হুমায়ূন আহমেদের জন্মদিন উপলক্ষে ১২ই নভেম্বর ‘আমার যতো গান’ অনুষ্ঠানে শেষবারের মতো পর্দায় হাজির হয়েছিলেন উপমহাদেশের প্রখ্যাত সুরকার, গীতিকার, বংশীবাদক ও লোকসংগীতশিল্পী বারী সিদ্দিকী। প্রথমেই তিনি হুমায়ূন আহমেদের লেখা গান  ‘কেহ গরিব অর্থের জন্য, কেহ গরিবরূপে..এই দুনিয়ার সবাই গরিব,কান্দে চুপে চুপে’ দিয়েই অনুষ্ঠানটি শুরু করেন।

তারপর ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’-এর একটা গান ধরলেন ‘শোয়া চান পাখি’। বারী সিদ্দিকী হুমায়ূন আহমেদের সাথে কাটানো স্মৃতি মনে করতে করতে বলেন, ‘শোয়া চান পাখি গানটি গাওয়ার সময় হুমায়ূন স্যার আমাকে কাঁদো কাঁদো কন্ঠে গানটি গাইতে বলেছিলেন।’

কী ছিল শোয়া চান পাখি গানের পেছনে? এই বিষয়ে বারী সিদ্দিকী বললেন, শুয়ে আছে আমার চান পাখিটা, বাউল তার মৃত স্ত্রীর মাথাটা কোলে নিয়ে কবরের পাশেই গানটি রচনা করেছিলেন। ময়মনসিং অঞ্চলের  ডাকিতাছি শব্দটাই রাখা হয়েছিল গানটির মধ্যে। গানটি কোন কাট ছাঁট করা হয়নি সিনেমার মধ্যেও।

বারী সিদ্দিকী
বারী সিদ্দিকী

বারী সিদ্দিকী তার মৃত্যু নিয়েও একটি গান গেয়ে গেছেন, তাঁর গাওয়া গানটি প্রখ্যাত গীতিকার, সুরকার, পরিচালক আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলকে তিনি লিখতে বলেছিলেন। তিনি বলেন,’আমার মৃত্যর পর আমার পরে থাকা নষ্ট, ভাঙ্গা বাঁশি দিয়ে আমার খাটিয়া তৈরি করলে…এমন একটা গান তুমি লিখে দেও’।

তাঁর দরদ মাখা কন্ঠে তিনি বাঁশি দিয়েই শুরু করলেন, ‘বাঁশির হবে আরজ তবের কাছে, আমি বারী বাশুরিয়া হরতই করি বাঁশি দিয়া’ এমন অসংখ্য হৃদয় ছোঁয়া গান তিনি গেয়ে গেছেন আমাদের জন্য।

বারী সিদ্দিকী
বারী সিদ্দিকী

তিনি সব সময় বলে গেছেন হুমায়ূন আহমেদ তাঁর গান গাওয়ার বিষয়ে যথেষ্ট উৎসাহ দিয়েছিলেন। তবে তাঁদের মধ্যে প্রথম পরিচয়টা হয় ১৯৯৩ সালে।  হুমায়ূন আহমেদের জন্মদিনে তার বাসায় এক অনুষ্ঠানে বাঁশি শোনাতে যান বারী সিদ্দিকী। সেই অনুষ্ঠানে বারীর বাঁশির চেয়ে তার কণ্ঠে গাওয়া রশিদ উদ্দিন বাউল আর উকিল মুন্সির গানই বেশি পছন্দ করেন হুমায়ূন আহমেদ। পরে লেখক হুমায়ূনের আগ্রহেই বারীর কণ্ঠে ‘আমার গায়ে যত দুঃখ সয়,’ ‘পুবালি বাতাসে’ গানগুলো রেকর্ড করা হয়।

কিন্তু এর আগেই টেলিভিশনে ‘রঙের বাড়ই’ নামে একটি ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানে ‘আমার গায়ে যত দুঃখ সয়’ গানটি প্রচার করা হলে বারী সিদ্দিকী পৌঁছে যান সারা দেশের শ্রোতাদের হৃদয়ে।

হুমায়ূন আহমেদ একদিন বারী সিদ্দিকী বলেছিলেন ময়মনসিংহ অঞ্চলের এই ধরনের গান গাওয়ার সময় যদি কেউ দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে তাহলে গানের গভীরতায় সমস্যা হয়। তাই বারী সিদ্দীকির সাথে সন্ধ্যায় একা বসেই গান শুনতেই হুমায়ূন আহমেদ পছন্দ করতেন।

বারী সিদ্দিকী
বারী সিদ্দিকী

বারী সিদ্দিকীর প্রত্যেকটি গানের মধ্যেই ছিল অনেক ঘটনা। ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’ সিনেমায় পূবালী বাতাসে গানটি গাওয়ার সময় পুরো গানের দল বল নিয়ে তিনি চলে গিয়েছিলেন টাঙ্গুয়ার হাওরে, দুই দিন হাওয়রের মাঝে থেকে শেষ দিন তিনি ঠিকই হাওরের সেই পূবালী বাতাস অনুভূব করেন। বাউল এবং উকিল মুনশি গানের মধ্যে যে টানটি ছিল না, বারী সিদ্দিকী সেই টানটি অনুভূব করলেন হাওয়রে গিয়ে।

বারী সিদ্দিকী গায়কী দ্বারা হুমায়ূন আহমেদ এতটাই প্রভাবিত ছিল যে তাঁর গাওয়া বিচ্ছেদের গান ‘লিলুয়া বাতাসে প্রাণ না জুড়ায় না জুড়ায় রে, একা ঘরে ঘুম আসে না শুইলে  বিছানায় …’    এটা দিয়ে তিনি একটা বই লিখে ফেলেছিলেন, বইটির নামও হুমায়ূন আহমেদ দিয়েছিলেন ‘লিলুয়া বাতাসে’ অর্থাৎ সন্ধ্যার হালকা বাতাস।

চ্যানেল আইয়ের ‘আমার যত গান’ অনুষ্ঠানটিতে তিনি আরও গান ‘তোমারে পাইলাম না আমি, তাতে দুঃখ নাই’, ‘আকাশ চন্দ্র গ্রহ’, মাগো মা, ঝিগো ঝি করলাম কি রঙে, ভাঙ্গা নৌকা বাইতে আইলাম গাঙে’, ‘আমার মুর্শিদ পরশমনি গো’,এবং অনুষ্ঠানটি শেষ করেন ‘ আমার মন্দ স্বভাব জেনেও তুমি কেনো চাইলে আমারে, এত ভালো হয় কি মানুষ, নিজের ক্ষতি করে’ গানটির মধ্য দিয়ে’।

শরীফ কিচেন স্টার প্রেজেন্টস ‘আমার যত গান’ অনুষ্ঠানটিতে হুমায়ূন আহমেদের স্মরণে আরও  ছিলেন সেলিম চৌধুরি, নাট্যকার বরকত উল্লাহ এবং উপস্থাপনায় ছিলেন দিলরুবা সাথী।