কক্সবাংলা ডটকম(২ ফেব্রুয়ারি) :: নতুন করোনাভাইরাসে এ পর্যন্ত কমপক্ষে ৩০০ জনের প্রাণহানি হয়েছে। আক্রান্ত সাড়ে ১৪ হাজার। পরিস্থিতি ক্রমেই জটিলতর হচ্ছে। জনস্বাস্থ্য, অর্থনীতি সব মিলিয়ে চীনের এখন টালমাটাল অবস্থা। যে উহান শহর থেকে এ ভাইরাস ছড়িয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে, সে শহর এখন যেন জনমানবহীন ভুতুড়ে নগর। আরো অন্তত ৩০টি শহরের রাস্তার দৃশ্যও প্রায় একই। চরম ভীতিকর পরিস্থিতি বিরাজ করছে দেশজুড়ে। ভীতি ছড়িয়েছে এশিয়ার অন্যান্য দেশসহ ইউরোপ ও আমেরিকায়ও।
তবে শুধু ভাইরাস নয়, এর মধ্যে ছড়িয়ে পড়ছে এবং ক্ষতি করছে আরেকটি বিষয়। ভার্চুয়াল জগতে ছড়িয়ে পড়ছে লজ্জাজনক জাতিঘৃণা। এ অজানা রোগটির জন্য একমাত্র চীনাদের দায়ী করা হচ্ছে। চীনা সোস্যাল মিডিয়ায় প্রকাশিত এক এশীয় নারীর বাদুড়ের স্যুপ খাওয়ার দৃশ্য শেয়ার করে বলা হচ্ছে, ‘চীনারা সব খায় এবং তারা এভাবে সারা বিশ্ব ভাইরাস আক্রান্ত করে।’ চীনাদের খাদ্যাভ্যাস ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে না চলার প্রবণতাকে ইঙ্গিত করছেন অনেকে। বলা হচ্ছে, চীনারা অশুচি, তারা নিয়মমাফিক কিছু করতে পারে না। কেউ কেউ আবার সতর্ক করে বলছে, চীনা কোনো জিনিস অর্ডার করার আগে দুবার ভাবুন।
শ্বেতাঙ্গ দুনিয়ায় এই যে জাতিঘৃণা, এটি কিন্তু নতুন নয়। এর শিকড় খুব গভীরে প্রোথিত ও সুবিদিত। পৃথিবীর ইতিহাসে প্রায় সব সংস্কৃতিতে বিদেশী বা অপরিচিতের চেয়ে নিজেদের উত্তম প্রমাণের প্রয়াসে মানুষ সবসময় কুিসত নিন্দাবাদ ছড়িয়েছে। তাদের বর্বর, অসভ্য, পশ্চাত্পদ, নোংরা ইত্যাদি তকমা দিয়ে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব জাহির করার চেষ্টা করেছে।
আধুনিককালে, বিশেষ করে ডোনাল্ড ট্রাম্পের জমানায় এসে আমরা এ ধরনের শব্দের ব্যবহার দেখছি নতুন করে। মুসলিম, আফ্রিকান, লাতিন আমেরিকার অভিবাসীদের সম্পর্কে এ ধরনের শব্দ ব্যবহার করেছেন ট্রাম্প। মূলত পাশবিক ও ঊনমানুষ হিসেবে চিহ্নিত করার অজুহাত হিসেবে এসব বলেন ট্রাম্পের মতো লোকেরা। নৃশংস, বর্বর, রোগাক্রান্ত, নোংরা—সব বিশেষণই মূলত তাদের ব্যাপারে গৃহীত অমানবিক নীতির ন্যায্যতা দেয়ার পাঁয়তারা।
খাদ্যাভ্যাস ও স্বাস্থ্যবিধি নিয়ে চীনাদের নানা অপবাদ দেয়ার সংস্কৃতি পশ্চিমের বহু পুরনো। এমন ধারণার কারণে অনেক সময়ই তথাকথিত সভ্য দেশে চীনাদের অবাঞ্ছিত করা হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, চীনা কমিউনিটিকে ভিনগ্রহী প্রাণীর মতো বিবেচনা করা, একঘরে করে রাখার একাধিক দৃষ্টান্ত পশ্চিমে আছে। উনিশ শতকে ফিরে গেলেই এর প্রমাণ মিলবে। ওই সময় পশ্চিমে চীনাদের ‘নোংরা, অসভ্য ইঁদুরখাদক’ হিসেবে চিহ্নিত করা হতো। ‘রাফ অন র্যাটস’ নামে একটি ইঁদুর নিধন বিষের বিজ্ঞাপনে এ ধারণাটি স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। ‘ইঁদুর, পোকামাকড় দমনে ‘ক্ষুধার্ত চীনার’ মতো এ বিষ কার্যকর’ এভাবেও বলা হতো বিজ্ঞাপনে। এমনকি পত্রিকায় উপসম্পাদকীয়তে পর্যন্ত এমন মনোভাবের ছড়াছড়ি ছিল। এ ধরনের লেখাজোখা চীনাদের ব্যাপারে সাধারণ মানুষের মনে আরো ভয় ধরিয়ে দেয়।
১৮৫৪ সালে নিউইয়র্ক ডেইলি ট্রিবিউনের ২৯ সেপ্টেম্বর সংখ্যার সম্পাদকীয়তে চীনাদের সম্পর্কে লেখা হয়, ‘ধারণাতীত রকমের অসভ্য, অশুচি, নোংরা। এদের উন্নত পারিবারিক ও সামাজিক কোনো সম্পর্ক নেই। এরা আচরণে লোভী ও কামুক। যুক্তরাষ্ট্রে আর একটি চীনাকেও প্রবেশ করতে না দেয়ার জন্য সরকারকে পরামর্শও দেয়া হয় ওই সম্পাদকীয়তে।
এ ধরনের প্রপাগান্ডা কখনো কখনো ভয়ানক উসকানির কাজও করেছে। অনেকে দেশ থেকে চীনা জনসংখ্যা কমিয়ে ফেলার দায়িত্ব নিজ হাতে তুলে নিয়েছে। দলবদ্ধভাবে চায়না টাউন পুড়িয়ে দেয়া, বাসিন্দাদের খুন করার মতো ঘটনা ঘটেছে। ১৮৭১ সালে লস অ্যাঞ্জেলেসে এমন একটি রক্তপাতের ঘটনা ঘটে। শহরে একটি পুরনো চীনা কলোনিতে পাঁচ শতাধিক দুর্বৃত্ত হামলা চালিয়ে ২০ জনকে খুন করার পর ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেয়, মরদেহগুলো ক্ষতবিক্ষত করে। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে এটি জঘন্যতম গণপিটুনির ঘটনা।
১৮৮২ সালের দিকে চীনাভীতি এমন পর্যায়ে পৌঁছে যে, মার্কিন কংগ্রেসে ‘চীনা বর্জন আইন’ পাস হয়। চীন থেকে নতুন করে অভিবাসী আসা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়। একই সঙ্গে বসবাসরত চীনাদের যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিত্ব পাওয়ার পথ চিরতরে বন্ধ করা হয়। নির্দিষ্ট কোনো জাতিগোষ্ঠীর অভিবাসন এভাবে নিষিদ্ধ করার ঘটনা আমেরিকার ইতিহাসে এটিই প্রথম। শুধু তা-ই নয়, ৬১ বছর পর্যন্ত এ আইন বলবৎ ছিল। ১৯৪৩ সালে ম্যাগনুসন আইন পাস হওয়ার পর চীনাদের জন্য বিশেষ কোটা ঘোষণা করা হয়। বছরে ১০৫ জনের বেশি চীনা আমেরিকায় অভিবাসনের সুযোগ পাবে না, এমন আইন করা হয়।
চীনাদের বিরুদ্ধে এ মার্কিন বিদ্বেষ এখন নতুন মাত্রা পেয়েছে। বাণিজ্যযুদ্ধের জেরে চাইনিজ আমেরিকান গবেষক যাদের অনেকেই যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক, অস্বস্তিকর অবস্থার মধ্যে রয়েছে। আমেরিকায় জন্ম এমন গবেষক অধ্যাপকদেরও এখন সন্দেহের চোখে দেখা হচ্ছে। এর মধ্যে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ইউরোপ ও আমেরিকাজুড়ে চীনাদের পাশাপাশি এশীয়রাও বিরূপ প্রতিক্রিয়ার মুখোমুখি হচ্ছে। মানুষ তাদের এড়িয়ে চলছে। অনেকে তাদের দেখে অযথা জোরে কাশি দিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করছে। এশীয় দেখলেই দূরে সরে গিয়ে একে অন্যের সঙ্গে ফিসফাস করার ঘটনা এখন রাস্তাঘাটে, ট্রেনে, ট্রামে বাসে খুবই সাধারণ দৃশ্য। কানাডার টরন্টোয় প্রশাসন ও স্কুল কর্তৃপক্ষ চীনা বংশোদ্ভূত কানাডীয়দের বিরুদ্ধে বৈষম্যমূলক আচরণের ব্যাপারে সতর্ক করেছে।
সিঙ্গাপুর ম্যানেজমেন্ট ইউনিভার্সিটির শিক্ষক নৃতত্ত্ববিদ শার্লোট সেটিজাডি বলেন, প্রাচ্য সম্পর্কে পূর্বধারণা, রাজনৈতিক অনাস্থা, সেই সঙ্গে স্বাস্থ্যঝুঁকি মিলেমিশে খুব শক্তিশালী একটা সমন্বয় তৈরি করেছে। এর ফলে চীনাভীতি চরম আকার ধারণা করেছে।
চীনা কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, উহানে বন্যপ্রাণীর একটি বাজার থেকে করোনাভাইরাস ছড়িয়েছে। এরপর থেকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চীনাদের খাদ্যাভ্যাস ও ঐতিহ্যবাহী ভেষজ নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ শুরু হয়ে গেছে। ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ডের মতো দেশেও এ ধরনের প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। ‘বাদুর খাওয়া বন্ধ করো’, কাঁচা ইঁদুর খাওয়ার একটি দৃশ্যের সঙ্গে ‘কে জানে চীনারা নতুন রোগ ছড়াচ্ছে কিনা’, এ ধরনের কথা ছড়িয়ে পড়ছে। ভিয়েতনামের একটি শহরের হোটেলে চীনা অতিথি নেয়া হবে না বলে সাইনবোর্ড টানানো হয়েছিল। অবশ্য পরে কর্তৃপক্ষ সেটি সরিয়ে ফেলতে বলেছে।
যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সে গণপরিবহন ও সোস্যাল মিডিয়ায় এশীয়দের বিরুদ্ধে অপ্রীতিকর আচরণের খবর প্রায়ই আসছে। ফ্রান্সের স্থানীয় পত্রিকা লে কুরিয়ার পিকার্দ একটি বর্ণবাদী শিরোনামে প্রতিবেদন ছাপলে দেশজুড়ে সমালোচনার ঝড় বয়ে যায়। মাস্ক পরা এক চীনা নারীর ছবি দিয়ে শিরোনামে লেখা হয়, হলুদ সতর্কতা, হলুদ বিনাশ? অবশ্য পরে কর্তৃপক্ষ ক্ষমা চেয়েছে। ফ্রান্সে শুধু চীনা নয়; থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, ফিলিপাইনের লোকদেরও একই অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হচ্ছে। এমন অভিজ্ঞতা টুইটারে শেয়ার করেছে একাধিক এশীয়। ফ্রান্সে স্থানীয় এশীয়রা বাধ্য হয়ে, ঔবঘবঝঁরংচধংটহঠরত্ঁং বা ‘আমি ভাইরাস নই’ এমন হ্যাশট্যাগ চালু করেছে।
এবারের করোনাভাইরাসটি নতুন। কিন্তু একে উপলক্ষ করে যে জেনোফোবিয়া (বিদেশী ভীতি) এবং জাতিবিদ্বেষ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে, এটি নতুন নয়। ইতিহাস বলছে, শেষোক্ত রোগের প্রাদুর্ভাব সামলানো আরো কঠিন, এমনকি মারাত্মকও হতে পারে!
তথ্যসূত্র: বিবিসি, গালফ নিউজ, সিএনএন, গ্রাফিক নভেল সংকলন ‘সিক্রেট আইডেনটিটিজ’-এর সম্পাদক জেফ ইয়াং।
Posted ৩:০২ পূর্বাহ্ণ | সোমবার, ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২০
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta