কক্সবাংলা ডটকম(২৯ জানুয়ারী) :: তথ্য প্রযুক্তি আইন সংশোধন করে যে আইনের খসড়া অনুমোদন করা হয়েছে সেটিতেও এমন বেশি কিছু বিধান রাখা হচ্ছে যা নিয়ে সমালোচনা হতে পারে। প্রস্তাবিত আইনে কিছু বিধানের জন্যও সাংবাদিকতা করা কঠিন হয়ে যেতে পারে।
সোমবার মন্ত্রিসভার বৈঠকে জিডিটাল নিরাপত্তা আইনের খসড়ায় চূড়ান্ত অনুমোদন দেয় সরকার। এর আগে ২০১৬ সালের ২২ জুলাই খসড়াটি নীতিগতভাবে মন্ত্রিসভা অনুমোদন করে।
২০০৬ সালে করা তথ্য প্রযুক্তি আইনটি ২০০৯ এবং ২০১৩ সালে সংশোধন করার পর সেটিকে মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও সাংবাদিকদের স্বাধীনতা সংকুচিত করার অভিযোগ ছিল। বিশেষ করে ওই আইনের ৫৭ ধারা বাতিলে মানবাধিকার সংস্থাগুলোও নানা সময় দাবি জানিয়ে আসছিল।
এই ৫৭ ধারা বাতিল হবে জানালেও এই ধারাটি অন্যভাবে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনেও রয়ে গেছে। আবার তথ্য প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারাও যেভাবে ঢালাও ব্যবহারের সুযোগ ছিল, নতুন আইনও একইভাবে ব্যবহার করা যাবে বলে আশঙ্কা আছে।
মন্ত্রিপরিষদ সচিব শফিউল আলম জানান, এই আইনে যদি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে মনে হয় যে ডিজিটাল মাধ্যমে প্রকাশিত বা প্রচারিত তথ্য উপাত্ত দেশের বা কোন অংশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড, নিরাপত্তা, ধর্মীয় মুল্যবোধ বা জনশৃঙ্খলা ক্ষুন্ন করে বা জাতিগত বিদ্বেষ ও ঘৃণা সৃষ্টি করে তাহলেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তা অপসারণ বা ব্লকতে বিটিআরসিকে অনুরোধ করতে পারবে।
সচিব বলেন, আইসিটি অ্যাক্ট বা অন্যান্য আইনে যে ধরনের বিষয়গুলো নেই তা এই আইনে পুর্ণাঙ্গরুপে আনা হয়েছে। সাইবার রিলেটেড যত বিষয় আছে তার সবগুলো বিষয় এখানে থাকছে।
‘সাইবার ক্রাইমের আধিক্য অনেক বেশি হওয়ায় বাংলাদেশ ব্যাংকসহ বেশকিছু সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান আক্রান্ত হয়েছে। এটাকে মোকাবেলা করার জন্য দেশে কোন আইন ছিলো না। এজন্য এ নতুন আইনটি করা হয়েছে।
কঠিন হতে পারে সাংবাদিকতা
অনুমোদন করা আইনের খসড়ার ৩২ নম্বর ধারায় ধারায় বলা হয়েছে, ‘যদি কোনো ব্যক্তি বেআইনি প্রবেশের মাধ্যমে কোন সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্বশাসিত বিধিবদ্ধ সংস্থার কোন গোপনীয় বা অতি গোপনীয় তথ্য-উপাত্ত কম্পিউটার বা ডিজিটাল ডিভাইস বা কম্পিউটার নেটওয়ারর্কে ধারণ, প্রেরণ, সংরক্ষণ করেন বা করতে সহায়তা করেন তাহলে সেটা হবে গুপ্তচরবৃত্তির অপরাধ।’
এই ‘গুপ্তচরবৃত্তির’ সর্বোচ্চ শাস্তি ১৪ বছর জেল বা সর্বোচ্চ ২৫ লাখ টাকা জরিমানা।
সচিবালয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব শফিউল আলমের কাছেই সাংবাদিকরা জানতে চান এই বিধানের জন্য সাংবাদিকদের সমস্যায় পড়তে হবে কি না।
অনেক সময় সরকারি অফিস থেকে তথ্য নিয়ে সাংবাদিকরা সংবাদ পরিবেশন করেন-এটা গুপ্তচরবৃত্তির মধ্যে পড়বে কি না-এমন প্রশ্নে সচিব সহাস্যে বলেন, ‘না না, আমরা এখানে সাংবাদিক শব্দটি উচ্চারণ করিনি। সাংবাদিকদের কোন নাম উল্লেখ করা হয়নি। কোথাও সাংবাদিকদের টার্গেট করা হয়নি।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি মনজুরুল আহসান বুলবুল বলেন, ‘যারা প্রকৃত গুপ্তচরবৃত্তি করে। স্বাধীনতার বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালায়। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে। তাদের দমনে আইন হলে সেখানে আমাদের আপত্তি নেই। কিন্তু এসব আইনের আড়ালে যদি সাংবাদিকদের মতপ্রকাশককে দমন করা হয়। স্বাধীন সাংবাদিকতার কণ্ঠ রোধ করা হয় সেটা নিয়ে আমাদের উদ্বেগ আছে। পেশাদার সাংবাদিকরা যদি এই আইনের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হয় সেখানে আমাদের উদ্বেগ।
‘আইসিটি আইন করার সময়ও সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, এখানে সাংবাদিকরা হয়রনির শিকার হবেন না। কিন্তু পরে আমরা দেখেছি এই আইনে সাংবাদিকরা হয়রানির শিকার হয়েছে। আমরা সরকারকে আহ্বান জানাবো ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন সংসদে চূড়ান্তভাবে পাসের আগে যেন সিনিয়র সাংবাদিক ও সাংবাদিকতার শিক্ষক ও বিশিষ্টজনদের নিয়ে আলোচনা করা হয়। সাংবাদিকরা যাতে হয়রানির শিকার না হয় এমন আইন যাতে পাস হয়।’
আরও যা আছে
আবার আইনে ডিজিটাল বিন্যাসে মুক্তিযুদ্ধ, জাতির জনক বা মু্ক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী কোনো কিছু উপস্থাপন বা বিকৃত তথ্য দিলে ১৪ বছরের কারাদণ্ডের পাশাপাশি কোটি টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। তবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সংজ্ঞা কী হবে, সেটি জানাননি মন্ত্রিপরিষদ সচিব।
আবার অন্য একটি ধারায় বলা হয়েছে, ‘কোন ব্যক্তি গুরুত্বপূর্ণ সাইবার তথ্য পরিকাঠামোর মধ্যে অবৈধভাবে প্রবেশ করলে সর্বোচ্চ সাত বছরের কারাদণ্ড বা ২৫ লাখ টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। গুরুত্বপূর্ণ সাইবার তথ্য পরিকাঠামোতে অবৈধভাবে প্রবেশ করে ক্ষতিসাধন করলে সর্বোচ্চ শাস্তি ১৪ বছরের কারাদণ্ড এক কোটি টাকা অর্থ দণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।’
আবার ‘কম্পিউটার, কম্পিউটার সিস্টেম বা ডিজিটাল ডিভাইসে বেআইনিভাবে প্রবেশ করলে অপরাধ হবে। এজন্য সর্বোচ্চ এক বছরের কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ তিন লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড পেতে হবে।
কেউ অবৈধভাবে প্রবেশে সহায়তা করলে সর্বোচ্চ তিন বছরের কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
মন্ত্রিপরিষদ সচিবের বলেন, ‘যদি কোন ব্যক্তি কম্পিউটার, কম্পিউটার সিস্টেম ইত্যাদি থেকে তথ্য-উপাত্ত বা এর অনুলিপি সংগ্রহ করেন তাহলে তার এই কাজটা অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। এর শাস্তি সাত বছরের কারাদণ্ড বা ১০ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড হতে পারে।
‘যদি কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠী ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েবসাইট বা ইলেকট্রনিক মাধ্যমে এমন কিছু প্রকাশ বা প্রচার করেন যা ধর্মীয় মূল্যবাধে বা অনুভূতিতে আঘাত করে তাহলে শাস্তি ১০ বছরের জেল বা ২০ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড।’
‘যদি কোন ব্যক্তি ওয়েবসাইট বা ডিজিটাল বিন্যাসে এমন কোন কিছু প্রকাশ করেন বা করান যা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করে বা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে এই ধরনের অপরাধের জন্য শাস্তি সর্বোচ্চ ৭ বছরের কারাদণ্ড বা ৫ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড।’
আবার ওয়েবসাইট বা ডিজিটাল বিন্যাসে মানহানিরর সংজ্ঞা অনুযায়ী অপরাধ করলে সর্বোচ্চ তিন বছরের কারাদণ্ড বা পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হওয়ার বিধান রাখা হয়েছে।
ওয়েবসাইটে আক্রমণাত্মক বিষয় প্রচার বা ভীতি প্রদর্শনের শাস্তি রাখা হয়েছে তিন বছরের কারাদণ্ড বা তিন লাখ টাকা জরিমানা।
বাতিল হয়েও থাকছে ৫৭ ধারা
তথ্য প্রযুক্তি আইনের বিতর্কিত ৫৭ ধারার পাশাপাশি ৫৪, ৫৫, ৫৬, ও ৬৬ ধারা বিলুপ্ত হবে বলে জানান জানিয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব। তিনি বলে, ‘আগে ৫৭ ধারায় সব ছোট করে লেখা ছিল। এখন যেটা যে প্রকৃতির অপরাধ সে অনুযায়ী শাস্তি নির্ধারণ করা হয়েছে। তদন্ত কীভাবে করা হবে সেটা ডিটেইল করা হয়েছে, যেটা আগে ছিল না।’
২০০৬ সালে করা তথ্য প্রযুক্তি আইনটি ২০০৯ ও ২০১৩ সালে দুই দফা সংশোধন করা হয়। আর ২০১৩ সালে ৫৭ ধারায় সাজা ১০ বছর থেকে বাড়িয়ে ১৪ বছর কারাদণ্ড করা হয়। আর অপরাধকে করা হয় জামিনঅযোগ্য।
এই ধারায় বলা হয়, ‘কোনো ব্যক্তি যদি ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েবসাইটে বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন, যা মিথ্যা ও অশ্লীল বা সংশ্লিষ্ট অবস্থা বিবেচনায় কেউ পড়লে, দেখলে বা শুনলে নীতিভ্রষ্ট বা অসৎ হতে উদ্বুদ্ধ হতে পারেন অথবা যার দ্বারা মানহানি ঘটে, আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটে বা ঘটার আশঙ্কা সৃষ্টি হয়, রাষ্ট্র ও ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয় বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে বা করতে পারে বা এ ধরনের তথ্যাদির মাধ্যমে কোনো ব্যক্তি বা সংগঠনের বিরুদ্ধে উসকানি প্রদান করা হয়, তাহলে এ কাজ অপরাধ বলে গণ্য হবে।’
কিন্তু এই ধারাটি অনেক বেশি বিস্তৃত বলে ইচ্ছা করলে সমালাচনামুলক যে কোনো লেখাকেই এর আওতায় এনে বিচার করা সম্ভভ বলে সমালোচনা ছিল।
আর এই ধারাকে স্বাধীন সাংবাদিকতার পরিপন্থি দাবি করে সেটি বাতিলের দাবি জানিয়ে আসছেন গণমাধ্যমকর্মীরা। মানবাধিকার সংগঠনগুলোও একই মত পোষণ করে আসছিলেন।
আর আইনমন্ত্রী আনিসুল হক একাধিকবার বলেছিলেন ৫৭ ধারা থাকছে না ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে।
তবে প্রস্তাবিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে কিছু অপরাধকে জামিনযোগ্য ও কিছু ধারাকে জামিন অযোগ্য রাখা হয়েছে।
মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, প্রস্তাবিত আইনের ১৭, ১৯, ২১, ২২, ২৩, ২৪, ২৬, ২৭, ২৮, ৩০, ৩১, ৩২, ৩৩, ৩৪ ধারা হবে আমলযোগ্য ও জামিন অযোগ্য। আর ২০, ২৫, ২৯ ও ৪৮ ধারা অ-আমলযোগ্য ও জামিনযোগ্য।
হবে ডিজিটাল নিরাপত্তা এজেন্সি
ডিজিটাল নিরাপত্তার জন্য প্রস্তাবিত আইনে ডিজিটাল নিরাপত্তা এজেন্সি গঠনের কথা বলা হয়েছে। এর প্রধান হবেন মহাপরিচালক। তার অন্যান্য জনবল থাকবে।
মহাপরিচালকের আওতার মধ্যে কোন ডিজিটাল মাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য-উপাত্ত ডিজিটাল নিরাপত্তার ক্ষেত্রে কোন হুমকি সৃষ্টি করলে তিনি তা অপসারণ বা ব্লক করার জন্য বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনকে অনুরোধ করতে পারবেন।
এছাড়া ক্ষতিকর কোন তথ্য উপাত্ত অপসারণ বা ব্লক করার জন্য আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী বিটিআরটিসে অনুরোধ করতে পারবে।
খসড়া আইনে সার্বক্ষণিকভাবে দায়িত্ব পালনের জন্য ইমার্জেন্সি রেসপন্স টিম গঠন করার কথা বলা হয়েছে বলেও জানান মন্ত্রিপরিষদ সচিব।
Posted ২:১৩ পূর্বাহ্ণ | মঙ্গলবার, ৩০ জানুয়ারি ২০১৮
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta