মোসলেহ উদ্দিন,উখিয়া(১১ ডিসেম্বর) :: উখিয়ার বিভিন্ন স্থানসহ লাগোয়া নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুমে অবৈধ ভাবে গড়ে তোলা হয়েছে ইট ভাটা। বনভূমির পাহাড় ও ফসলী জমির মাটি দিয়ে তৈরি করা হচ্ছে ইট। জ্বালানী হিসেবে যোগান দেওয়া হচ্ছে সংরক্ষিত বনাঞ্চলের মূল্যবান গাছগাছালি। ক্রমশ উজাড় হচ্ছে বনসম্পদ। গত ২০ বছর ধরে ঐ ইট ভাটার আশে পাশে নির্বিচারে বন জঙ্গল লুটপাট, পাহাড় কর্তনসহ নানাবিদ তান্ডবে বনভূমি লন্ডভন্ড হয়ে গেলেও দেখার কেউ নেই।
ইট ভাটার বিষাক্ত কালো ধোঁয়ায় আক্রান্ত এলাকাবাসী প্রশাসনের বিভিন্ন দপ্তরে অভিযোগ দেওয়ার পরও বহাল তবিয়তে চালিয়ে যাচ্ছে অবৈধ ইট তৈরির কার্যক্রম। গ্রামবাসীর অভিযোগ প্রভাবশালী চক্রের হাতে বনবিভাগের দুর্নীতি পরায়ন কর্তাব্যক্তিরা ম্যানেজ হওয়ার কারণে অবৈধ ইটভাটা কার্যক্রম বন্ধ হচ্ছে না।
সরেজমিন উখিয়া সদর থেকে রওনা হয়ে ৫ কিলোমিটার অদূরে ঘুমধুম ইউনিয়নের রেজু আমতলী এলাকায় গিয়ে দেখা যায় পাশাপাশি ৬টি ইট ভাটা। প্রকাশ্যে বোল্ড ড্রেজার দিয়ে পাহাড় কেটে মাটি আহরণ করা হচ্ছে। শত শত শ্রমিক বনসম্পদ কেটে জ্বালানী তৈরি করছে। শ্রমিকেরা থাকার জন্য নির্মাণ করা হচ্ছে আবাসস্থল। শ্রমিক হিসাবে ব্যবহার করা হচ্ছে রোহিঙ্গা নাগরিক।
বন সম্পদ উজাড় ও পাহাড় কেটে মাটি আহরণের ব্যাপারে জানতে চাওয়া হলে মোল্লা নামের ইট ভাটা ম্যানেজার জানান, তারা বনভূমি জায়গাটি পার্শ্ববর্তী বসবাসরত রাখাইন সম্প্রদায়ের লোকজন থেকে ২০ বছরের জন্য ৭০ লাখ টাকা চুক্তি সম্পাদন করে গত বছর থেকে ইট ভাটা তৈরির কাজ শুরু করেছে। পাশেই আরেকটি বিশাল বনভূমির এলাকায় একই অবস্থা পরিলক্ষিত হয়। এলাকাবাসী জানায়, এ ইটভাটার মালিক আলী আহমদ কোম্পানী।
সে জায়গাটি স্থানীয় একজন প্রভাবশালী ব্যবসায়ীকে ২০ বছরের জন্য দিয়ে দিয়েছে ইট তৈরি করার জন্য, বিনিময়ে প্রতিবছর তাকে ১০ লক্ষ টাকা করে দেওয়া হবে বলে ইট ভাটায় কর্মরত শ্রমিক মাঝি দেলোয়ার জানিয়েছেন। সেখানেও একই অবস্থা, ৪/৫টি বোল্ড ড্রেজার দিয়ে পাহাড় কেটে মাটি আহরণ করা হচ্ছে। ১০/১২টি ট্রাক ফসলী জমির মাটি কেটে ইট ভাটায় সরবরাহ করা হচ্ছে।
এদিকে হলদিয়াপালং ইউনিয়নের মরিচ্যা পাগলির বিল, গয়ালমারা, পাতাবাড়ী, ভালুকিয়াপালং, হলদিয়াপালংসহ উখিয়ার বিভিন্ন স্থানে প্রায় ১২টি ইট ভাটায় ইট তৈরি হচ্ছে যুগ যুগ ধরে। পাহাড় কেটে মাটি দিয়ে ইট তৈরি ও বনাঞ্চলের বন সম্পদ ধ্বংস করে ইট তৈরি করা হলেও দেখার কেউ নেই। ২০১৬ সালে তুমব্রু চাইল্যা তলী এলাকায় অবৈধ ভাবে প্রতিষ্ঠিত ইসহাক সওদাগরের মালিকানাধীন ইট ভাটায় জ্বালানির যোগান দিতে গিয়ে ২ জন রোহিঙ্গা শিশু ঘটনাস্থলে মারা যায়।
খবর পেয়ে তৎকালীন নাইক্ষ্যংছড়ি নির্বাহী কর্মকর্তা উক্ত ইট ভাটায় অভিযান চালিয়ে ইট ও ইট তৈরির সরঞ্জাম জব্দ করে ইট ভাটা সিলগালা করে দেয়।
চলতি বছরে ওই ইট ভাটায় গিয়ে দেখা যায়, পুরো দমে ইট তৈরির কাজ চলছে। এছাড়াও বড়বিল এলাকায় দেলোয়ার হোসেনের মালিকানাধীন আরো একটি ইট ভাটায় ইট তৈরির জন্য যোগান দেওয়া হচ্ছে পাহাড় কাটা মাটি। সেখানে মজুদ রাখা হয়েছে বিপুল পরিমাণ লাকড়ি।
স্থানীয় গ্রামবাসী ফরিদুল আলম, ইয়াকুব আলীসহ আরো বেশ কয়েকজন জানান, ইট ভাটার কারণে পার্শ্ববর্তী গ্রামের প্রায় শতাধিক পরিবার বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়েছে। নষ্ট হয়েছে নানা রকম শাকসবজ্বি ও ফলবান বৃক্ষ। ইট ভাটার কালো ধোঁয়ায় পরিবেশ দূষণের ব্যাপারে গ্রামবাসী ও ইট ভাটা মালিকের ভয়ে মুখ খুলছে না।
তবে ঘুমধুম ইউনিয়নের চেয়ারম্যান একে জাহাঙ্গীর আজিজ জানান, চাইল্যাতলী ও বড়বিল এলাকায় প্রতিষ্ঠিত দুটি ইট ভাটা এলাকার সার্বিক পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি করেছে।
তিনি বলেন, ঘুমধুম ইউনিয়নে অবৈধ ভাবে গড়ে উঠা এসব ইটভাটার কারণে পাহাড় কাটা, বন সম্পদ ধ্বংসের তান্ডবলীলা চলছে। তিনি এব্যাপারে নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা পরিষদের মাসিক সমন্বয় সভায় যত্রতত্র ইট ভাটা তৈরির বিষয়টি উত্থাপন করে অবৈধ ইট ভাটা বন্ধের জোরালো দাবী জানাবেন বলে সাংবাদিকদের আশ্বাস্ত করেছেন।
কক্সবাজার পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারি পরিচালক সাইফুল ইসলাম জানান, সংশোধিত আইনে সংযোজিত পরিবেশ ও জীববৈচিত্র সংরক্ষণ ও উন্নয়নের স্বার্থে আধূনিক প্রযুক্তির ইট ভাটা অর্থাৎ জিগজাগ কিলন, টানেল কিলন বা অনুরূপ উন্নততর প্রযুক্তিতে ইট ভাটা স্থাপন করতে হবে। কৃষি জমি বা পাহাড় বা ঢিলা থেকে মাটি কেটে বা সংগ্রহ করে ইটের কাচাঁমাল হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না।
কর্তৃপক্ষের অনুমোদনক্রমে ইট তৈরি করার জন্য মজা পুকুর, খালবিল, নদনদী, চরাঞ্চল বা পাহাড় কেটে মাটি সংগ্রহ করা যাবে না। মাটির ব্যবহার কমানোর জন্য কমপক্ষে ৫০ শতাংশ ফাঁপা ইট তৈরি করতে হবে। নির্ধারিত মান মাত্রায় কয়লা ব্যবহার করতে হবে।
যেসব জায়গায় ইটভাটা স্থাপন করা যাবে না সেগুলো হচ্ছে উপজেলা সদর, সরকারি বা ব্যক্তিমালিকানাধীন বন, অভয়ারণ্য বাগান বা কৃষি জমি, পরিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা, নিষিদ্ধ এলাকার সীমা রেখা থেকে নূন্যতম ১ কিলোমিটার দূরত্বের মধ্যে ইট ভাটা করা যাবে না।
পার্বত্য জেলায় পরিবেশ উন্নয়ন কমিটির নির্ধারিত স্থানছাড়া অন্যকোন স্থানে ইট ভাটা তৈরি সম্পূর্ণ নিষেধ রয়েছে। তিনি জানান, বান্দরবানের বিভিন্ন স্থানে প্রায় ২৫টি ইট ভাটা রয়েছে। যার একটিও নীতিমালায় পড়ে না।
উখিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ নিকারুজ্জামান জানান, উখিয়ায় যে সমস্ত ইট ভাটা রয়েছে ওই সমস্ত ইট ভাটা গুলো বৈধতা আছে কিনা এবং যেসব এলাকায় ইট ভাটা গুলো প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে ওই সব এলাকার পরিবেশ ইট ভাটা নীতিমালার বর্হিভুত কিনা তা যাচাই করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
Posted ৪:২৯ অপরাহ্ণ | সোমবার, ১১ ডিসেম্বর ২০১৭
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta