কক্সবাংলা ডটকম(২৮ মার্চ) :: মহাকাশ গবেষণার দ্রুত এগিয়ে চলেছে ভারত। গত ৫ বছরে এই গতি আরও বেড়েছে। মঙ্গলযান অভিযান সফল হয়েছে। গগনযান অভিযান শুরু করা হয়েছে। এখনও পর্যন্ত ভারত মহাকাশে ১০২ অভিযান চালিয়েছে। এরপর বিশ্বকে ভারতের দেখিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন ছিল যে ভারত মহাকাশেও লড়াই করার ক্ষমতা রাখে।বুধবার এস্যাট মিসাইলের সফল পরীক্ষা করল ভারত।এনিয়ে গোটা বিশ্বেই শোরগোল সৃষ্টি হয়েছে।
মাত্র ৩ মিনিটেই মহাকাশে নির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুকে ধ্বংস করে গোটা বিশ্বকে চমকে দিল ভারত। এর ফলে মহাকাশে যে কোনও শত্রু উপগ্রহকে চিহ্নিত করে ধ্বংস করার ক্ষমতা যে আমাদের রয়েছে তা বিশ্বকে জানিয়ে দিল ভারত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চিন ও রাশিয়ার পর বিশ্বে এই ক্ষমতার অধিকারি হল ভারত।
এই পরীক্ষায় মহাকাশে ব্যবহার করা হয়েছিল ডিআরডিও-র ব্যালেস্টিক মিসাইল ডিফেন্স ইন্টাসেপ্টর। গোটা পরীক্ষাটি করা হয়েছিল মহাকাশের একেবারে নিচের কক্ষপথে। তাই মহাকাশে ওই ধরনের কোনও বর্জ্য তৈরির সম্ভাবনা নেই। তাই পরীক্ষার ফলে যেসব বর্জ্য তৈরি হয়েছে তার অধিকাংশই ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। বাকী যেটুকু রয়েছে তা এক সপ্তাহের মধ্যে পৃথিবীতে এসে পড়বে।
ক্ষেপণাস্ত্রটির সাফল্য নিয়ে একশো শতাংশ নিশ্চিত হওয়ার পরই তা পরীক্ষা করা হয়েছে। এই ধরনের কোনও লড়াইয়ে নামার ইচ্ছে ভারতের নেই। ভারত বরাবরই বলে এসেছে মহাকাশকে নিরাপদ রাখতে হবে। মহাকাশকে কোনও লড়াই থেকে বাইরে রাখতে ভারত চুক্তিবদ্ধ(১৯৬৭)। তাই মহাকাশে কোনও লড়াইয়ে নেই ভারত। মহাকাশে কোনও রকম ব্যাপক বিধ্বংসী অস্ত্র ব্যবহার করা যায় না। তবে সাধারণ অস্ত্রের ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা নেই। ভারত কোনও আন্তর্জাতিক আইন ভঙ্গ করেনি।কোনও বিশেষ দেশকে উদ্দেশ্য করে এই পরীক্ষা করা হয়নি। তবে দেশের নিরাপত্তা সুরক্ষিত করতে ভারত প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
ধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বুধবার ঘোষণা করেছেন ভারত পৃথিবীর চতুর্থ দেশ হিসেবে মহাকাশে সাফল্যের সঙ্গে উপগ্রহঘাতী মিসাইলের সাহায্যে উপগ্রহ ধ্বংস করেছে।উপগ্রহঘাতী অস্ত্র রয়েছে এমন হাতে গোনা কয়েকটি দেশের অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়ল ভারত। কেবলমাত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চিন এবং রাশিয়া তাদের এই ক্ষমতা এতদিনে প্রদর্শন করেছে। ইজরায়েলের হাতেও এই ক্ষমতা রয়েছে বলে মনে করা হয়, তবে তারা কখনও তা প্রয়োগ করেনি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, “কিছুক্ষণ আগে আমাদের বৈজ্ঞানিকরা একটি জীবন্ত স্যাটেলাইটে আঘাত হেনেছেন। এই লক্ষ্যবস্তু পূর্বনির্ধারিত ছিল এবং একটি এ স্যাটের সাহায্যে একে নষ্ট করা হয়েছে। তিন মিনিটে অপারেশন শেষ হয়েছে। মিশন শক্তি একটি জটিল অপারেশন এবং এর জন্য অত্যন্ত উঁচু মানের প্রযুক্তিগত সক্ষমতা প্রয়োজন।”
এদিকে, এ-স্যাট ক্ষেপণাস্ত্রের উত্ক্ষেপণের ভিডিও প্রকাশ করল ডিআরডিও। সেই ভিডিও টুইট করেছে সংবাদসংস্থা এএনআই। ভিডিওটি দেখা যাচ্ছে, কাউন্টডাউন শেষ হওয়ার পরই অত্যন্ত মসৃণ ভাবে বুলেটের মতো দেখতে ক্ষেপণাস্ত্রটি লক্ষ্যবস্তুর উদ্দেশ্যে উড়ে যায়। এরপর সেটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যে মাইক্রোস্যাট-আর স্যাটেলাইটকে ধ্বংস করে বলে কোনও কোনও মহল থেকে দাবি করা হয়েছে।
বিভিন্ন দেশ ন্যাভিগেশন, যোগাযোগ, এবং মিসাইল অস্ত্রাগার গাইডেন্সের জন্য উপগ্রহ ব্যবহার করে থাকে। এর দ্বারা শত্রুপক্ষের মিসাইলে আঘাত হানা যায়, যার জেরে অন্য দেশের পরিকাঠামোকে পঙ্গু করে দেওয়া যায়, তাদের অস্ত্রকে অকার্যকর করে ফেলা যায়।
গত শতাব্দীর সাতের দশকে, ঠান্ডা যুদ্ধ যখন তুঙ্গে, সে সময়েই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন তাদের অ্যান্টি স্যাটেলাইট মিসাইলের পরীক্ষা চালিয়েছিল। তবে কোনও দেশই অন্যের বিরুদ্ধে ভুল করেও এ মিসাইল ব্যবহার করেনি।
সব দেশই তাদের নিজেদের যে সব উপগ্রহ আর কার্যকর নেই, তার উপরেই এ ধরনের পরীক্ষা চালিয়ে থাকে। বিদেশমন্ত্রকের তরফ থেকে জারি করা এক বিবৃতিতে জানানো হয়েছে, এ পরীক্ষার জন্য লক্ষ্যবস্তু হিসেবে ভারতীয় উপগ্রহকেই বেছে নেওয়া হয়েছিল, তবে ঠিক কোন উপগ্রহের উপর আঘাত হানা হয়েছিল, তা নির্দিষ্ট করে জানানো হয়নি।
অ্যান্টি স্যাটেলাইট পরীক্ষা অত্যন্ত বিতর্কিত বিষয়। এর ফলে মহাকাশে সশস্ত্রীকরণ হচ্ছে বলে মনে করা হয়, যা ১৯৬৭ সালের আউটার স্পেস ট্রিটি অনুসারে নিষিদ্ধ।প্রধানমন্ত্রী মোদী ভারতের যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন করে জানিয়ে দিয়েছেন এ পরীক্ষা একেবারেই পরীক্ষামূলক, এবং মহাকাশের সশস্ত্রীকরণ নিয়ে ভারতের যে তীব্র বিরোধিতামূলক অবস্থান রয়েছে, তার নড়চড় হচ্ছে না।
তিনি বলেছেন, “আজ আমরা আমরা কৃষি, প্রতিরক্ষা, বিপর্যয় মোকাবিলা, যোগাযোগ, বিনোদন, আবহাওয়া, ন্যাভিগেশন, শিক্ষা সহ সব বিষয়ে মহাকাশ ও উপগ্রহ ব্যবহার করছি। এই পরিস্থিতিতে এই উপগ্রহগুলির নিরাপত্তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।”
প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আমি সারা বিশ্বকে জানাতে চাই যে আমাদের নয়া শক্তি কাউকে আঘাত করার জন্য নয়। এটি ভারতের দ্রুতগতিতে বর্ধমান প্রতিরক্ষা শক্তিরই অঙ্গ। ভারত চির কাল মহাকাশ সশস্ত্রীকরণের বিরোধিতা করে এসেছে এবং আজকের পরীক্ষা সে অবস্থানের বিরোধিতা করছে না। আজকের পরীক্ষা কোনও আন্তর্জাতিক আইন বা চুক্তি লঙ্ঘন করছে না। আমরা এই আধুনিক প্রযুক্তি নিরাপত্তা এবং ১৩০ কোটি ভারতীয়ের মঙ্গলের জন্য ব্যবহার করব। এই অঞ্চলের নিরাপত্তার জন্যই এক শক্তিশালী ভারতের প্রয়োজন। যুদ্ধের বাতাবরণ তৈরি নয়, শান্তি নিশ্চিত করাই আমাদের উদ্দেশ্য।”
বিদেশমন্ত্রকের বিবৃতিতে বলা হয়েছে এই পরীক্ষা ভারতের নিজের মহাকাশ সম্পদের সুরক্ষার জন্যই করা হয়েছে। বিদেশমন্ত্রকের তরফ থেকে বলা হয়েছে, “নিজেদের মহাকাশ সম্পদের সুরক্ষায় ভারতের সামর্থ্য বিচার করার জন্যই এই পরীক্ষা করা হয়েছে। মহাকাশের নিজের দেশের স্বার্থরক্ষা করা ভারত সরকারের দায়িত্ব। সাফল্য সম্পর্কে সুনিশ্চিত হয়েই এই পরীক্ষা করা হয়েছে, এবং এর ফলে ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা বৃ্দ্ধি নিয়ে সরকারের আগ্রহ সূচিত করে। ২০১৪ সালের পর থেকে মহাকাশ উন্নয়নে ভারতের অগ্রগতি পরিলক্ষিত হয়েছে।” ভারতের “মহাকাশে অস্ত্র প্রতিযোগিতায় প্রবেশ করার কোনও উদ্দেশ্য নেই” বলে জানিয়ে দিয়েছে বিদেশমন্ত্রক।
রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছিল না বলেই ২০০৭ সালে হয়নি ‘মিশন শক্তি’: প্রাক্তন ইসরো প্রধান
ডিআরডিও’র প্রাক্তন প্রধানের পর ইসরোর প্রাক্তন প্রধান৷ কংগ্রেসকে অস্বস্তিতে ফেলে প্রাক্তন ইসরো প্রধান জি মাধবন নায়ের জানান, এক দশক আগেই ভারত মহাকাশে ক্ষেপনাস্ত্র পাঠিয়ে স্যাটেলাইট ধ্বংস করতে পারত৷ সেই যোগ্যতায় পৌঁছে গিয়েছিল দেশের মহাকাশ গবেষণা৷ কিন্তু তখন রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছিল না৷
মহাকাশে অ্যান্টি স্যাটেলাইট ক্ষেপনাস্ত্র পাঠিয়ে কৃত্রিম উপগ্রহ ধ্বংস করেছে ভারত৷ বিশ্বের চর্তুথ দেশ হিসাবে এই কৃতিত্ব এখন ভারতের দখলে৷ তারপর থেকে বিরোধীদের দাবি, ‘মিশন শক্তি’র সাফল্যের কৃতিত্ব শুধুমাত্র বিজ্ঞানীদের৷ মোদীর নন৷ কিন্তু ডিআরডিও ও ইসরোর প্রধানদের মন্তব্য অন্য কথাই বলছে৷
এদিনই ডিআরডিও’র প্রাক্তন প্রধান দাবি করেন, ২০১৩-১৪ সালে ইউপিএ সরকার এই প্রজেক্টের কাজ আটকে দিয়েছিল৷ নইলে ভারতের মুকুটে তখনই মহাকাশ বিশ্বে সুপারপাওয়ার হওয়ার পালক যুক্ত হত৷ একই কথা শোনা গেল ইসরোর প্রাক্তন প্রধানের গলাতে৷ তাঁর দাবি, ২০০৭ সালে প্রযুক্তিগত দিক থেকে ভারত সেই উচ্চতায় পৌঁছে গিয়েছিল৷ সেই সময় ভারত মহাকাশে মিশাইল পাঠিয়ে স্যাটেলাইট গুড়িয়ে দিয়ে আসতে পারত৷ তাহলে তখন কেন এই প্রকল্প সাফল্যের মুখ দেখল না? প্রশ্ন ওঠায় প্রাক্তন ইসরো প্রধান বলেন, রাজনৈতিক সদিচ্ছা না থাকলে এত বড় ধরনের পরীক্ষা করা সম্ভব নয়৷
বিরোধীরা যতই দাবি করুক মিশন শক্তির কৃতিত্ব মোদীর নয়, বিজ্ঞানীদের কিন্তু বিরোধীদের এই জায়গাতেই আঘাত হেনেছেন জি মাধবন নায়ের৷ তাঁর মতে, এই ধরনের পরীক্ষার জন্য উদ্যোগ, সাহস ও সদিচ্ছা থাকা দরকার৷ যেটা মোদী করে দেখিয়েছেন৷
তিনি বলেন, ‘‘মোদী উদ্যোগ নিয়েছেন৷ তিনি সদিচ্ছা ও সাহস দেখিয়েছেন৷ বিজ্ঞানীদের এগিয়ে যাওয়ার উৎসাহ দেখিয়েছেন৷ তাই আজ গোটা বিশ্ব ভারতের ক্ষমতা দেখেছে৷ মহাকাশেও ভারত এখন সুপার পাওয়ার৷’’
২০০৩ সাল থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত জি মাধবন নায়ের ইসরোর প্রধান ছিলেন৷ সেই সময় কেন্দ্রে ক্ষমতায় ছিল কংগ্রেস পরিচালিত ইউপিএ সরকার৷