় পরিশোধের দায় ছিল। এছাড়া রিজার্ভের হিসাবায়নে দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ফরেন কারেন্সি অ্যাকাউন্টের (এফসিএ) প্রায় ৮০ কোটি ও আইএমএফ থেকে নেয়া ৬৩ কোটি ৫০ লাখ ডলারের ঋণও সম্পদ হিসেবে দেখানো হয়। নিট রিজার্ভ হিসাবায়নের ক্ষেত্রে এসব দায় বাদ দেয়া হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, অক্টোবর শেষে গ্রস রিজার্ভ ও নিট রিজার্ভের পার্থক্য ছিল ৩৪৭ কোটি ডলার।
অর্থনৈতিক স্বাধীনতা সূচকে অবস্থান বদলায়নি
মার্কিন থিংক ট্যাংক দ্য হেরিটেজ ফাউন্ডেশন প্রণীত অর্থনৈতিক স্বাধীনতা সূচকে গত বছর বাংলাদেশের অবস্থান অপরিবর্তিত ছিল। ৫৫ দশমিক ১ স্কোর নিয়ে ২০১৮ সালের তালিকায় বাংলাদেশ ১২৮তম অবস্থানে ছিল। ২০১৭ সালের অবস্থানও একই ছিল। তবে অবস্থানে উন্নতি না হলেও গত বছর সার্বিকভাবে দেশের স্কোর ২০১৭ সালের চেয়ে দশমিক ১ পয়েন্ট বাড়ে।
গত বছর সম্পত্তির অধিকার, করের বোঝা, ব্যবসার স্বাধীনতা, শ্রমের স্বাধীনতা ও বাণিজ্যের স্বাধীনতা সূচকে বাংলাদেশের স্কোর আগের বছরের চেয়ে কমে যায়। স্কোর অপরিবর্তিত ছিল বিনিয়োগ স্বাধীনতা ও আর্থিক স্বাধীনতা সূচকে। আর স্কোর বেড়েছিল গভর্নমেন্ট ইন্টেগ্রিটি, বিচার ব্যবস্থার কার্যকারিতা, সরকারি ব্যয়, ফিসক্যাল হেলথ ও মনিটারি ফ্রিডম সূচকে।
গত বছর হেরিটেজ ফাউন্ডেশনের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা সূচকে এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ৪৩টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ২৯তম। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ভুটান (৮৭তম) ও শ্রীলংকা (১১১তম) বাংলাদেশের চেয়ে ভালো অবস্থানে ছিল। পিছিয়ে ছিল ভারত (১৩০তম), পাকিস্তান (১৩১তম) ও নেপাল (১৩৩তম)।
প্রসঙ্গ: ওয়ান স্টপ সার্ভিস
নভেম্বরের মাঝামাঝিতে দেশের অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগকারীদের জন্য ওয়ান স্টপ সার্ভিস (ওএসএস) চালুর ঘোষণা দেয় বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা)। সংস্থাটি প্রাথমিকভাবে এ প্রক্রিয়ায় ১১টি সেবা প্রদান শুরু করে। ডিসেম্বরের মধ্যে আরো তিনটি সেবা প্রদান কার্যক্রম শুরুর কথা জানায় তারা। এসব সেবা দিতে বিভিন্ন সংস্থা ও দপ্তরের সঙ্গে চুক্তির পরিকল্পনার কথাও বলে বেজা। ধাপে ধাপে সব সেবা চালু হলে বেজার ওএসএস কেন্দ্র থেকে বিনিয়োগকারীরা ২৭ ক্যাটাগরিতে মোট ১২৩টি সেবা পাবেন।
জানা যায়, বিনিয়োগকারীদের ওএসএস সেবা দিতে বেজা ২০১৫ সালে আইন করার উদ্যোগ নেয়। গত বছর আইন পাস হয়। পরবর্তী সময়ে এ আইনের আলোকে ওএসএস বিধিমালা জারি করা হয়। এ সেবা চালু করতে কারিগরি সহযোগিতা দিচ্ছে জাইকা। তারা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সফটওয়্যার তৈরি ও ওএসএস কেন্দ্র স্থাপনে কাজ করছে।
এদিকে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের কৃষকদের দোরগোড়ায় কৃষিসেবা পৌঁছে দিতে দেশের বিভিন্ন ইউনিয়নে ‘কৃষক সেবাকেন্দ্র’ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয় সরকার। মূলত ‘কৃষিসেবার ওয়ান স্টপ সেন্টার’ হিসেবে এসব কেন্দ্র স্থাপন করা হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এসব কেন্দ্র স্থাপনের পর প্রত্যন্ত গ্রামের কৃষকদের কৃষিসংক্রান্ত বিভিন্ন সেবা নিতে আর উপজেলা অফিসে আসার দুর্ভোগ পোহাতে হবে না। কৃষক সেবাকেন্দ্রগুলো থেকেই সব ধরনের পরামর্শ ও সেবা নিতে পারবেন তারা। এতে তাদের সময় ও অর্থ সাশ্রয় হবে। বাড়বে উৎপাদনশীলতা।
প্রাথমিকভাবে ‘ইউনিয়ন পর্যায়ে কৃষক সেবাকেন্দ্র স্থাপন ও প্রযুক্তি হস্তান্তর (পাইলট) প্রকল্প’-এর মাধ্যমে দেশের ২১টি জেলার ২৪টি উপজেলার ২৪টি ইউনিয়নে এ ধরনের কেন্দ্র স্থাপনের উদ্যোগ নেয় সরকার। উপজেলা পর্যায়ে প্রযুক্তি হস্তান্তরের জন্য কৃষক প্রশিক্ষণ (তৃতীয় পর্যায়) প্রকল্পের আওতায় ২০টি ইউনিয়নে আরো ২০টি কৃষক সেবাকেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ প্রক্রিয়াধীন।
Posted ১১:৪৯ পূর্বাহ্ণ | মঙ্গলবার, ০১ জানুয়ারি ২০১৯
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta