কক্সবাংলা ডটকম(৫ নভেম্বর) :: অংশীদারত্বের ভিত্তিতে ব্যবসা পরিচালনার লক্ষ্যে ২০১৮ সালের মাঝামাঝি সময়ে কৌশলগত বিনিয়োগকারী হিসেবে চীনের সেনজেন ও সাংহাই স্টক এক্সচেঞ্জের সমন্বয়ে গঠিত কনসোর্টিয়ামের সঙ্গে একটি চুক্তি করে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই)।
সিকিউরিটিজ আইন ও ২০১৩ সালের একচেঞ্জ ডিমিউচুয়ালাইজেশন (ব্যবস্থাপনা থেকে মালিকানা পৃথককরণ) আইনের শর্ত অনুসারে ওই চুক্তির মাধ্যমে দেশের প্রধান এ পুঁজিবাজারের ২৫ শতাংশ মালিকানা কিনে নেয় চীনা কনসোর্টিয়াম। সেই সময় পুঁজিবাজারসংশ্লিষ্টদের আশা ছিল এর ফলে ডিএসই কার্যক্রম আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে এগিয়ে যাবে।
কিন্তু চুক্তির প্রায় সাড়ে পাঁচ বছর অতিবাহিত হলেও এখন পর্যন্ত এক্সচেঞ্জটির দৃশ্যমান কোনো উন্নয়ন হয় নাই। যদিও সেই সম্ভাবনা এখনি শেষ হয়ে যায়নি বলেই মনে করেন এক্সচেঞ্জটির বোর্ডসংশ্লিষ্টরা।
ডিএসইর একজন পরিচালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘চীনা কনসোর্টিয়াম এখন পর্যন্ত বাজারের উন্নয়নে কোনো ধরনের অবদান রাখতে পারেনি। তাদের বিনিয়োগ থেকে লাভবান হওয়ার জন্যও এত অল্প সময় (সাড়ে পাঁচ বছর) যথেষ্ট নয়। এ জন্য আরও কিছু সময়ের প্রয়োজন হবে। লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা এখনি শেষ হয়ে যায়নি।’
বাজারসংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে নতুন বিনিয়োগ আনা, বাজারের জন্য সময়োপযোগী নকশা তৈরি, তথ্য প্রকাশ, বিনিয়োগ ব্যবস্থাপনা তদারকি, আইপিও প্রচার, এসএমই মার্কেটের উন্নয়ন ও বিদেশি বিনিয়োগ আনাসহ বেশ কিছু জায়গায় চীনা বিনিয়োগকারীদের ভূমিকা রাখা প্রত্যাশিত ছিল। শুধু তাই নয়, ডিএসইর অবকাঠামোগত উন্নয়ন, আইটি সাপোর্ট, সুশাসন প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখার ব্যাপারেও ছিল প্রত্যাশা। তবে গত প্রায় সাড়ে পাঁচ বছরে যার তেমন কোনো বাস্তবায়ন দেখা যায়নি।
সম্প্রতি পুঁজিবাজারে চীনাদের ভূমিকা নিয়ে একটি জরিপ করে দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্রোকারেজ হাউস ‘লংকাবাংলা সিকিউরিটিজ’।
‘বাংলাদেশ ক্যাপিটাল মার্কেট সেন্টিমেন্ট সার্ভে-২০২৩’ শীর্ষক ওই জরিপে পুঁজিবাজারসংশ্লিষ্ট ১০১ জন বিশ্লেষকের মতামত নেয়া হয়। যেখানে অংশ নেয়া ৫৩ শতাংশ বিশেষজ্ঞ বলেছেন, চীনের সঙ্গে কৌশলগত অংশীদারত্ব পুঁজিবাজারের উন্নয়নে সহায়ক হয়নি। অবশ্য ৩৯ শতাংশ উল্লেখ করেছেন তারা কিছুটা হলেও বাজারের উন্নয়নে ভূমিকা রেখেছে।
জরিপে অংশ নেয়া অনেকেই বলেছেন, চীনা কনসোর্টিয়ামের পক্ষ থেকে যেসব প্রস্তাবনা পেয়েছে, ডিএসই সেগুলো বাস্তবায়ন করতে পারেনি। যদিও ওই প্রস্তাবগুলো অনুসারে বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনার সম্ভাবনা রয়েছে।
অর্থনীতিবিদ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর অবশ্য চীনা অংশীদারত্ব থাকার পরও ডিএসইর উন্নয়ন না হওয়ার পেছনে তিনটি কারণ খুঁজে পেয়েছেন।
করোনা মহামারি, পুঁজিবাজারের অস্থিতিশীল পরিবেশ ও ডিএসই পরিচালনা পর্ষদের নতুন কিছু না নেয়ার মানসিকতাকে এর জন্য দায়ী করেছেন তিনি বলেন, ‘চীনা বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে ডিএসইর অনেক কিছু পাওয়ার ছিল, যা তারা নিতে পারেনি। এ জন্য তাদের মনোভাব অনেকাংশে দায়ী। তবে সব কিছুর আগে বাজার স্থিতিশীল করতে হবে। তাহলে চীনারাও উৎসাহিত হবেন।’
এদিকে ডিএসইর শেয়ার কিনে চীনারাই উল্টো হতাশ হয়েছেন বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান ও পুঁজিবাজার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আবু আহমেদ। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের পুঁজিবাজারের সম্ভাবনা দেখে আসলেও গত কয়েক বছরে তার প্রতিফলন দেখেনি চীনা বিনিয়োগকারীরা’। বিভিন্ন কারণে তারা হতাশ হয়েছেন বলে তিনি মনে করেন।
তথ্য অনুসারে, ২০১৮ সালের ১৪ মে চীনা কনসোর্টিয়ামের সঙ্গে চুক্তি করে ডিএসই। এ চুক্তির মাধ্যমে এক্সচেঞ্জটির ৪৫ কোটি বা মোট শেয়ারের ২৫ শতাংশ ২২ টাকা দরে কিনে নেয় কনসোর্টিয়াম। এ জন্য ৯৪৭ কোটি টাকা পায় ডিএসই। কিন্তু ওই অর্থের বিনিয়োগ পারফরমেন্স নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেছেন ডিএসইর শেয়ারহোল্ডাররা।
এর বাইরে কনসোর্টিয়ামের পক্ষ থেকে ডিএসইর অবকাঠামো ও প্রযুক্তিগত উন্নয়নের জন্য ৩ কোটি ৭০ লাখ ডলার বিনিয়োগের প্রস্তাব করা হয়েছিল। কিন্তু এক্সচেঞ্জটি এ ক্ষেত্রে ‘বাজারের গভীরতা বাড়ানো’ ছাড়া বিনিয়োগ আনার জন্য কনসোর্টিয়ামকে সুনির্দিষ্ট কোনো পদক্ষেপ দেখাতে পারেনি। তাই এ বিনিয়োগ আনাও সম্ভাব হয়নি।
চুক্তির পরের বছর অর্থাৎ ২০১৯ সালে বিদেশি বিনিয়োগ আনার লক্ষ্যে সিএনআই-ডিএসই সিলেক্ট ইনডেক্স (সিডিএসইটি) নামের একটি সূচক চালু করে ডিএসই। সেনজেন সিকিউরিটিজ ইনফরমেশন কোম্পানি লিমিটেড ও ডিএসই যৌথভাবে এ সূচকটির নকশা ও উন্নয়ন কাজ করে। তবে চালুর প্রায় চার বছর হলেও ঢাকার পুঁজিবাজারে সিডিএসইটি সূচকটির তেমন কোনো গুরুত্ব নেই।
এটি নামেমাত্র একটি সূচক হয়ে দাঁড়িয়েছে। যদিও চালুর সময়ে সূচকটি নিয়ে ব্যাপক আশাবাদী ছিল ডিএসইর তখনকার চেয়ারম্যান। এ সূচকটি চালুর পর চীনা কনসোর্টিয়াম ও ডিএসইর প্রচেষ্টায় অনেক বিদেশি বিনিয়োগ আসবে বলেও প্রত্যাশা করেছিলেন। তবে বাস্তবে তার কোনো প্রতিফলনই দেখা যায়নি।
শুধু তাই নয়, চীনা কনসোর্টিয়ামের পক্ষ থেকে ডিএসইতে পরিচালক হিসেবে রয়েছেন জি ওয়েনহাই। ডিএসই শেয়ার কেনার পর তাকে শেয়ারহোল্ডার পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এ পরিচালক ভার্চুয়াল মাধ্যমে নিয়মিত ডিএসইর বোর্ড মিটিংয়ে অংশগ্রহণ করলেও তাদের থেকে কৌশলগত কোনো সাপোর্টই পাওয়া যাচ্ছে না।
‘আমরা চীনা স্টক এক্সচেঞ্জ থেকে কিছুই পাইনি’ এ সুরে তাল মিলিয়ে ডিএসইর অপর এক পরিচালক পরিচয় গোপনের শর্তে বলেন, ‘তারা এখানে বিনিয়োগ করেছে মাত্র। তারাও সামান্য লভ্যাংশ ছাড়া কিছুই পায়নি। তাদের একমাত্র কাজ ডিএসইর বোর্ড মিটিংয়ে অংশগ্রহণ করা।’
তবে ‘চীন কনসোর্টিয়ামের পক্ষ থেকে মনোনীত এ পরিচালক তার বোর্ড মিটিংয়ে অংশগ্রহণ বাবদ প্রাপ্য সম্মানী নিতেও অসম্মতি জানিয়েছেন। এর কারণ হিসেবে তিনি (জি ওয়েনহাই) জানিয়েছেন তাদের দেশের স্থানীয় আইনের পরিপন্থী।’
সাধারণত বোর্ড মিটিংয়ে অংশগ্রহণ করার জন্য ডিএসই তার প্রত্যেক বোর্ড সদস্যকে ১০ হাজার টাকা করে সম্মানী দিয়ে থাকে। চীনা পরিচালকের বোর্ড মিটিং বাবদ সম্মানী জমে দাঁড়িয়েছে ৯ লাখ ৫০ হাজার টাকা। চীনা পরিচালক এর মধ্যে এখন পর্যন্ত ৩ লাখ গ্রহণ করলেও বাকিটা গ্রহণে অসম্মতি জানিয়েছেন।
ডিএসই ও চীনা কনসোর্টিয়ামের মধ্যে কেন মেলবন্ধন হচ্ছে না, তা নিয়ে প্রশ্ন করা হলে ডিএসইর চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. হাফিজ মুহম্মদ হাসান বাবু বিষয়টি খতিয়ে দেখার কথা জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘চীনা বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে আমাদের অনেক কিছুই পাওয়ার সুযোগ ছিল। কেন হচ্ছে না, তা আরেকটু গভীরে গিয়ে দেখতে হবে।’ তবে এখনো সব সম্ভাবনা শেষ হয়ে যায়নি বলেও আশ্বস্ত করেন তিনি। বলেন, ‘একসঙ্গে কাজ করার বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে।’
Posted ১০:১০ অপরাহ্ণ | সোমবার, ০৬ নভেম্বর ২০২৩
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta