কক্সবাংলা ডটকম(৭ জানুয়ারী) :: রাজনৈতিক বিবেচনায় ২০১২ সালে লাইসেন্স পাওয়া নতুন ৯টি ব্যাংক বিগত চার বছরেও শর্ত পূরণ করতে পারেনি। উল্টো লাইসেন্সের চারটি শর্ত শিথিল করতে ব্যাংকগুলো একজোট হয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে লিখিত আবেদন করেছে।
এই ব্যাংকগুলো হলো: দেশীয় উদ্যোক্তাদের মালিকানাধীন মিডল্যান্ড, মেঘনা, ফারমার্স, ইউনিয়ন, মধুমতি, সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংক। আর প্রবাসী উদ্যোক্তাদের মালিকানাধীন ব্যাংকগুলো হলো—এনআরবি কমার্শিয়াল, এনআরবি ও এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক।
আবেদনপত্রে ব্যাংকগুলো শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়া, কৃষিতে ঋণ বিতরণ ও সিএসআর খাতে ব্যয়ের শর্ত এবং শহরের একটি শাখার বিপরীতে গ্রামে একটি করে শাখা খোলার শর্ত শিথিল চেয়েছে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের শীর্ষ একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘এই নয়টি ব্যাংককে লাইসেন্স দিলেও রাজনৈতিক প্রভাবশালীরা এগুলোর মালিক হওয়ায় বাংলাদেশ ব্যাংক পুরোপুরি মনিটরিং করতে পারেনি। এ কারণে একদিকে ব্যাংকগুলো বেপরোয়া ব্যাংকিং করছে, অন্যদিকে চার বছরেও লাইসেন্সের শর্ত পূরণ করতে পারেনি। এখন তারা শর্ত শিথিলের আবেদন করেছে।’
শুধু লাইসেন্সের শর্ত পূরণই নয়, নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করা, ঋণ বিতরণে জালিয়াতি, আগ্রাসী ব্যাংকিং, খেলাপি ঋণ বাড়ানো ছাড়াও ব্যাংকগুলোর নীতি-বহির্ভূত বেশ কিছু ঘটনা ব্যাংকিং খাতের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ফারমার্স ও এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকের অনিয়ম পুরো ব্যাংকিং খাতে ‘পদ্ধতিগত ঝুঁকি’ তৈরি করেছে বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। নতুন এই ব্যাংকগুলোতে একাধিকবার অনুশাসন দিয়েও তা পরিপালন করাতে পারেনি কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক ম. মাহফুজুর রহমান বলেন, ‘যারা লাইসেন্স নেন, তাদের ক্ষমতা লাইসেন্স দেওয়া কর্তৃপক্ষের চেয়ে বেশি হলে, যে শর্তই দেওয়া হোক না কেন, তা তারা মানবে না বা পরিপালন করবে না। এর জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের যোগ্যতা, আন্তরিকতা ও ক্ষমতায়ন জরুরি ছিল। কিন্তু এই তিন ক্ষেত্রেই বাংলাদেশ ব্যাংক সঠিক জায়গায় নেই।
ফলে ব্যাংকগুলোকে ঠিক মতো মনিটরিং করা সম্ভব হয়নি।’ তিনি বলেন, ‘ব্যাংকগুলোর ওপরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ যদি ঠিক মতো থাকতো, তাহলে লাইসেন্সের শর্ত পরিপালন করতে তারা বাধ্য হতো। আবার ব্যাংকগুলোতে অনিয়মও কম হতো।’
তিনি উল্লেখ করেন, ‘যেহেতু বাংলাদেশ ব্যাংক অবস্থা বুঝে ব্যবস্থাও নিতে পারেনি, সে কারণে বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যর্থতাও আছে। ফলে আমরা খুবই ভীত, আঙ্কিত ও শঙ্কিত। এভাবে চলতে থাকলে ব্যাংকিং সেক্টরের ভবিষ্যৎ খুবই অন্ধকার। এখনই যদি সঠিকভাবে লাগাম টেনে না ধরা হয়, তাহলে এই খাত আরও ভয়াবহ রূপ ধারণ করবে। কোনও ব্যাংকের প্রতিই মানুষের বিশ্বাস ও আস্থা থাকবে না।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ‘রাজনৈতিক বিবেচনা থাকলেও বাংলাদেশ ব্যাংক ১৬টি শর্তে এই ব্যাংকগুলোর লাইসেন্সে দিয়েছে। যার মধ্যে সেবায় নতুনত্ব আনার বিষয়টিও ছিল।
কিন্তু বিগত চার বছরে এই ব্যাংকগুলো নতুন পণ্য তো আনতে পারেইনি, উপরন্তু অসুস্থ প্রতিযোগিতায় আগ্রাসী ব্যাংকিং করেছে। এদিকে, বিশেষ মহলের চাপ ও হস্তক্ষেপের কারণে ইতোমধ্যে বেশ কিছু শর্ত শিথিল করা হয়েছে ।
নতুন ব্যাংকগুলোর লাইসেন্সের শর্ত পরিপালন না করার সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দুর্বলতা আছে বলে মনে করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, ‘লাইসেন্সের শর্ত পরিপালনে বাংলাদেশ ব্যাংকের শক্ত অবস্থানে থাকা উচিত।’ তিনি বলেন, ‘নিয়ম না মানা নতুন ব্যাংকের একটি রোগ।
এই ব্যাংকগুলো আবার আগ্রাসী ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে অসুস্থ প্রতিযোগিতায় নেমেছে। এই রোগ সংক্রামক ব্যাধিতে পরিণত হয়ে অন্যান্য ব্যাংকেও ছড়িয়ে পড়ছে। এই রোগী ব্যাংকগুলোর ব্যাপারে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দিতে হবে।’
ইতোমধ্যে আগ্রাসী ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে অসুস্থ প্রতিযোগিতায় নেমে ফারমার্স ব্যাংক এখন চরম আর্থিক সংকটে পড়েছে। ব্যাংকটি না পারছে ঋণ বিতরণ করতে, না পারছে গ্রাহকদের আমানত ফেরত দিতে। টাকা না থাকায় আমানতকারীদের ফিরিয়ে দিতে হচ্ছে। এতে গ্রাহকদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হচ্ছে। একই পরিস্থিতির দিকে যাচ্ছে এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক।
অবশ্য শেষ মুহূর্তে এসে বাংলাদেশ ব্যাংক ফারমার্স ব্যাংক ও এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকে হস্তক্ষেপ করেছে। সম্প্রতি ব্যাংক দু’টি বাঁচাতে পরিচালনা পর্ষদ ঢেলে সাজানো হয়েছে। সরিয়ে দেওয়া হয়েছে দুই ব্যাংকের এমডিদেরও।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত এক বছরেরও বেশি সময় ধরে ফারমার্স ব্যাংকে তারল্য সংকট চলছে। পরিস্থিতি এখন এমন পর্যায়ে গেছে যে, আমানতকারীর দায় পরিশোধের সক্ষমতা নেই ব্যাংকটির। গত এপ্রিল থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে টানা নগদ জমা (সিআরআর) সংরক্ষণে ব্যর্থ হচ্ছে ব্যাংকটি। ফারমার্স ব্যাংকের মতোই এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকেও ঋণ বিতরণে অনিয়ম ও অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার ঘাটতি দেখা দিয়েছে।
এ প্রসঙ্গে ফারমার্স ব্যাংকের উপদেষ্টা প্রদীপ কুমার দত্ত বলেন, ‘ফারমার্স ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পর্ষদ ঠিকমতো কাজ করতে পারেনি। পর্ষদের চাপে ঋণ বেশি দেওয়া হয়েছে। যে কারণে ফারমার্স ব্যাংকে আর্থিক সংকট দেখা দিয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘ফারমার্স ব্যাংকের মতোই যেসব ব্যাংকে সমস্যা রয়েছে, সেগুলো এখান থেকে শিখতে পারে। কারণ, এই ধরনের সমস্যা অন্য ব্যাংকেও আছে।’
যাত্রার পরই পরিচালকদের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পদ ছাড়তে হয় কয়েকটি ব্যাংকের এমডিকে। ব্যাংক পরিচালনা নিয়ে পর্ষদের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পদত্যাগ করতে হয় মিডল্যান্ড ব্যাংকের এমডি একেএম শহীদুলকে। দৈনন্দিন ব্যাংক পরিচালনায় পর্ষদের হস্তক্ষেপের কারণে পদত্যাগ করেন মেঘনা ব্যাংকের এমডি কাইজার এ চৌধুরী। পরে মেঘনা ব্যাংকে মোহাম্মদ নূরুল আমিন এমডি হিসেবে যোগ দিলেও পরবর্তীতে মোহাম্মদ নূরুল আমিনকেও পদত্যাগে বাধ্য করা হয়।
এ প্রসঙ্গে মোহাম্মদ নূরুল আমিন বলেন, ‘যেকোনও ব্যাংকের খারাপ হওয়ার পেছনে মালিকদের ইন্ধন বা অপেশাদার ভূমিকা বা অনাকাঙ্ক্ষিত চাপ থাকে।’ মেঘনা ব্যাংকে ওই ধরনের চাপ ছিল কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ব্যক্তিগত কারণেই আমি মেঘনা ব্যাংক থেকে পদত্যাগ করেছি।’
উল্লেখ্য, লাইসেন্স দেওয়ার সময় ব্যাংকগুলোর জন্য অন্যতম শর্ত ছিল—ব্যাংকিং কার্যক্রম শুরুর তিন বছরের মধ্যে প্রাথমিক গণপ্রস্তাব ইস্যুর (আইপিও) মাধ্যমে উদ্যোক্তা মূলধনের সমপরিমাণ সাধারণ শেয়ার ইস্যু করতে হবে।
অর্থাৎ পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়ে ৪০০ কোটি টাকার উদ্যোক্তা মূলধনের বিপরীতে বাজারে আরও ৪০০ কোটি টাকার শেয়ার ছাড়তে হবে। কিন্তু ব্যাংকিং কার্যক্রম শুরুর চার বছর পেরিয়ে যাওয়ার পরও একটি ব্যাংকও এই শর্ত পালন করতে পারেনি।
এছাড়া, ব্যাংকগুলোর মোট ঋণের অন্তত পাঁচ শতাংশ কৃষি খাতে বিতরণ করার কথা থাকলেও ব্যাংকগুলো তা করেনি। একইভাবে ব্যাংকের নিট মুনাফার অন্তত ১০ শতাংশ সামাজিক দায়বদ্ধতার (সিএসআর) খাতে ব্যয় করার শর্তও পালন করেনি নতুন ৯টি ব্যাংক।
প্রসঙ্গত, ২০১২ সালে ব্যাংকগুলো অনুমোদন দেওয়ার সময় ব্যাপক সমালোচনা হয় এবং অনুমোদন না দেওয়ার দাবিও ওঠে। তবে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীকে ব্যাংকিং ব্যবস্থার আওতায় আনার স্বপ্ন দেখিয়ে অনুমোদন পায় স্থানীয় উদ্যোক্তাদের ছয়টি ব্যাংক। রেমিটেন্স ও বিদেশি বিনিয়োগ আনার প্রতিশ্রুতিতে অনুমোদন পায় প্রবাসীদের উদ্যোগে গঠিত তিনটি ব্যাংক।
Posted ২:২৫ পূর্বাহ্ণ | সোমবার, ০৮ জানুয়ারি ২০১৮
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta