কক্সবাংলা ডটকম(১০ ডিসেম্বর) :: রানের হিসেবে ভারত তৃতীয় ছোট টেস্ট জয়টি অ্যাডিলেডে পেলে। কিন্তু গুরুত্বে কোহলির ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা টেস্ট জয় এটি। এমনকি ভারতের টেস্ট ইতিহাসেরও অন্যতম সেরা জয় অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষের টেস্টটি।
ম্যাচের রাশ ছিল ভারতের হাতে৷ তবে চতুর্থ দিনের শেষে অজি শিবিরের হয়ে ন্যাথন লায়ন প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন শেষদিনে লড়াই না ছাড়ার৷ অজি স্পিনার বল হাতে নিজের ভূমিকা যথাযথ পালণ করেছেন৷ পাশাপাশি আস্থা রেখেছিলেন ব্যাটসম্যানদের উপরেও৷
পাকিস্তানের বিরুদ্ধে দুবাই টেস্টের শেষ দিনের অবিস্মরণীয় লড়াইয়ের উদাহরণ টেনে লায়ন জানিয়েছিলেন, অ্যাডিলেডের পিচ শেষ দিনে এমন কিছু ব্যাট করার অযোগ্য হয়ে উঠবে না৷ তাই দুবাইয়ে পারলে অস্ট্রেলিয়া অ্যাডিলেডেও নিশ্চিত পারবে৷
অর্থাৎ কোণঠাসা হয়েও অস্ট্রেলিয়া অ্যাডিলেড ওভালে জয়ের আশা ছাড়েনি৷ প্রতিশ্রুতি মতো অজি ব্যাটসম্যানরা শেষ দিনে অনবদ্য লড়াই উপহার দিলেও শেষ রক্ষা হয়নি৷ তীরে এসে তরী ডোবে টিম পেইনদের৷ একসময় হারের আতঙ্ক ঘাড়ে চেপে বসলেও বোলারদের মিলিত প্রচেষ্টায় শেষমেশ উত্তেজক জয় তুলে নেয় ভারত৷ অ্যাডিলেডে অস্ট্রেলিয়াকে ৩১ রানের সংক্ষিপ্ত ব্যবধানে পরাজিত করে অজি ভূখণ্ডে প্রথমবার টেস্ট সিরিজ জয়ের ভিত প্রস্তুত করে টিম ইন্ডিয়া৷
জয়ের জন্য ৩২৩ রানের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে ব্যাট করতে নামা অস্ট্রেলিয়া শেষ ইনিংসে অলআউট হয়ে যায় ২৯১ রানে৷ ব্যর্থ হয় অস্ট্রেলিয়ার লোয়ার অর্ডারের চোয়াল চাপা প্রতিরোধ৷ দিনের প্রথম সেশনে গত দিনের অপরাজিত মার্শ-হেড জুটির প্রতিরোধ ভাঙতে পারলেও টিম ইন্ডিয়ার সামনে কাঁটা হয়ে দাঁড়ান অজি অধিনায়ক টিম পেইন৷
দিনের শুরুতেই ট্রেভিস হেডকে দুরন্ত বাউন্সারে ফিরিয়ে দেন ইশান্ত শর্মা৷ ১৪ রান করে রাহানের হাতে ধরা পড়েন তিনি৷ পেইনের সঙ্গে ৪১ রানের পার্টনারশিপ গড়ার পর ক্রিজ ছাড়েন মার্শ৷ ততক্ষণে ব্যক্তিগত হাফসেঞ্চুরি পূর্ণ করেছেন তিনি৷
১৬৬ বলে ৫টি বাউন্ডারির সাহায্যে ৬০ রান করে বুমরাহর বলে উইকেটকিপার ঋষভ পন্তের দস্তানায় ধরা দেন মার্শ৷ কামিন্সকে সঙ্গে নিয়ে লাঞ্চের আগের বাকি সময়টুকুতে লড়াই চালান পেইন৷ মধ্যাহ্নভোজের বিরতিতে পেইন অপরাজিত ছিলেন ব্যক্তিগত ৪০ রানে
তবে চায়ের বিরতির পর নিজের ইনিংসকে খুব বেশিদূর টেনে নিয়ে যেতে পারেননি পেইন৷ নতুন করে মাত্র ১ রান যোগ করার পর বুমরাহর বলে আউট হন অজি অধিনায়ক৷ মিচেল স্টার্ক ৪৪ বলে ২৮ রানের উল্লেখযোগ্য অবদান রেখে শামির বলে সাজঘরে ফেরেন৷
প্যাট কামিন্স ১২১ বলে ২৮ রানের লড়াকু ইনিংস খেলে বুমরাহর শিকার হন৷ প্রথম ইনিংসের মতো দ্বিতীয় ইনিংসেও ভারতীয় বোলারদের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ান লায়ন৷ ঋষভ পন্তের হাত থেকে জীবন দান পেয়ে লায়ন শেষমেশ অপরাজিত থাকেন ৩৮ রানে৷ অশ্বিনের বলে হ্যাজেলউড আউট হয়ে বসেন ১৩ রান করে৷
ভারতের হয়ে দ্বিতীয় ইনিংসে তিনটি করে উইকেট নেন শামি, বুমরাহ ও অশ্বিন৷ একটি উইকেট ইশান্ত শর্মার৷ প্রথম ইনিংসে সেঞ্চুরি ও দ্বিতীয় ইনিংসে হাফসেঞ্চুরি করে ম্যাচের সেরা হয়েছেন চেতেশ্বর পূজারা৷
বিরাট কোহলির রেকর্ড
এ জয়ে দারুণ এক রেকর্ড গড়লেন বিরাট কোহলি। উপমহাদেশের প্রথম অধিনায়ক হিসেবে ইংল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা ও অস্ট্রেলিয়ায় টেস্ট জয়ের কীর্তি গড়লেন এই ব্যাটিং জিনিয়াস। ভারতের সর্বশেষ ইংল্যান্ড সফরে স্বাগতিকদের বিপক্ষে টেন্ট্রব্রিজে টেস্ট জেতেন কোহলি। এছাড়া চলতি বছরের জানুয়ারিতে দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গে কোহলির নেতৃত্বে টেস্ট জেতে ভারত।
এশিয়া মহাদেশ শচীন টেন্ডুলকার, সৌরভ গাঙ্গুলি, রাহুল দাব্রিড়, ইমরান খান, ওয়াসিম আকরাম, ইনজামামের মতো অধিনায়ক দেখেছে। দেখেছে তাদের দারুণ সব কীর্তি। কিংবা শ্রীলংকার রানাতুঙ্গা, জয়সুরিয়া, ডি সিলভা, সাঙ্গাকারা, জয়াবর্ধনেরা করেছেন দারুণ অধিনায়কত্ব।
কিন্তু তারা পেস-বাউন্সি উইকেট খ্যাত ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া এবং দক্ষিণ আফ্রিকায় টেস্ট জিততে পারেনি। জয়ের হিসেব নিকেষে ভারতের সেরা অধিনায়ক ধোনী। পারেননি তিনিও। এবার করে দেখালেন কোহলি। তার সামনে এবার সিরিজ জয়ের সুযোগ।
হাইভোল্টেজ ভারত-অস্ট্রেলিয়া সিরিজ নিয়ে নানা পারমুটেশন-কম্বিনেশনে পারদ চড়েছিল আগেই। স্মিথ-ওয়ার্নার হীন ব্যাগি গ্রীণদের বিরুদ্ধে টেস্ট সিরিজ জয়ের জন্য ভারতের কাছে সেরা সুযোগ এটাই। এমনটাই মত ছিল প্রাক্তনদের। সিরিজ শুরুর আগের সেই আভাসকে মান্যতা দিয়েই অ্যাডিলেডে প্রথম টেস্টে দুরন্ত জয় তুলে নিল ভারত। অস্ট্রেলিয়াকে ৩১ রানে হারিয়ে সিরিজে ১-০ এগিয়ে গেল টিম ইন্ডিয়া।
একই ক্যালেন্ডার ইয়ারে দক্ষিণ আফ্রিকা, ইংল্যান্ড এবং অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে টেস্ট জয়, পাশাপাশি অজিদের ডেরায় প্রথম টেস্ট জিতেই সিরিজে এগিয়ে যাওয়া। সবমিলিয়ে বিরাট কোহলির নেতৃত্বে অ্যাডিলেডে টেস্ট জয়কে দ্ব্যর্থহীন ভাবেই ‘ঐতিহাসিক’ আখ্যা দেওয়াই যায়। ব্যাট হাতে ‘পয়া’ অ্যাডিলেডে দাগ কাটতে না পারলেও অধিনায়ক হিসেবে কোহলি কিন্তু এই টেস্ট জিতে উঠে এলেন শিরোনামে। ২০০৮ কুম্বলের নেতৃত্বে টেস্ট সিরিজ জয়ের পর অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে বিরাটই প্রথম, যিনি ভারতকে টেস্ট জয়ের স্বাদ দিলেন।
তবে শুধু বিরাটই নন, টেস্ট জয়ের সাথে সাথে অ্যাডিলেড ওভালে বিশ্বরেকর্ডের অধিকারী হলেন তরুণ উইকেটকিপার ঋষভ পন্ত। অজি ভূমে প্রথম টেস্টে উইকেটের পিছনে দাঁড়িয়েই তালুবন্দি করলেন বিপক্ষের এগারোজন ব্যাটসম্যানকে। প্রথম ভারতীয় উইকেটকিপার হিসেবে এই বিরল কৃতিত্বের অধিকারী হলেন তরুণ পন্ত। এগারো ক্যাচ তালুবন্দি করে বিশ্বরেকর্ড গড়ার পথে ইংরেজ উকেটকিপার জ্যাক রাসেল ও দক্ষিণ আফ্রিকান উইকেটকিপার এবি ডিভিলিয়ার্সের সঙ্গে একাসনে বসে গেলেন পন্ত।
ঋদ্ধির অবর্তমানে পন্ত না পার্থিব কাকে খেলানো উচিৎ? এই নিয়ে দ্বিবিভক্ত ছিলেন অনুরাগীরা। ব্যাট হাতে প্রথম টেস্টে আশার সঞ্চার না করতে পারলেও উইকেটের পিছনে পন্ত কিন্ত জানান দিয়ে গেলেন তিনি লম্বা রেসের ঘোড়া। ইংল্যান্ডের মাটিতে টেস্ট সিরিজে প্রথমবার সুযোগ পেয়েই শতরান হাঁকিয়ে নজর কেড়েছিলেন নির্বাচকদের। প্রথম ভারতীয় উইকেটকিপার হিসেবে ইংল্যান্ডের মাটিতে শতরান অযাচিতভাবেই তাঁকে সুযোগ করে দিয়েছিল ঘরের মাঠে পরবর্তী ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে। কিন্তু অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে টেস্ট সিরিজ জয়ে উইকেটের পিছনে কতটা কার্যকরী হতে পারবেন পন্ত? প্রশ্ন উঠছিলই।
মোক্ষম সময় তাঁর দায়িত্বজ্ঞানহীন ব্যাটিং চর্চায় উঠে এসেছে প্রথম টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংসের পর। তবে এগারো ক্যাচ তালুবন্দি করে পন্ত যেন জবাব দিলেন সব প্রশ্নের। পাঁচ দিনের ক্রিকেটে জাতীয় দলে তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ঋদ্ধিমানকেও এদিন টপকে যান পন্ত। এর আগে ১০টি ক্যাচ নিয়ে ভারতীয় হিসেবে রেকর্ড ছিল ঋদ্ধির ঝুলিতেই। তবে পঞ্চমদিন দ্বিতীয় সেশনে এককভাবে বিশ্বরেকর্ডের অধিকারী হওয়ার সুযোগ নিজেই হারান পন্ত। ন্যাথান লায়নের ক্যাচ ফস্কে জ্যাক রাসেল ও ডিভিলিয়ার্সকে টপকে যাওয়ার সুযোগ হাতছাড়া করেন বছর একুশের এই উইকেটকিপার। তাই প্রাক্তন দুই টেস্ট উইকেটরক্ষকের সঙ্গে একাসনে থেকেই সন্তুষ্ট থাকতে হয় পন্তকে।