কক্সবাংলা ডটকম(৩০ ডিসেম্বর) :: শেষের দ্বারপ্রান্তে থাকা ২০২২ সাল ভালো যায়নি পুঁজিবাজারের বিনিয়োগকারীদের। বছরের সিংহভাগ সময় পতনের মধ্যেই ছিল দেশের পুঁজিবাজার। ফলে মুনাফার পরিবর্তে বছরটিতে বিনিয়োগকারীদের লোকসানের পাল্লা ভারি হয়েছে। একই সঙ্গে বছরের শেষ সময়ে এসে দেখা দেয় লেনদেন খরায় বিনিয়োগকারীদের উদ্বেগ আরো বাড়িয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই বছরটিকে ‘অপয়া’ হিসেবে চিহ্নিত করবেন বিনিয়োগকারীরা।
২০২২ সাল একটি কঠিন বছর শেষ করল পুঁজিবাজার। শুরুটা হয়েছিল কিছুটা আশা দেখিয়ে, তবে শেষটা হলো চরম হতাশায়।
২০২২ সালের শুরুতেও পুঁজিবাজার নিয়ে উচ্ছ্বাস ছিল না। ২০২১ সালের অক্টোবর থেকেই বাজার ছিল সংশোধনে। তবে সেটি শেষ করে ২০২২ সালের শুরুতে সূচক কিছুটা বাড়তে শুরু করে। কিন্তু এর মধ্যে ঘটে দুটি ঘটনা।
প্রথমত. শ্রীলঙ্কায় অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব এবং ২৪ এপ্রিল ইউক্রেনে রুশ হামলার পর বিশ্বের প্রধান শক্তিগুলোর এই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার পর পরিবর্তিত বিশ্ব ব্যবস্থা।
দুই ঘটনায় বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের পুঁজিবাজারেও দেখা যায় অস্থিরতা। বছর শেষেও কাটেনি সেটি। হতাশ, ক্লান্ত বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আশা ফিরবে এমন কোনো দূরতম ইঙ্গিতও নেই।
অথচ বছরটি হতে পারত আলো ঝলমলে। পুঁজিবাজারে প্রথমবারের মতো লেনদেন শুরু করেছে ইসলামি সুকুক বন্ড। ৩ লাখ ১৬ হাজার ৮০৮ কোটি টাকা বাজার মূলধন নিয়ে শুরু করেছে ২৫০টি সরকারি সিকিউরিটিজও।
পুঁজিবাজার নিয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের মধ্যে দীর্ঘ মতভিন্নতাও দূর হয়েছে এ বছর। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রক্ষণশীল নীতি পরিবর্তনের বিষয়টি আর আভাসে সীমাবদ্ধ নেই। তারা ব্যাংকগুলোকে আরও বেশি বিনিয়োগের সুযোগ দিয়ে নানা নির্দেশও দিয়েছে।
বিনিয়াগকারীদের এক যুগের দাবি মেনে ব্যাংকের বিনিয়োগসীমা বা এক্সপোজার লিমিটের গণনা শেয়ারের ক্রয়মূল্যে করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
কিন্তু এসবের কিছুই বিনিয়োগকারীদের হতাশা ঠেকাতে পারেনি। বৈশ্বিক আর দেশের অর্থনীতি নিয়ে নেতিবাচক প্রচারেই উৎকণ্ঠিত তারা। হাত গুটিয়ে বড় বিনিয়োগকারীরাও। আর প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ না বাড়ার বিষয়টি নিয়ে হতাশা জানিয়েছেন বিএসইসির চেয়ারম্যান শিবলী রুবাইয়াত-উল ইসলাম।
এ বছর যে মোটেও ভালো যায়নি সে কথা স্বীকার করেছেন আইডিএলসি ইনভেস্টমেন্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. মনিরুজ্জামান। তিনি বলেন, ‘এ বছর পুঁজিবাজার থেকে বিনিয়োগকারীরা লাভের মুখ দেখেননি। বরং গত বছর যে লাভ হয়েছিল, এ বছর সেটা হারিয়ে ফেলেছেন। আমরা পুঁজিবাজারে এমন জোয়ার-ভাটার খেলা দেখতে চাই না।’
ডিএসইর ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাইফুর রহমান মজুমদার আশা করছেন নতুন বছর নতুন আশা নিয়ে আসবে। তিনি বলেন, ‘২০২৩ সালের শুরুতেই সংকট কিছুটা কাটিয়ে উঠা সম্ভব হবে। আগামী বছরের শুরুতেই ডিএসই’র অল্টারনেটিভ ট্রেডিং বোর্ড চালু হবে, মোবাইল অ্যাপসের ক্যাপাসিটি বৃদ্ধি, বন্ড মার্কেটের জন্য স্বতন্ত্র অর্ডার ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম প্রতিষ্ঠাসহ বাজারের স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা বাড়াতে ব্যাপক কর্মসূচি হাতে নেয়া হয়েছে।’
সূচক লেনদেনের কী চিত্র
২০২২ সালের প্রথম কর্মদিবস ২ জানুয়ারি ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে সাধারণ সূচক ডিএসইএক্সের অবস্থান ছিল ৬ হাজার ৮৫৩ পয়েন্ট। সেদিন লেনদেন ছিল ৮৯৪ কোটি ১৭ লাখ ৮৪ হাজার টাকা।
বছরের শেষ কর্মদিবস বৃহস্পতিবার সূচকের অবস্থান ৬ হাজার ২০৬ পয়েন্ট। এক বছরে পড়েছে ৬৪৭ পয়েন্ট বা ৯.৪৪ শতাংশ।
শেষ দিন লেনদেন ছিল ৩৪৫ কোটি ৭১ লাখ ৪৬ হাজার টাকা। অর্থাৎ বছরের প্রথমদিন যে লেনদেন, শেষ দিন তার অর্ধেকেরও কম।
সূচক আর লেনদেনে এই পার্থক্যে কেবল বোঝা যাবে না বছরটি কতটা খারাপ গেছে বিনিয়োগকারীদের জন্য। গত এক মাসেরও বেশি সময় ধরে শেয়ারের লেনদেন হচ্ছে না বললেই চলে। ৩৯২টি কোম্পানির মধ্যে তিন শতাধিক কোম্পানির শেয়ারের হাতবদল নেই বললেই চলে।
অথচ বছরের শুরুতে ইঙ্গিত ছিল ভিন্ন। শুরুতে এরপর ১৪ কর্মদিবসের মধ্যে ১১ দিন সূচক বেড়ে ২০ জানুয়ারি সূচক দাঁড়ায় ৭ হাজার ১০৫ পয়েন্টে।লেনদেন দাঁড়ায় এক হাজার ৬০১ কোটি ২০ লাখ ২৬ হাজার টাকা।
আগের বছরের শেষ প্রান্তিকের হতাশা ভুলে তৈরি হওয়া আশার বেলুন ফুটো হতে থাকে এরপর থেকেই। শ্রীলঙ্কার পরিস্থিতির প্রভাব পড়ে দেশের পুঁজিবাজারে।
এর মধ্যে ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে রুশ হামলা, রাশিয়ার ওপর পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা ইত্যাদি নানা ঘটনার প্রভাব পড়ে পুঁজিবাজারে।
টাকা পতন হয় ২৮ জুলাই পর্যন্ত। সেদিন সূচক নামে ছয় হাজার পয়েন্টের নিচে। সেদিন দ্বিতীয়বারের মতো ফ্লোর প্রাইস আরোপের সিদ্ধান্ত হয়, যা কার্যকর হয় পরদিন থেকে।
এরপর দুই মাসের বেশি উত্থান দেখে বিনিয়োগকারীরা। সূচক বেড়ে ছাড়িয়ে যায় ৬ হাজার ৬০০ পয়েন্ট। লেনদেন বেড়ে ২০ সেপ্টেম্বর দাঁড়ায় ২ হাজার ২৮২ কোটি ৩০ লাখ ৭৪ হাজার টাকায়।
গত ৯ কর্মদিবস মিলিয়ে সেদিনের সমান লেনদেন হয়নি। শেষ ৯ কর্মদিবসে হাতবদল হয়েছে ২ হাজার ৭৫৩ কোটি ৫৩ লাখ ৭৪ হাজার টাকার শেয়ার।
প্রতিদিন কোটি কোটি লাখ লাখ শেয়ারের ক্রয়াদেশ বসানো থাকে, কিন্তু কেনার মানুষ থাকে না।
এই বছরে ২৪৪ কার্যদিবসে লেনদেনের পরিমাণ মোট ২ লাখ ৩৪ হাজার ৪৪৭ কোটি ৯০ লাখ টাকা। যার গড় লেনদেন ৯৬০ কোটি ৯০ লাখ টাকা। আগের বছর ২০২১ সালে গড় লেনদেন ছিল ১ হাজার ৪৭৫ কোটি ২০ লাখ টাকা।
২০২২ সালে ডিএসইর ট্রেডিং প্ল্যাটফর্মে ৩ লাখ ১৪ হাজার ১৪ কোটি ৩০ লাখ টাকা বাজার মূলধন নিয়ে ২৫০টি সরকারি সিকিউরিটিজ তালিকাভুক্তির মাধ্যমে চলতি বছরের ১০ অক্টোবর বাজার মূলধনের পরিমাণ দাঁড়ায় ৭ লাখ ৭২ হাজার ৫১৪ কোটি ৪০ লাখ টাকা।
বছরশেষে বাজার মূলধনের দাঁড়ায় ৭ লাখ ৬০ হাজার ৯৩৬ কোটি ৮০ লাখ টাকায়। অর্থাৎ দুই মাসে বাজার মূলধন কমেছে ১১ হাজার ৫৭৭ কোটি ৬০ লাখ টাকা।
২০২২ সালে ব্লক মার্কেটে লেনদেন হয় ১৪ হাজার ২৫৩ কোটি ২০ লাখ টাকা। যা মোট লেনদেনের ৬ শতাংশ। অন্যদিকে ২০২১ সালে ব্লক মার্কেটে লেনদেনের পরিমাণ ছিল ১৪ হাজার ৫১ কোটি ১০ লাখ টাকা, যা মোট লেনদেনের প্রায় ৪ শতাংশ।
মন্দাবাজারেও উত্তোলন হাজার কোটির বেশি
পুঁজিবাজারের মন্দার মধ্যেও ২০২২ সালে ৬টি কোম্পানি প্রাথমিক গণপ্রস্তাব বা আইপিওতে বাজার থেকে তুলেছে ৭১৩ কোটি ৭০ লাখ টাকা।
এছাড়াও একটি পারপিচুয়াল বন্ড এবং একটি মিউচ্যুয়াল ফান্ড আইপিওর মাধ্যমে ৭৫ কোটি টাকা মূলধন সংগ্রহ করে। এক পারপিচ্যুয়াল বন্ড প্রাইভেট প্লেসম্যান্টের মাধ্যমে তোলে আরও ৪০০ কোটি টাকা।
আগের বছর ১৯টি কোম্পানি আইপিওর মাধ্যমে তুলেছিল ১ হাজার ৮৫৮ কোটি ৪০ লাখ টাকা। এছাড়া একটি একটি সুকুক বন্ড তিন হাজার কোটি টাকা এবং চারটি পারপিচ্যুয়াল বন্ড তোলে ২০০ কোটি টাকা।
২০২২ সাল ১টি কোম্পানি ১ কোটি ৯ লাখ রাইট শেয়ার ইস্যুর মাধ্যমে মোট ১১ কোটি টাকা মূলধন সংগ্রহ করে। আগের বছর ২টি কোম্পানি তুলেছিল ৭৭ কোটি ৮০ লাখ টাকা।
তবু আশা
পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, খারাপ সময় পেরিয়ে যেমন ভালো সময় আসে, তেমনি কঠিন ২০২২ শেষে আসবে আলো ঝলমলে ২০২৩।
ডিএসইর চেয়ারম্যান ইউনুসুর রহমান বলেন, ‘এ বছরের শেষটা একেবারেই ভালো যায়নি, এটা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। পুঁজিবাজার বৈশ্বিক রাজনীতি ও সাপ্লাই চেইনের সঙ্গে সম্পর্কিত। যদি সবকিছু ইতিবাচক হয়ে আসে তাহলে তাই আমরা আশাবাদী আগামী বছর একটা ভালো সময় কাটাতে পারব।’
আশায় বুক বেঁধেছেন ডিএসই শেয়ারহোল্ডার পরিচালক শাকিল রিজভীও। তিনি বলেন, ‘এ বছর সারা বিশ্বই ছিল অর্থনৈতিকভাবে খারাপ অবস্থার মধ্যে। আগামী বছর যদি বিশ্ব অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ভালো হয় তাহলে দেশের পুঁজিবাজারের চিত্রও বদলাবে। যেহেতু পুঁজিবাজার দেশের ও বৈশ্বিক পরিস্থিতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। তাই আশা করছি, আগামী বছর সবকিছু ঠিক থাকলে পুঁজিবাজারও ঘুরে দাঁড়াবে।’
মার্চেন্ট ব্যাংক প্রভিশন সংরক্ষণের মেয়াদ বাড়ালো বিএসইসি
মেয়াদ বাড়ানোর ফলে মার্চেন্ট ব্যাংকগুলো ৩১ ডিসেম্বর ২০২৩ অর্থবছর পর্যন্ত অনাদায়কৃত ক্ষতির বিপরীতে প্রভিশন রাখার সময় পেলো। মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোর সংগঠন বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমবিএ) আবেদনের প্রেক্ষিতে সময় বাড়ালো বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)।
চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, শেয়ারবাজারের স্বার্থ রক্ষা এবং বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোর মার্জিন ঋণের পুনঃমূল্যায়নজনিত অনাদায়কৃত ক্ষতির বিপরীতে প্রভিশন রাখার মেয়াদ ৩১ ডিসেম্বর ২০২৩ অর্থবছর পর্যন্ত বাড়িয়েছে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)।
তথ্য মতে, বিএমবিএ’র আবেদনের প্রেক্ষিতে কমিশন, ২৮ ডিসেম্বর ২০১৭ এর মাধ্যমে মার্চেন্ট ব্যাংকারের নিজস্ব ও মক্কেলের পোর্টফলিওতে পুনঃমূল্যায়নজনিত অনাদায়কৃত ক্ষতির বিপরীতে রক্ষিত প্রভিশন রাখার ঐচ্ছিক সুবিধার বিদ্যমান মেয়াদ এর আগে আরও কয়েক দফা বাড়ানো হয়েছে।
বিএমবিএ প্রেসিডেন্ট মো. ছায়েদুর রহমান বলেন, নেগেটিভ ইক্যুইটির বিপরীতে যে প্রভিশন রাখতে হয় তার মেয়াদ আরও এক বছর বাড়িয়েছে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। এটা বাড়ানো না হলে শেয়ার বিক্রির চাপ বেড়ে যেতো।
Posted ১:৪১ অপরাহ্ণ | শুক্রবার, ৩০ ডিসেম্বর ২০২২
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta