মঙ্গলবার ৭ই মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ২৪শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

শিরোনাম

মঙ্গলবার ৭ই মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

শিরোনাম

ডলফিন হত্যা ও আমাদের দায়বদ্ধতা

শুক্রবার, ১৫ মে ২০২০
299 ভিউ
ডলফিন হত্যা ও আমাদের দায়বদ্ধতা

মো. কামাল হোসেন

 পুরো পৃথিবী আজ করোনায় সৃষ্ট কভিড-১৯-এর প্রভাবে ক্ষত-বিক্ষত, বিপর্যস্ত মানবসভ্যতা। প্রতিদিনই বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যা, সঙ্গে মৃত্যুও। প্রতিরোধের একমাত্র উপায় ঘরে থাকা, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা। সমগ্র বাংলাদেশের আজ মন ভালো নেই। এই অনিশ্চিত সময়ে মনটা সব সময় অস্থির লাগছে, তার মধ্যে কয়েক দিন ধরে মনটা আরো ভারী হয়ে আছে। গত ৪ এপ্রিল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখলাম কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতের সামলাপুরে পড়ে আছে ডলফিনের মৃতদেহ।

কেউ একজন ভিডিওতে দেখাচ্ছিলেন, শরীরে দায়ের এবং মাথায় লাঠির আঘাতে রক্ত ঝরছে। জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে ডলফিনটি সৈকতে নড়াচড়া করছিল এবং কিছুক্ষণ পরে মারা যায়। এ দৃশ্য দেখে ভীষণ কষ্ট পেয়েছিলাম। পরের দিন সকালে ইনানীর হোটেল রয়েল টিউলিপের সামনে সৈকতে আরেকটি ডলফিনের মৃতদেহ দেখা যায়। দেশের  প্রথম সারির বেশ কয়েকটি টিভি চ্যানেলে এদের মৃত্যুর খবর প্রচারিত হলেও ইচ্ছা করে তা দেখার চেষ্টা করিনি। স্থানীয়দের প্রাথমিক ধারণা, জেলেদের জালে আটকা পড়ায় তারাই এ কাণ্ড ঘটিয়েছে। এরই মধ্যে দায়ীদের চিহ্নিত করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। ভাবছিলাম, সমুদ্রে যে প্রাণীটি মানুষের সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু কিভাবে তাদের প্রতি এত নিষ্ঠুর হয় সেই মানুষ।

১৬ মার্চ থেকে সরকার করোনা পরিস্থিতির কারণে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করলে অনেকেই কক্সবাজারে বেড়াতে আসতে শুরু করে। সরকারের নির্দেশে তার দুই দিন পর সমুদ্রসৈকতে নামা বন্ধ করে দেওয়া হয়, পর্যটকশূন্য হয়ে যায় কক্সবাজার। কয়েক দিন পরই সাগরের জলরাশি হতে থাকে নীল। অনেকটা আকস্মিকভাবেই ২০-২৫ বছরের বিরতির পর গত ২৩ মার্চ সকালে লাবনী থেকে কলাতলী পয়েন্টের মধ্যে ১০-১২টি ডলফিনকে দল বেঁধে সমুদ্রের নীল জল ছাপিয়ে শূন্যে লাফিয়ে নাচতে দেখা যায়।

কোনো একজনের মোবাইলে ধারণকৃত সে অপরূপ দৃশ্য ফেসবুক দুনিয়ায় ভাইরাল হয়। আমার ১০ বছরের কন্যা প্রতীতি ডলফিন জলকেলির সে মনকাড়া ভিডিওটি দেখে ভবিষ্যতে আর কাউকে সমুদ্রে নামতে না দেওয়ার অনুরোধও করেছিল। করোনা ঝামেলা শেষ হলে সে কক্সবাজারে ডলফিন দেখতে আসার আবদার করে রেখেছিল। আমি তাকে আশ্বস্তও করেছিলাম; কিন্তু এরই মধ্যে ঘাতকরা হত্যা করেছে সমুদ্রের পরম বন্ধু অনেক ডলফিন। তাই মনটা আরো বেশি খারাপ লাগছে।

বলা হয়ে থাকে, মানুষের পর পৃথিবীতে সবচেয়ে বুদ্ধিমান প্রাণী ডলফিন। এটি একটি স্তন্যপায়ী প্রাণী। জন্মদান করে সন্তান, শিশুরা মায়ের দুধ পান করেই বড় হয়ে থাকে। পৃথিবীতে ১৭টি গোত্রে ৩২ প্রজাতির ডলফিন দেখা যায়। বোতলমুখো, গোলাপি, স্পিনার, পরপয়েজ, কিলার হোয়েল প্রভৃতি প্রজাতির ডলফিন রয়েছে। এদের মধ্যে প্রায় ৩২ ফুট লম্বা এবং পাঁচ টনের বেশি ওজনের কিলার হোয়েল সবচেয়ে বড় এবং প্রায় চার ফুট লম্বা ও ১১০ পাউন্ড ওজনের তাচুসি ডলফিন সবচেয়ে ছোট। সাধারণত চিড়িয়াখানা বা অ্যাকোয়ারিয়ামে যে ডলফিন দেখি তা বোটোলনোজ ডলফিন। সিঙ্গাপুরের সান্তোসার ডলফিন আইল্যান্ডের মায়াবী ‘ডলফিন শো’ আজও বিমোহিত করছে পর্যটকদের। সমুদ্রে বাতাসে লাফিয়ে লাফিয়ে ডিগবাজি খায় স্পিনার ডলফিন।

বেশির ভাগ ডলফিন সমুদ্রে বাস করলেও কিছু ডলফিন বাস করে নদীতে, যাদের রিভার ডলফিন বলে। বরিশালের কীর্তনখোলা, ঝালকাঠির সুগন্ধা কিংবা আমার শৈশবে সাঁতার কাটা বিষখালী নদীতে আশির দশকে সচরাচর রিভার ডলফিন দেখা যেত, যাকে আমরা ‘শুশুক’ বলেই চিনতাম। আজ আর তা দেখা যায় না, বিলীন হয়েছে বহু আগে। বিরল প্রজাতি ইরাবতীর ৯ হাজার ডলফিনের অভয়াশ্রম এখন বাংলাদেশ। বাগেরহাটের পূর্ব সুন্দরবনসহ সুন্দরবনের নদীগুলোর ১২০ কিলোমিটার পর্যস্ত গভীর সমুদ্রেই রয়েছে পাঁচ হাজারের বেশি ডলফিন। ওয়ার্ল্ডলাইফ কনজারভেশন সোসাইটির বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতির তালিকায় ছিল এটি।

সাম্প্রতিককালে ডলফিনদের মনোচিকিৎসায় ব্যবহার করা হচ্ছে। বুদ্ধিমত্তা আর মিশুক আচরণের চঞ্চল এ প্রাণীটি মানসিক প্রতিবন্ধকতা, ডাউন সিনড্রোম ও অটিজমে আক্রান্ত ব্যক্তিদের সেরে উঠতে সাহায্য করছে। বর্তমানে ডুবোজাহাজ খুঁজে বের করা, মানুষকে উদ্ধার করার কাজে এদের প্রশিক্ষণ দিয়ে ব্যবহার করা হচ্ছে। ডলফিনের চলাচল নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে সীমান্ত পাহারার কাজটিও করছে অনেক দেশের নৌবাহিনী।

ডলফিন তার মাথার ওপরে থাকা ছিদ্র দিয়ে শ্বাস-প্রশ্বাস নেয়, যাকে ব্লোহেল বলে। নিঃশ্বাস নেওয়ার প্রয়োজনে এক-দুই মিনিট পর পর পানির ওপরে আসতে হয় বলে ডলফিন সমুদ্রের ওপরের স্তরে থাকে। তারা ঘুমাতে পারে, ইলেকট্রো এনসেফালোগ্রাফির মাধ্যমে তাদের মস্তিষ্কে বিদ্যুতের মাত্রা নির্ণয় করে দেখা গেছে ঘুমের সময় ডলফিনের অর্ধ মস্তিষ্ক সচল থাকে, বাকি অর্ধ মস্তিষ্ক ঘুমায়। এভাবেই পালাক্রমে তারা ঘুমের কাজটি সেরে থাকে। এরা শব্দ তৈরি করতে পারে, যাকে ক্লিক সাউন্ড বলে। ডলফিনের কিছু কিছু প্রজাতি সুর করে গানও করতে পারে। শিস ধ্বনি ব্যবহার করে তারা একে অন্যের প্রয়োজনে সাড়া দেয়। ডলফিনরা খুব কেয়ারিং হয়ে থাকে, কোনো ডলফিন আহত হলে সঙ্গীরা তাকে ভেসে থাকতে সাহায্য করে, এমনকি এ সহযোগিতা অনেক মানুষকেও ডলফিন করেছে। একটি কুকুরকে মাঝ সমুদ্র থেকে কিভাবে ডলফিন তীরে পৌঁছে দিয়েছিল ইউটিউবের কল্যাণে তা আমাদের সবারই নজর কেড়েছে।

অসম্ভব হৃদয়গ্রাহী আর উপকারী এ প্রাণীটির সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে। কক্সবাজারের প্রবীণদের কাছ থেকে জানা যায়, ২০-২৫ বছর আগে কক্সবাজারের সৈকত এলাকা এমনকি বাঁকখালীর মোহনায় প্রচুরসংখ্যক ডলফিন দেখা যেত। ইঞ্জিন নৌকা আসার পরে তা কমতে থাকে। বাঁকখালী মোহনায় শতাধিক স্পিডবোট চলাচল, সমুদ্র উপকূলে জেটস্কিসহ উচ্চ গতিসম্পন্ন জলযান আসার পর তাদের আর দেখা যায় না। পানিদূষণ, খাদ্যাভাব, জেলেদের অবৈধ কারেন্ট জাল ব্যবহারের ফলে মারা যাচ্ছে ডলফিন। আর এসবের প্রত্যক্ষ উদাহরণ হলো সমুদ্রসৈকতে বহুদিন পর ফিরে আসা ডলফিন হত্যাকাণ্ড। বন্য প্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন, ২০১২-এর ৩৭ ধারার বিধান মতে তিমি বা ডলফিন হত্যা করলে তা অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে এবং যার শাস্তি সর্বোচ্চ তিন বছর কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ তিন লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড। তবে ঘটনাস্থল সমুদ্র হওয়ায় এ আইনের প্রয়োগ অতটা সহজসাধ্যও নয়।

করোনার প্রভাবে কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত জনশূন্য হওয়ায়, জেটস্কি আর স্পিডবোট বন্ধ থাকায়, শান্ত নির্মল নীল জলরাশিতে দীর্ঘ সময় পরে ফিরে এলেও সাগর আর মানুষের পরম বন্ধু ডলফিনকে বাঁচতে দিইনি আমরা মানুষরা। প্রকৃতি আর প্রাণীদের বিলুপ্তির কারণ হওয়ায় তারাও আমাদের ওপর আজ প্রতিশোধ নিতে শুরু করেছে। সময় এখনই ডলফিনের মতো যেকোনো বন্য প্রাণী হত্যাকারীকে সামাজিকভাবে বয়কট করা এবং আইনসংগতভাবে রুখে দাঁড়ানোর। দীর্ঘ সমুদ্রসৈকতের পারে বসবাসকারী স্থানীয়দের মধ্য থেকে আগ্রহী স্বেচ্ছাসেবক তৈরি করে তাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে ডলফিনসহ সাগরপারের প্রকৃতি সংরক্ষণে নেওয়া উদ্যোগ আমাদের আশার আলো দেখাচ্ছে। জেলেদের মানবিক বোধ ও সচেতনতা তৈরিতে নিতে হবে কার্যকর উদ্যোগ। দায়ীদের চিহ্নিত করে নিতে হবে শাস্তির ব্যবস্থা।

‘পৃথিবীর অস্তিত্বের জন্য প্রাণিকুল বাঁচাই’—এ প্রতিপাদ্য ধারণ করে গত ৩ মার্চ পালিত হলো বিশ্ব বন্য প্রাণী দিবস। আর তার অল্প কিছুদিন পর এতগুলো ডলফিন হত্যা আমাদের লজ্জিত করে, করে ব্যথিত। পৃথিবীর অস্তিত্ব বিপন্নের কারণ হচ্ছি আমরা। আর এ দায়বদ্ধতা আমাদের সবার।

লেখক : জেলা প্রশাসক, কক্সবাজার

১৪ মে ২০২০ ইং

299 ভিউ

Posted ২:৫৩ পূর্বাহ্ণ | শুক্রবার, ১৫ মে ২০২০

coxbangla.com |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

এ বিভাগের আরও খবর

Editor & Publisher

Chanchal Dash Gupta

Member : coxsbazar press club & coxsbazar journalist union (cbuj)
cell: 01558-310550 or 01736-202922
mail: chanchalcox@gmail.com
Office : coxsbazar press club building(1st floor),shaheed sharanee road,cox’sbazar municipalty
coxsbazar-4700
Bangladesh
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
বাংলাদেশের সকল পত্রিকা সাইট
Bangla Newspaper

ABOUT US :

coxbangla.com is a dedicated 24x7 news website which is published 2010 in coxbazar city. coxbangla is the news plus right and true information. Be informed be truthful are the only right way. Because you have the right. So coxbangla always offiers the latest news coxbazar, national and international news on current offers, politics, economic, entertainment, sports, health, science, defence & technology, space, history, lifestyle, tourism, food etc in Bengali.

design and development by : webnewsdesign.com