বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) নীতিমালা মানছে না— এমন প্রতিষ্ঠান থেকে ওষুধের নিম্নমানের কাঁচামাল আমদানি করছে দেশের স্বনামধন্য একাধিক কোম্পানি। অ্যাক্টিভ ফার্মাসিউটিক্যাল ইনগ্রেডিয়েন্টস (এপিআই) হিসেবে কেউ ইনসুলিনের, কেউ ক্যান্সারের, কেউ আবার অ্যান্টিবায়োটিকের নিম্নমানের কাঁচামাল আনছে। এসব কাঁচামাল আনা হচ্ছে চীনের ঝেজিয়াং হাইসান ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি থেকে। নিম্নমানের এ কাঁচামালে উৎপাদিত ওষুধের মান নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন বিশেষজ্ঞরা।
ওষুধ ও এর কাঁচামাল উৎপাদনে ডব্লিউএইচওর সুনির্দিষ্ট নীতিমালা রয়েছে, যা কারেন্ট গুড ম্যানুফ্যাকচারিং প্র্যাকটিস (সিজিএমপি) হিসেবে পরিচিত। ঝেজিয়াং হাইসানের কারখানায় সিজিএমপি পরিপালনে বড় ধরনের ব্যত্যয় পেয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে খাদ্য ও ওষুধের মান নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা ইউএস ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এফডিএ)। ঝেজিয়াংকে এজন্য সতর্কও করেছে তারা।
২০১৫ সালের ২-৭ মার্চ এফডিএর তদন্তকারী কর্মকর্তারা চীনের ঝেজিয়াং প্রদেশে ঝেজিয়াং হাইসান ফার্মাসিউটিক্যালের কারখানা পরিদর্শন করেন। এ পরিদর্শন ও ঝেজিয়াং হাইসান ফার্মাসিউটিক্যালের দেয়া তথ্য যাচাই শেষে এপিআই উৎপাদনে সিজিএমপির বড় ধরনের ব্যত্যয় পায় এফডিএ। এ ধরনের ব্যত্যয়ের কারণে প্রতিষ্ঠানটির উৎপাদিত পণ্য যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল ফুড, ড্রাগ অ্যান্ড কসমেটিক অ্যাক্টের বেশ কয়েকটি ধারায় উল্লিখিত মান অনুযায়ী ভেজাল হিসেবে চিহ্নিত করে তারা।
এ প্রতিষ্ঠান থেকেই ইনসুলিনের কাঁচামাল ইনসুলিন অ্যাসপার্ট (জেনেরিক নাম) আমদানি করছে দেশের প্রথম সারির ওষুধ কোম্পানিগুলোর একটি ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড। ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের ব্লক লিস্টের তথ্য অনুযায়ী, এফডিএর সতর্ক করা ঝেজিয়াং হাইসান থেকে গত বছরের ৯ জুলাই ৭৫০ গ্রাম, ৩ মে ২০০ গ্রাম, ৭ মে ২০০ গ্রাম ইনসুলিন অ্যাসপার্ট কাঁচামাল আমদানি করেছে কোম্পানিটি। একই কাঁচামাল তারা চলতি বছরের ৯ আগস্ট আমদানি করেছে ৫০০ গ্রাম, ৩০ মে ২৫০ গ্রাম ও ৩০ মে ২৫০ গ্রাম। এসব কাঁচামালে গ্লাইসেটআর ইনসুলিন উৎপাদন ও বিপণন করছে ইনসেপ্টা। দেশে ইনসুলিনের বাজারের বড় অংশ ইনসেপ্টার নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।
জানতে চাইলে ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আবদুল মোক্তাদির বলেন, প্রডাক্ট রিসার্চের জন্য কিছু কাঁচামাল আনা হয়েছে। তবে ইনসেপ্টা কখনো অননুমোদিত প্রতিষ্ঠান থেকে কাঁচামাল আমদানি করে না। তা ব্যবহারও করে না। তাছাড়া ২০১৫ সালে ইউএস-এফডিএ সতর্ক করলেও এখন যদি ঝেজিয়াং হাইসান ঠিকমতো কাঁচামাল উৎপাদন করে, তাহলে সমস্যা কোথায়?
সতর্ক করে ২০১৫ সালে এফডিএর দেয়া চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে বেশকিছু পদক্ষেপ নেয় ঝেজিয়াং হাইসান। এসব পদক্ষেপ মূল্যায়ন শেষে ২০১৭ সালে প্রতিষ্ঠানটিকে আরেকটি চিঠি দেয় এফডিএ। তাতে বলা হয়, ঝেজিয়াং হাইসানের পক্ষ থেকে যেসব পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে, তা পর্যাপ্ত ও টেকসই কিনা, সেটি নির্ধারণ হবে ভবিষ্যতে এফডিএর আরো পরিদর্শন ও নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমের মাধ্যমে। একই সঙ্গে মানসম্পন্ন উৎপাদন প্রক্রিয়া নিশ্চিতে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা অনুসরণের ক্ষেত্রে এ চিঠি কোনো ধরনের ছাড় হিসেবে বিবেচনা করা যাবে না।
ঝেজিয়াং হাইসান থেকে ক্যান্সারের ওষুধ তৈরির কাঁচামাল আমদানি করছে বীকন ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড। ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের ১২ মার্চ ঝেজিয়াং হাইসান থেকে ক্যান্সারের ওষুধ ব্লিওমাইসিন ইনজেকশনের ৩৭০ গ্রাম কাঁচামাল আমদানি করেছে বীকন। এ কাঁচামাল থেকে বীকন ফার্মা ব্লিওনিক্স ১৫ এমজির ইনজেকশন তৈরি করছে। একই ওষুধ কোম্পানি চলতি বছরের ৬ ও ৩১ মে এবং ২৮ আগস্ট মেরোপেনেম ইনজেকশন তৈরির কাঁচামালও আমদানি করেছে। এ কাঁচামাল থেকে বীকন ফার্মা মেরোকন ১ জিএম ও মেরোকন ৫০০ এমজি ইনজেকশন উৎপাদন ও বিপণন করছে।
জানতে চাইলে বীকন ফার্মাসিউটিক্যালসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ডা. ইবাদুল করিম বলেন, চীনের যে প্রতিষ্ঠান থেকে কাঁচামাল আমদানি করা হচ্ছে, সেটি নির্দিষ্ট কোনো এপিআইয়ের জন্য হয়েছে কিনা, তা ফাইল দেখে বলতে পারব। যদি তেমন সতর্কবার্তা থাকে, তাহলে সেখান থেকে কাঁচামাল আমদানি না করাই ভালো।
চীনা প্রতিষ্ঠানটি থেকে অ্যান্টিবায়োটিকের কাঁচামাল মেরোপেনেম আমদানি করছে জেনারেল ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড। ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরে সংরক্ষিত নথি অনুযায়ী, চলতি বছরের ১০ এপ্রিল ৩৫ কেজি ও ১৯ আগস্ট ৪০ কেজি মেরোপেনেম আমদানি করেছে ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানিটি। এ কাঁচামাল দিয়ে প্রতিষ্ঠানটি ইন্ট্রাপেন ৫০০ এমজি ও ইন্ট্রাপেন ১ জিএম ইনজেকশন তৈরি করছে।
যোগাযোগ করা হলে জেনারেল ফার্মাসিউটিক্যালসের এমডি ডা. মোমেনুল হক বলেন, চীনের ঝেজিয়াং হাইসান ফার্মাকে ইউএস-এফডিএর সতর্ক করার বিষয়টি আমার জানা নেই। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে পরবর্তী পদক্ষেপ নেয়া হবে।
ঝেজিয়াং থেকে মেরোপেনেম কাঁচামাল আমদানি করছে ইবনে সিনা, ইনসেপ্টা ও রেনাটা ফার্মাসিউটিক্যালসও। ঔষধ প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, ইবনে সিনা ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড ১৯ জুলাই ৫০ কেজি মেরোপেনেম আমদানি করেছে। এ কাঁচামাল দিয়ে মেরোট্রাক্স ৫০০ এমজি ও মেরোট্রাক্স ১ জিএম ইনজেকশন তৈরি করছে প্রতিষ্ঠানটি। এছাড়া ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালস চলতি বছরের ২৯ জানুয়ারি, ২৭ মার্চ ও ২৭ জুন তিন দফায় ১৪০ কেজি মেরোপেনেম আমদানি করেছে। এ কাঁচামালে প্রতিষ্ঠানটি আই-পেনাম ১ জিএম ও আই-পেনাম ৫০০ এমজি ইনজেকশন তৈরি করছে। এছাড়া রেনাটা লিমিটেড ৯ আগস্ট একই উৎস থেকে আমদানি করেছে ২০০ কেজি মেরোপেনেম। এ কাঁচামালে তারা মেরোপেন ১ জিএম ও মেরোপেন ২৫০ এমজি ইনজেকশন উৎপাদন ও বিপণন করছে।
ইউএস-এফডিএর সতর্ক করা প্রতিষ্ঠান থেকে এপিআই আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা হবে বলে জানান বাংলাদেশ ওষুধ শিল্প সমিতির মহাসচিব এসএম শফিউজ্জামান। তিনি বলেন, যারা আমদানি করছে তাদের সঙ্গে কথা বলা হবে, যাতে আর কেউ ওই প্রতিষ্ঠান থেকে কাঁচামাল আমদানি না করে।
ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ভারত, চীন, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, নরওয়ে, জার্মানি, সুইজারল্যান্ড, ইতালি, অস্ট্রেলিয়া, ফ্রান্স, ডেনমার্ক, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশ থেকে ২ হাজার ৮০৩টি এপিআই আমদানি হচ্ছে দেশে। এর ২০ শতাংশ আসছে চীন থেকে। এপিআই সরবরাহকারী চীনা প্রতিষ্ঠানগুলোর অন্যতম ঝেজিয়াং হাইসান।
এফডিএর সতর্কবার্তা পাওয়া এ প্রতিষ্ঠান থেকে কাঁচামাল আমদানির বিষয়ে জানতে চাইলে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) রুহুল আমিন বলেন, ওষুধের কাঁচামাল একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যেসব উৎস থেকে এসব কাঁচামাল আনা হচ্ছে, সেটিও সমান গুরুত্বপূর্ণ। চীনের কোম্পানিকে ইউএস-এফডিএ কী ধরনের সতর্ক করেছে, তা খতিয়ে দেখতে অধিদপ্তরের দুজনকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।
ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, দেশে বর্তমানে ২৬৮টি অ্যালোপ্যাথিক ওষুধ তৈরির কারখানা রয়েছে। এসব কারখানার মধ্যে মাত্র পাঁচটি স্বল্পসংখ্যক ওষুধের কাঁচামাল তৈরি করছে। প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে— অ্যাক্টিভ ফাইন কেমিক্যাল, গ্লোব, স্কয়ার, গণস্বাস্থ্য ও বেক্সিমকো। ৯৭ শতাংশ কাঁচামালই আমদানি করতে হচ্ছে।
কাঁচামাল আমদানির উৎস যাতে মানসম্পন্ন হয়, সে ব্যাপারে গুরুত্বারোপ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাসি অনুষদের অধ্যাপক আ ব ম ফারুক বলেন, এপিআই ভালো না হলে উৎপাদিত ওষুধের মানও ভালো হবে না। কোনো ওষুধ কোম্পানি যদি নিম্নমানের কাঁচামাল আমদানি করে, তাহলে সেটি দেখার দায়িত্ব ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের। তবে চীন কিংবা ভারত থেকে আমদানি করা হলেই সেটি নিম্নমানের, তা বলা যাবে না। সুনির্দিষ্ট কোনো কাঁচামালের ক্ষেত্রে এমনটি হতে পারে।