কক্সবাংলা ডটকম(১ আগস্ট) :: অবৈধভাবে ইউরোপে প্রবেশে সাতটি রুট ব্যবহার করা হয়। এর সবগুলোই ব্যবহার করা হয় লিবিয়া কিংবা তুরস্ক থেকে ইউরোপ প্রবেশের জন্য। এ সাত রুটের মধ্যে ‘জনপ্রিয়’ কেন্দ্রীয় ভূমধ্যসাগরের রুট। এটি ব্যবহার করে লিবিয়া থেকে ইতালি যাওয়া নিরাপদ মনে করে অনিয়মিত অভিবাসীরা। তাই দালালের মিষ্টি কথায় প্রভাবিত হয়ে লাখ লাখ টাকা খরচ করে চলে যান লিবিয়া কিংবা তুরস্ক।
সেখান থেকে শুরু হয় ইউরোপ যাওয়ার মূল পর্ব। তবে এর আগেই কয়েক ধাপে শোধ করতে হয় টাকা। এ টাকার পরিমাণ এক থেকে চার লাখ টাকা। ইউরোপ যেতে মোট খরচ হিসেবে চাওয়া হয় ১০-১৪ লাখ টাকা। সেই টাকা আদায় করা হয় এমনকি শারীরিক নির্যাতন করেও।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, জুনের শেষ থেকে আগস্ট— এই তিন মাস সমুদ্রপথে ইতালি যাওয়ার প্রবণতা বেশি। কারণ এসময় সাগর কিছুটা শান্ত থাকে এবং ছোট ছোট নৌযান নিয়েই ইউরোপে পৌঁছানোর চেষ্টা করে সবাই।
লিবিয়ার উপকূল থেকে প্রায় ৩০০ কিমি দূরে ইতালির ল্যাম্পুসা দ্বীপ। ২০১১ সালের গণঅভ্যুথানের পর থেকে যুদ্ধবিধ্বস্ত লিবিয়ায় মানবপাচারের ব্যবসা জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে আর পাচার হওয়ার তালিকায় উঠে এসেছে বাংলাদেশিরা।
বাংলাদেশিদের খুব সহজে আটক করে মুক্তিপণ আদায় করা যায়। তাই লিবিয়ার মানবপাচারকারী চক্র বেছে নেয় বাংলাদেশিদের। তাদের সঙ্গে আঁতাত করে কমিশন নেয় কিছু বাংলাদেশি দালাল।
সমুদ্র পাড়ি দিয়ে লিবিয়া থেকে ইতালিতে যাওয়ার প্রবণতা সবচেয়ে বেশি। জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪ থেকে ২০১৭ সালে ১৭ লাখ ৬৬ হাজার ১৮৬ জন ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেন। এভাবে সাগরপথে ইউরোপ যেতে অন্তত ১৫ হাজার মানুষ প্রাণ হারান।
ইউরোপীয় কমিশনের পরিসংখ্যান বিষয়ক দফতর ইউরোস্ট্যাট-এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০০৮ থেকে ২০১৭ পর্যন্ত এক লাখেরও বেশি বাংলাদেশি ইউরোপের দেশগুলোতে অবৈধভাবে প্রবেশ করেছেন। এর মধ্যে ২০১৬ সালে ১৭ হাজার ২১৫ জন রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন করলে ১১ হাজার ৭১৫টি বাতিল করা হয়।
ইতালির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দেওয়া তথ্যমতে, কেন্দ্রীয় ভূমধ্যসাগর ব্যবহার করে ইতালিতে প্রবেশের হার দিন দিন বাড়ছে। ইউএনএইচসিআর-এর মতে, ভূমধ্যসাগর ব্যবহার করে ইউরোপে প্রবেশকারীর সংখ্যায় বাংলাদেশিদের অবস্থান চতুর্থ।
এছাড়া বাংলাদেশে অবস্থিত ব্রিটিশ হাইকমিশনের পৃষ্ঠপোষকতায় অভিবাসী কর্মী উন্নয়ন প্রোগ্রাম (ওকাপ) বাংলাদেশ থেকে ইতালির অনিয়মিত অভিবাসন প্রক্রিয়ার ওপর সম্প্রতি এক গবেষণায় উল্লেখ করেছে, বাংলাদেশ থেকে ভূমধ্যসাগর ব্যবহার করে লিবিয়া হয়ে ইতালি যাওয়ার মাত্রা চরম আকার ধারণ করেছে।
বিশেষ করে ২০১৬ ও ২০১৭ সালে এটি অনেক বেশি ছিল। এমনকি ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালি যাওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ দ্বিতীয় বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর তালিকায় ২০১৭ সালের প্রথমভাগে অবস্থান করে। গবেষণায় আরও বলা হয়, ৯৬.৭ শতাংশ অভিবাসী কেন্দ্রীয় ভূমধ্যসাগরের রুট ব্যবহার করে লিবিয়া উপকূল হয়ে ইতালি যায়।
সাভারের অন্তর আলী জমি-জমা, তিনটি গরু, স্ত্রীর গয়না বেচে সব টাকা দালালদের দেন ইউরোপ যাওয়ার আশায়। ২০১৬ সালের অক্টোবরে গ্রিসে যাওয়ার উদ্দেশে প্রথমে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় ইরাকে। এরপর তুরস্ক, সেখান থেকে গ্রিস। কখনও পায়ে হেঁটে, কখনও ছোট নৌকায় করে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে, আবার কখনও বা ছোট্ট একটা কনটেইনারের ভেতর ঢুকে যেতে হয়েছে। ইরাকে টুরিস্ট ভিসা নিয়ে গিয়ে এক মাসের বেশি থাকার সমস্যা হলেও দালাল তাকে বলেছিল কোনও সমস্যা হবে না।
অন্তর আলী জানান, যাওয়ার পথটা ছিল ভয়াবহ। প্রথমদিন দুবাই থেকে ইরাকের উদ্দেশে রওনা হওয়ার পর সেখানে আট ঘণ্টা থাকার পর দালাল নিয়ে যায়। সাত থেকে আট ঘণ্টা লাগে নাজাফ থেকে বাগদাদ যেতে। তিনি বলেন, ‘বাগদাদে এক রাত থেকে কিরকুকে নিয়ে গেলো। সেখানে ছিলাম চার দিন। রাতের বেলায় কুর্দিস্তান নিয়ে যায়। সেখানে একটা কারখানায় লেবারের কাজ করি কয়েকদিন। পরে সেখান থেকে তুরস্কের উদ্দেশে আবার রওনা হতে হয়।’
অন্তর আলী বলেন, ‘রাতের বেলায় পাহাড়ে পাহাড়ে হাঁটা লাগসে। সে কী পাহাড়, হাঁটতে হাঁটতে পায়ের চামড়া উঠে গেছে, হাত-পা কেটে রক্ত বের হয়ে সে কী অবস্থা! এখনও হাতে পায়ে কাটা দাগ আছে। এছাড়া হাতুড়ির আঘাতে কালো হয়ে গেছে নখ।’
তিনি বলেন, ‘এরপর এক গাড়িতে করে সাত ঘণ্টা ধরে জঙ্গলের ভেতরে নিয়ে গেলো, সেখানে তিন দিন ছিলাম। এই কয়দিনে দিনে-রাতে একবেলা খাওয়া পেতাম, সেটাও ছিল শুকনা একটা অথবা দুইটা রুটি। ভয়ে একেকজন কুঁকড়ে যেতাম, কিন্তু কারও কিছু করার ছিল না। সেখান থেকেই গ্রিসের পথে রওনা হলাম। রাতের বেলায় নৌকায় করে নদী পার হয়ে আবার আরেক জঙ্গল। সেই নদী পার হতে নেয় এক লাখ ২০ হাজার টাকা।
যে নৌকায় ১০-১৫ জন ধরার কথা সেখানে ওঠালো ৩০ জন। সেখানে বাংলাদেশিসহ অন্য দেশের লোকেরা ছিলও। ইরাক পর্যন্ত যেতে নিয়েছে চার লাখ ৪৮ হাজার টাকা। একেকটা জায়গা পার করেছে আর টাকা নিয়েছে। এভাবে মোট ১০ লাখ টাকা দিতে হয়েছে দালালকে। ধাপে ধাপে কয়েক জায়গায় টাকা দিতে হয়েছে। আমার দলের ১৫ জনের সবাই ছিলাম বাংলাদেশি। গ্রিসে যাওয়ার পর আমাদের আলাদা রুমে রাখা হয়েছিল। টাকা দিতে পেরেছিলাম বলে শারীরিক নির্যাতন করেনি।
কিন্তু যারা দিতে পারেনি তাদের মেরেছে, তারাও কিন্তু বাঙালি। ওই দেশের লোকের সঙ্গে মিলে তারা এসব কাজ করে, কিন্তু নাটের গুরুই হলো বাঙালি! এর মধ্যে তিনজনকে হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে আহত করে ফেললো। পাশের রুম থেকে সব শুনতাম আর ভয়ে একজন আরেকজনকে জড়ায়ে ধরতাম। যদি টাকা দিতে না পারতাম তাহলে আমাদের অবস্থাও তাদের মতো হতো।’
গ্রিসে যাওয়ার পর ছয় মাসের বেশি থাকতে পারেননি অন্তর আলী। ইউরোপজুড়ে ঘোষণা আসলো কাগজপত্র ছাড়া যেসব বাঙালি আছে তাদের ধরা হবে। এর আগে অন্তর আলীকে দেওয়া কার্ড রিনিউ করতে গেলে ধরা পরে যান। সেই অফিস তাকে পুলিশে দেয়। এরপর থানায় ১৫ দিন আর জেলে ছিলেন দুই মাস ছিলেন অন্তর আলী। জেলে গিয়ে জানতে পারেন এরপরও যদি সেখানে থাকতে চান, তাহলে জেল হবে এক বছরের। তারপরও কোনও নিশ্চয়তা নেই থাকার। গত বছর তিনি দেশে ফিরে আসেন।
অন্তর আলীর মতো অনেক বাংলাদেশি ইউরোপে যাওয়ার স্বপ্ন ভেঙে গেছে। পড়তে হয়েছে আর্থিক ক্ষতির মুখে। ঋণ শোধ করার জন্য বেছে নিয়েছেন স্বল্প আয়ের পেশা।
অভিবাসন সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, আইনের প্রয়োগ না থাকায় পার পেয়ে যাচ্ছে পাচারকারি চক্র। মামলা জট ও বিচারহীনতা এর পেছনে অনেকাংশে দায়ী। অভিবাসন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোও ভাবছে উত্তরণের উপায়।
প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, ৩১ জুলাই মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে শ্রম অভিবাসনের নামে মানবপাচার প্রতিরোধে এক আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা হয়। সভায় সুদান, লিবিয়া ও মিশরে কর্মী প্রেরণের ক্ষেত্রে ভিসা যাচাই-বাছাইয়ে কঠোর সতর্কতা অবলম্বনের সিদ্ধান্ত হয়। এছাড়াও ভিজিট ভিসার নামে বিভিন্ন দেশে কর্মসংস্থানের জন্য থেকে যাওয়া বিশেষ করে সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ অন্যান্য দেশের ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বনেরও সিদ্ধান্ত হয়।
ব্র্যাকের অভিবাসন প্রোগ্রামের প্রধান শরিফুল হাসান বলেন, ‘পাচারকারীদের চিহ্নিত করে যদি আমরা আইনের আওতায় না আনতে পারি তাহলে কীভাবে আমরা পাচার রোধ করবো? মানবপাচার বন্ধ করতে মানুষকে যেমন সচেতন হতে হবে তেমনি যে মামলাগুলো হয়েছে তার দ্রুত নিষ্পত্তির মাধ্যমে বিচারের ব্যবস্থা করতে হবে।’
সিআইডি’র ডিআইজি (স্পেশাল ইনভেস্টিগেশন এবং ইন্টেলিজেন্স) শাহ্ আলম বলেন, ‘মানবাপাচারকারীদের কাজ ঝুঁকিপূর্ণ করার জন্য আমরা কতটুকু উদ্যোগ নিয়েছি— এই প্রশ্নটা আমরা নিজেদের করতে পারি। একটা এনজিও যখন কাজ করে, যতটা তারা মনোযোগ দেয় কাজে যেমন তাকে ফিরিয়ে আনা, সহযোগিতা করা।
আরেকটি কাজ চাইলে তারা যুক্ত করতে পারে তা হলো সেই ভিক্টিমের কাছ থেকে স্টেটমেন্ট নিয়ে একটা মামলা করে দেওয়া। একটা মামলা হওয়া মানে তারা শেকলে আটকে গেলো। সিস্টেম তাকে খুঁজবে বছরের পর বছর। এটা সব সময় কাজে দেয় তা না, তবে কিন্তু একটা মেসেজ চলে যায়।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের ভালো ভালো আইন আছে। আমাদের মানি লন্ডারিং আইন আছে, মানবপাচার প্রতিরোধ আইন আছে। মানবপাচার যেহেতু একটি সংঘবদ্ধ ক্রাইম, এর একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে মুখ্য আয়ভোগী যারা তাদের খুব সামনে থেকে দেখতে পাবেন না। সামনে দেখবেন গ্রামের দালালকে। মামলা হয় তার বিরুদ্ধে।
আমরা গত তিন-চার বছর ধরে মুখ্য আয়ভোগীদের কীভাবে চিহ্নিত করতে হবে আমাদের ফরেনসিক ইন্সটিটিউট সিআইডি’র মাধ্যমে ডজন ডজন কর্মকর্তা তৈরি করছি। চেষ্টা করছি তদন্তের মান বাড়াতে। যাতে মুখ্য আয়ভোগীদের চিহ্নিত করা যায়, তাদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা যায়।’
Posted ১২:৫৪ অপরাহ্ণ | বুধবার, ০১ আগস্ট ২০১৮
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta