কক্সবাংলা ডটকম(১০ মে) :: বিশ্বের ৫৭তম দেশ হিসেবে মহাকাশে নিজস্ব স্যাটেলাইট ওড়ানোর তালিকায় নাম উঠানোর সব প্রস্তুতি শেষ বাংলাদেশের। যুক্তরাষ্ট্রের স্থানীয় সময় ১০ মে বিকাল ৪টা ১৫ মিনিটে (বাংলাদেশ সময় ১০ মে, দিনগত রাত ২টা ১৫ মিনিটে) ফ্লোরিডার অরল্যান্ডোর কেপ কেনেডি সেন্টারের লঞ্চিং প্যাড থেকে মহাকাশে উড়বে বাংলাদেশের প্রথম স্যাটেলাইট বঙ্গবন্ধু-১। এটাকে মহাকাশে নিয়ে যাবে স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণকারী প্রতিষ্ঠান স্পেসএক্স-এর ফ্যালকন ৯ রকেটের সর্বশেষ সংস্করণ ব্লক-৫। কোম্পানিটির আশা, এর মধ্য দিয়ে নতুন অধ্যায়ের সূচনা হবে।
স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের বিষয়ে তারানা হালিম বলেন, ‘১০ মে যুক্তরাষ্ট্রের স্থানীয় সময় বিকাল চারটা ১৫ মিনিটে স্যাটেলাইটের উৎক্ষেপণ হবে। তিন মিনিটের মধ্যে ( ১৬২ সেকেন্ড) উৎক্ষেপণ শেষ হবে। এরপর রকেটে করে স্যাটেলাইটটি মহাকাশের পথে (বাংলাদেশের ভাড়া নেওয়া অরবিটার স্লট ১১৯.৯ ডিগ্রিতে) যাবে।
এপর্যন্ত কয়েকবার স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের তারিখ বদলানো হয়েছে। প্রথমে বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট ২০১৭ সালের ১৬ ডিসেম্বরে উৎক্ষেপণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়। পরে নতুন তারিখ ঠিক হয় এ বছরের ১ মার্চ। সেই সম্ভাব্য তারিখও পরিবর্তন হয়। এরপর নতুন তারিখ নির্ধারণ হয় মার্চের শেষ সপ্তাহ বা ২৬ থেকে ৩১ মার্চের মধ্যে যেকোনও দিন স্যাটেলাইট উড়বে মহাকাশে। এরপর আরও কয়েকদফা দিনক্ষণ পাল্টে অবশেষে আজ (বৃহস্পতিবার) উৎক্ষপণের চূড়ান্ত সময় নির্ধারণ করা হয়েছে।
বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের মুহূর্তটি বাংলাদেশ টেলিভিশনসহ দেশের সব কটি বেসরকারি টেলিভিশন সরাসরি সম্প্রচার করবে। দুর্লভ এ মুহূর্ত সরাসরি প্রচারের ব্যবস্থা নিতে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ দেশের সব জেলা ও উপজেলা প্রশাসনকে নির্দেশ দিয়েছে। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণকারী প্রতিষ্ঠান স্পেসএক্সও উৎক্ষেপণ মুহূর্তটি সরাসরি সম্প্রচার করবে।
বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইটটি নির্মাণ করেছে ফ্রান্সের ‘থ্যালাস অ্যালেনিয়া’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান। স্যাটেলাইটের কাঠামো তৈরি, উৎক্ষেপণ, ভূমি ও মহাকাশের নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা, ভূ-স্তরে দুটি স্টেশন পরিচালনার দায়িত্ব এ প্রতিষ্ঠানটির।
এই প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ২ হাজার ৯৬৭ কোটি টাকা। স্যাটেলাইটে থাকছে ৪০টি ট্রান্সপন্ডার। এগুলোর মধ্যে প্রাথমিকভাবে ২০টি ব্যবহার করবে বাংলাদেশ। অন্যগুলো ভাড়া দেওয়া হবে। স্যাটেলাইট বঙ্গবন্ধু-১ এর গ্রাউন্ড স্টেশন তৈরি করা হয়েছে গাজীপুর ও রাঙ্গামাটিতে।
বাংলাদেশে প্রথম স্যাটেলাইট নিয়ে কাজ শুরু হয় ২০০৭ সালে। সে সময় মহাকাশের ১০২ ডিগ্রি পূর্ব দ্রাঘিমাংশে কক্ষপথ বরাদ্দ চেয়ে জাতিসংঘের অধীন সংস্থা আন্তর্জাতিক টেলিযোগাযোগ ইউনিয়নে (আইটিইউ) আবেদন করলেও বাংলাদেশের ওই আবেদনের ওপর ২০টি দেশ আপত্তি জানায়। এরপর ২০১৩ সালে রাশিয়ার ইন্টারস্পুটনিকের কাছ থেকে বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইটের বর্তমান কক্ষপথটি কেনা হয়।
উল্লেখ্য, ১১৯ দশমিক ১ ডিগ্রির অরবিটাল স্লটে (নিরক্ষরেখায়) উড়বে বাংলাদেশের নিজস্ব প্রথম স্যাটেলাইট বঙ্গবন্ধু-১। বঙ্গবন্ধু-১ উৎক্ষেপণের জন্য ইন্টারস্পুটনিকের কাছ থেকে ১৫ বছরের জন্য অরবিটাল স্লট বা নিরক্ষরেখা (১১৯ দশমিক ১ ডিগ্রি) লিজ নিয়েছে বাংলাদেশ। ২ কোটি ৮০ লাখ ডলার ব্যয়ে এ স্লট বরাদ্দ নেওয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) সঙ্গে রাশিয়ার ইন্টারস্পুটনিক ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন অব স্পেস কমিউনিকেশনের মধ্যে একটি চুক্তি সই হয়। চুক্তি অনুযায়ী বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ হওয়ার কথা ছিল ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে। কিন্তু প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে সে সময় উৎক্ষেপণ সম্ভব হয়নি।
ইন্টারস্পুটনিকের সঙ্গে ১৫ বছরের চুক্তি হলেও এ চুক্তি তিন ধাপে ৪৫ বছর পর্যন্ত বাড়ানো যাবে। এই প্রকল্পে সরকারের যে টাকা খরচ হবে, তা স্যাটেলাইট ভাড়া দিয়ে আট বছরে তুলে এনে এই প্রকল্পকে লাভজনক পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
এর আগে আন্তর্জাতিক টেলিযোগাযোগ ইউনিয়ন (আইটিইউ) বাংলাদেশকে নিরক্ষরেখার ১০২ ডিগ্রি স্লট বরাদ্দ দেয়। কিন্তু প্রভাবশালী দেশ যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, ফ্রান্স, অস্ট্রেলিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যসহ এশিয়ার কয়েকটি দেশ তাতে বাধা দেয়। দেশগুলোর আপত্তির মুখে বাংলাদেশ বিকল্প উপায় খুঁজতে থাকে। বিকল্প হিসেবে ৬৯ ডিগ্রিতে স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের প্রস্তাব দেওয়া হয় বাংলাদেশকে। কিন্তু বিকল্প প্রস্তাবেও আপত্তি তোলে মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর ও চীন।
সর্বশেষ ১১৯ দশমিক ১ ডিগ্রিতে (পূর্ব) স্লট বরাদ্দ পাওয়া যায়। কিন্তু এই স্লটটিও খালি ছিল না। স্লটটি ছিল ইন্টারস্পুটনিকের। কিন্তু অর্থের সংস্থান না হওয়ায় রাশিয়ার মহাকাশবিষয়ক প্রতিষ্ঠান ইন্টারস্পুটনিকের নিজস্ব দুটি স্লটের বিপরীতে (৮৪ ও ১১৯ দশমিক ১ ডিগ্রি) দুই মাসের একটি শর্তহীন চুক্তি করে বাংলাদেশ সরকার।
প্রকল্প শুরুর আগেই বিদেশি বিশেষজ্ঞ বা পরামর্শক নিয়োগ এবং প্রকল্প গবেষণায় সরকারের ব্যয় হয় ৮৬ কোটি টাকা। এই টাকা সরকার নিজস্ব তহবিল থেকে খরচ করেছে।
স্পেসএক্স’র ফ্যালকন ৯ রকেটের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ক্রেতা নাসা। ২০১০ সালে প্রতিষ্ঠানটির পাঠানো প্রথম রকেটের ক্রেতাও ছিল নাসা। এরপর টানা ৩টি মিশনে যায় ফ্যালকন ৯। লুক্সেমবার্গের এসইএস প্রথম স্পেসএক্সের হয়ে অপারেট করা শুরু করে। ২০১৩ সালের সাফল্যের পর গত বছরও স্পেসএক্সকে সমর্থন দেয় এসইএস।
বৃহস্পতিবার স্পেসএক্স’র সবচেয়ে আধুনিক রকেট ফ্যালকন-৯ ব্লক-৫ ব্যবহার করে মহাকাশে স্যাটেলাইট পাঠাচ্ছে বাংলাদেশ। এই রকেটটি নাসা ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা দফতরের সবক’টি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হর্য়েছে। প্রথমবারের মতোই ১০টি ফ্লাইট করতে পারে রকেটটি। আগের রকেটগুলো মাত্র ২ থেকে ৩টি উড্ডয়নে সক্ষম ছিল।
স্পেসএক্স-এর ওপর ভরসা রেখেছে নাসা ও এসইএস-এর মতো বড় প্রতিষ্ঠানগুলোও। বাংলাদেশের সাড়ে তিন হাজার কেজি ওজনে স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের মধ্য দিয়ে স্পেসএক্স নতুন কিছু শুরু করছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। প্রতিষ্ঠানটির ৫৪তম ফ্যালকন-৯ হলেও তাদের আশা নতুন অধ্যায়ের সূচনা এটি।
তবে বাংলাদেশ কীভাবে স্পেসএক্স-এর ক্রেতা হলো? প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় বলেন, ‘সত্যিকার অর্থে, এটা যেন কীভাবে হয়ে গেল। মূলত এটা স্পেসএক্স-এরই পছন্দ ছিল। আর আমরা তাতে রাজি হয়ে যাই।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে আরও বলেন, বিটিআরসি দরপত্র আহ্বান করেছিল। বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইটের জন্য রকেট ও ব্যাকআপ দুটিই খুঁজছিল তারা। দরপত্র অনুযায়ী স্যাটেলাইট বহনের জন্য থেলস অ্যালেনিয়া স্পেস রকেট হিসেবে এয়ারলাইনস্পেসের আরিয়ানা ফাইভকে তালিকাভুক্ত করা হয়। দ্বিতীয় পছন্দে ছিল স্পেসএক্স’র ফ্যালকন-৯।
কিন্তু বাংলাদেশ নির্দিষ্ট সময়ে স্যাটেলাইটটি উৎক্ষেপণ করতে চেয়েছিল। এই সময়সীমাই স্পেসএক্সকে সুবিধাজনক অবস্থানে নিয়ে আসে। বিক্ষোভের মুখে পড়ে আরিয়ানস্পেস দুই মাসে তাদের তিনটি মিশন পিছিয়ে দেয়। বাংলাদেশ ২০১৭ সালের ১৬ ডিসেম্বর স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করতে চাইলেও আরিয়ানস্পেস এই বিষয়ে নিশ্চয়তা দিতে পারেনি।
আরিয়ান-৫ রকেট মূলত দুটি স্যাটেলাইট বহন করতে পারে। একটি ওপরে এবং ছোট একটি নিচে।
সজীব ওয়াজেদ বলেন, আমাদের স্যাটেলাইটের আকারের কারণে তা আরিয়ান-৫ রকেটের নিচের অংশে শুধু বসানো যায় এবং তারা সময়ের ব্যাপারে আমাদের নিশ্চয়তা দিতে পারছিল না। ফলে আমরা বিকল্প খুঁজি। স্পেসএক্স আমাদের প্রস্তাব দেয় ফ্যালকন-৯ ব্লক-৫ ব্যবহার করার, আমরা তাতে রাজি হই।
অবশ্য স্পেসএক্সও বিটিআরসির দেওয়া সময়ে স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করতে পারেনি। ২০১৭ সালে ১৮টি মিশনে সফল হলেও বাংলাদেশের স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করতে পারেনি তারা। সজীব ওয়াজেদ বলেন, ‘বিজয় দিবসকে ঘিরে সবারই আশা ছিল। আমি বলেছিলাম সম্ভব হবে না। তারপরও চেষ্টা করে দেখি।’
বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইটে ২৬টি কু-ব্যান্ড ট্রান্সপন্ডার ও ১৪টি সি-ব্যান্ড ট্রান্সপন্ডার রয়েছ। এতে টেলিভিশন ও ব্রডব্যান্ড যোগাযোগে উন্নতি ঘটবে।
যুক্তরাষ্ট্রের সময় ১০ মে বিকাল ৪টা ১২ মিনিট থেকে ৬টা ২২ মিনিটের মধ্যে যেকোনও সময় কেনেডি স্পেস সেন্টার থেকে স্যাটেলাইটের উৎক্ষেপণ হবে বলে সময় নির্ধারণ করা ছিল। জানা গেছে, উৎক্ষেপণের ৮ দিন পরে স্যাটেলাইট অরবিটাল স্লটে প্রতিস্থাপিত হয়ে সংকেত পাঠাতে শুরু করবে। সবকিছু ঠিক থাকলে আগস্ট মাসের মাঝামাঝি থেকে স্যাটেলাইটের বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু হবে। সূত্র: স্পেস নিউজ
Posted ৬:৫০ অপরাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ১০ মে ২০১৮
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta