কক্সবাংলা ডটকম(২ ফেব্রুয়ারি) :: কভিড-১৯ মহামারীতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করা সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী, পুলিশ, স্থানীয় প্রশাসনসহ মাঠপর্যায়ের কর্মীদের উৎসাহ দিতে ক্ষতিপূরণ দেয়ার ঘোষণা দিয়েছিল সরকার। করোনায় আক্রান্ত হলে কর্মকর্তা-কর্মচারীকে ক্ষতিপূরণ বাবদ গ্রেডভেদে ৫-১০ লাখ টাকা ও মৃত্যু হলে ২৫-৫০ লাখ টাকা দেয়ার কথা বলা হয়। ঘোষণা অনুযায়ী করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন এমন ৬৯ জনের পরিবারকে এরই মধ্যে ক্ষতিপূরণ বাবদ ২৭ কোটি ৬২ লাখ ৫০ হাজার টাকা দেয়া হয়েছে। সরকারি আদেশের (জিও) অপেক্ষায় রয়েছে আরো ৩৪ জনের পরিবার।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে কভিড-১৯-এ আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া দেশের প্রথম চিকিৎসক মঈন উদ্দীনের পরিবারকে গত বছরের জুনে ৫০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেয়া হয়। পরবর্তী সময়ে আরো চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীর মৃত্যু হলেও প্রায় আট মাসে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় আর কোনো আবেদন করেনি।
তবে গত মাসের শেষদিকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে বিভিন্ন মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও উপস্বাস্থ্য কেন্দ্রে করোনার চিকিৎসায় নিয়োজিত মৃত্যুবরণকারী চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীর তালিকা অর্থ বিভাগে পাঠানো হয়। এ তালিকা থেকে ৩৪ জনের পরিবারের আবেদন অনুমোদন করেছে অর্থ বিভাগ। এর মধ্যে সাতজন চিকিৎসক, বাকি ২৭ জন নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মী। এ ৩৪ জনের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ বাবদ ১৩ কোটি ৭৫ লাখ টাকা দেয়া হবে। এ বিষয়ে জিও জারির বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
জানা গেছে, করোনায় আক্রান্ত ও মৃত সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পরিবারের ক্ষতিপূরণ বাবদ চলতি বাজেটে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৭৫০ কোটি টাকা। এ বরাদ্দ থেকে মৃতদের ক্ষতিপূরণ দেয়া হচ্ছে। তবে করোনায় আক্রান্তদের ক্ষতিপূরণ দেয়া এখনো শুরু হয়নি। যদিও ক্ষতিপূরণ পেতে আক্রান্তদের বিপুলসংখ্যক আবেদন জমা পড়েছে অর্থ বিভাগে।
অর্থ সচিব আব্দুর রউফ তালুকদার সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে জানান, ঘোষণা অনুযায়ী করোনায় মৃত্যুবরণকারী সরকারি চাকরিজীবীদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেয়া শুরু হয়েছে। আক্রান্তদের ক্ষতিপূরণ দেয়ার বিষয়টিও প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। করোনায় মৃত্যুবরণকারীদের পরিবারকে প্রথমে ওই কর্মকর্তা বা কর্মচারীর নিজ দপ্তরে আবেদন করতে হয়। এরপর সংশ্লিষ্ট প্রশাসনিক মন্ত্রণালয় হয়ে অর্থ বিভাগে ক্ষতিপূরণের আবেদন করেন তারা। কয়েক জায়গায় এটির যাচাই-বাছাইয়ের প্রয়োজন হয়। এজন্য ক্ষতিপূরণ প্রদানের হার কিছুটা কম। তবে এখন যেহেতু দেয়া শুরু হয়েছে, তাই এটির বাস্তবায়নে গতি আসবে।
অর্থ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এখন পর্যন্ত করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণকারী ৫৯ পুলিশ সদস্যের পরিবারকে ২২ কোটি ৬২ লাখ ৫০ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ বাবদ দেয়া হয়েছে। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে প্রশাসনের পাঁচজন কর্মকর্তার পরিবারকে ২ কোটি ৫০ লাখ টাকা ও দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) তিন কর্মকর্তার পরিবারকে ১ কোটি ৫০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেয়া হয়েছে। এছাড়া স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ডা. মঈন উদ্দীনের পরিবারকে ৫০ লাখ টাকা ও বিচার বিভাগের একজন জেলা জজের পরিবারকে ৫০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেয়া হয়েছে।
এদিকে সম্প্রতি অর্থ বিভাগকে চিঠি দিয়ে করোনায় আক্রান্ত পুলিশ সদস্যদের ক্ষতিপূরণ পাওয়ার বিষয়ে মতামত জানতে চেয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ। চিঠিতে বলা হয়, পুলিশ বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিটে কর্মরত প্রায় ১০ হাজার পুলিশ সদস্য কভিড-১৯ মোকাবেলায় সরকারি দায়িত্ব পলনকালে করোনায় আক্রান্ত হন। এ-সংক্রান্ত অর্থ বিভাগের পরিপত্রে দায়িত্ব পালনকালে কভিড-১৯-এ আক্রান্ত হলে এককালীন ক্ষতিপূরণ প্রদানের সিদ্ধান্ত থাকায় আক্রান্তরা ক্ষতিপূরণ প্রাপ্তির জন্য পুলিশ সদর দপ্তরের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট কাগজপত্রসহ আবেদনপত্র দাখিল করেন।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওই চিঠিতে বলা হয়, সরকার ঘোষিত ক্ষতিপূরণের জন্য অর্থপ্রাপ্তির লক্ষ্যে করোনায় আক্রান্ত বাংলাদেশ পুলিশের প্রায় ১০ হাজার সদস্যের দাখিল করা আবেদন অর্থ বিভাগে পাঠানো হবে কিনা, সে বিষয়ে মতামত প্রদানের অনুরোধ করা হলো। তবে গতকাল পর্যন্ত এ বিষয়ে অর্থ বিভাগ কোনো মতামত দেয়নি।
অর্থ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ক্ষতিপূরণ পাওয়ার লোভে রিজেন্ট হাসপাতাল ও জেকেজি হেলথকেয়ারের মতো আরো বেশকিছু প্রতিষ্ঠান থেকে অর্থের বিনিময়ে কভিড-১৯ পজিটিভ সনদ সংগ্রহের হার বেড়ে যায়। করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভুয়া সার্টিফিকেট দিয়ে ক্ষতিপূরণ পেতে অর্থ বিভাগে বিভিন্ন সরকারি দপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীর আবেদন বাড়তে থাকে। এ পরিস্থিতিতে আক্রান্তদের ক্ষতিপূরণ দেয়ার বিষয়ে এখনো সিদ্ধান্তহীনতায় রয়েছে সরকার।
অর্থ বিভাগের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, শুরু থেকে এখন পর্যন্ত করোনায় আক্রান্তের হার এত বেশি হয়ে গেছে যে এখন আক্রান্তদের ক্ষতিপূরণ দেয়ার বিষয়ে বিকল্প চিন্তা করছে সরকার। তাছাড়া রিজেন্ট ও জেকেজির মতো ভুয়া সনদ দেয়া প্রতিষ্ঠানের বিষয়টি আগে বোঝা যায়নি। তাই এ বিষয়ে ভাবতে হচ্ছে। সনদের সত্যতা যাচাইয়ের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
তিনি জানান, আক্রান্তদের কাউকেই ক্ষতিপূরণ দেয়া হবে না, তা নয়। এমনও হতে পারে যে একটা নির্দিষ্ট সময়ে আক্রান্তদের ক্ষতিপূরণ দেয়া হবে।
প্রসঙ্গত গত বছরের ৮ মার্চ দেশে প্রথমবারের মতো তিনজনের শরীরে করোনা শনাক্ত হয়। ভাইরাসটির সংক্রমণ ঠেকাতে গত ২৬ মার্চ থেকে সরকার কয়েক ধাপে ৬৬ দিন সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে। কিন্তু সাধারণ ছুটির মধ্যেও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী, পুলিশ, স্থানীয় প্রশাসনসহ মাঠপর্যায়ের কর্মীরা সেবা দিয়ে যান। এমন পরিস্থিতিতে সরকারি চাকরিজীবীদের কাজে উদ্বুদ্ধ করতে সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন অংকের আর্থিক সহায়তা প্রদানের ঘোষণা দেয়া হয়।
ক্ষতিপূরণ দেয়া প্রসঙ্গে গত বছরের ২৩ এপ্রিল অর্থ মন্ত্রণালয়ের জারি করা পরিপত্রে বলা হয়, করোনাভাইরাসে (কভিড-১৯) আক্রান্ত রোগীদের সেবা প্রদানে সরাসরি কর্মরত চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীসহ এ-সংক্রান্ত সরকার ঘোষিত নির্দেশনা বাস্তবায়নে মাঠ প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, সশস্ত্র বাহিনী ও প্রত্যক্ষভাবে নিয়োজিত প্রজাতন্ত্রের অন্যান্য কর্মচারী দায়িত্ব পালনকালে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলে ক্ষতিপূরণ বাবদ সরাসরি আর্থিক সুবিধা প্রদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে।
পরিপত্রে আরো বলা হয়, ২০১৫-এর বেতন স্কেল অনুযায়ী, ১৫-২০তম গ্রেডের কেউ আক্রান্ত হলে তিনি ক্ষতিপূরণ পাবেন পাঁচ লাখ, মারা গেলে পাবেন ২৫ লাখ টাকা। ১০-১৪তম গ্রেডের কেউ আক্রান্ত হলে পাবেন সাড়ে সাত লাখ এবং মারা গেলে সাড়ে ৩৭ লাখ টাকা। এছাড়া প্রথম-নবম গ্রেডের কেউ আক্রান্ত হলে পাবেন ১০ লাখ এবং মারা গেলে পাবেন ৫০ লাখ টাকা। গত বছরের ১ এপ্রিল থেকে এ নির্দেশনা কার্যকর হয়।
Posted ৩:১৪ পূর্বাহ্ণ | মঙ্গলবার, ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২১
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta