কক্সবাংলা ডটকম(১৫ নভেম্বর) :: চলমান ডলার সঙ্কট অর্থনীতির প্রতিটি সূচকে চাপ তৈরি করছে। এই চাপকে কেন্দ্র করে দেশের শেয়ারবাজারও টালমাটাল অবস্থায় চলছে। দেশের অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি হিসেবে এরপ্রভাব পড়ছে শেয়ারবাজারে। ক্রমাগত বেড়ে চলা এই চাপ প্রত্যক্ষকরা যাচ্ছে ফ্লোর প্রাইসের শেয়ারগুলোর দিকে তাকালে। আর ক্রমাগত বেড়েই চলেছে ফ্লোর প্রাইসে অবস্থান করা কোম্পানির সংখ্যা। যেসব কোম্পানির শেয়ারদর ফ্লোর প্রাইসের বেশি রয়েছে, সেগুলোর শেয়ারদর এখন ক্রমাগত কমছে। যেসব কোম্পানির দর লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়ে বিস্ময় জাগাচ্ছিল, সেগুলোর দরই কমছে বেশি।
তবে দাম কমলে শেয়ারের চাহিদা বাড়বে এমনটি নয়। ক্রেতা নেই বললেই চলে, এ কারণে লেনদেন নেমেছে ৫০০ কোটি টাকার ঘরে, গতিশীল পুঁজিবাজারে এক ঘণ্টাতেই এর চেয়ে বেশি টাকা লেনদেন হয়।
অর্থনীতি নিয়ে সামগ্রিক যে উদ্বেগ, তার পাশাপাশি নানা গুজব, গুঞ্জনের প্রভাবও পুঁজিবাজারে। সব মিলিয়ে প্রায় প্রতিদিনই কমছে শেয়ারদর ও সূচক।
আগের দুই দিন ১০০ পয়েন্টের পর মঙ্গলবার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের প্রধান সূচক ডিএসইএক্স কমল ৩৫ পয়েন্ট। সূচকের অবস্থান নেমে এসেছে গত তিন মাসের সর্বনিম্ন অবস্থানে।
দিন শেষে ডিএসইএক্সের অবস্থান দাঁড়িয়েছে ৬ হাজার ২১৮ পয়েন্টে। সূচক এর চেয়ে কম ছিল গত ১৪ আগস্ট, ৬ হাজার ১৭৫ পয়েন্ট।
গত ২৪ অক্টোবর কারিগরি জটিলতায় কয়েক ঘণ্টা লেনদেন বন্ধের দিনটি বাদ দিলে গত ২৪ জুলাইয়ের পর সবচেয়ে কম টাকার শেয়ার হাতবদল হলো।
সারা দিনে লেনদেন হয়েছে ৫৬০ কোটি ৯২ লাখ ৩১ হাজার টাকা। প্রায় চার মাস আগের সেই দিন লেনদেন ছিল ৪৭০ কোটি ৯৭ লাখ ৭১ হাজার টাকা।
বহু কোম্পানির ক্রেতা নেই
এদিন বেড়েছে ২৪টি কোম্পানির দর, কমেছে ৬১টি আর ফ্লোর প্রাইসে থাকে ২৩৪টি কোম্পানির শেয়ারদর আগের দিনের দরে হাতবদল হয়েছে।
বাকি ৭০টি কোম্পানির একটি শেয়ারও হাতবদল হয়নি।
আবার আগের দিনের দরে হাতবদল হয়েছে এমন ২০টি কোম্পানির একটি করে, ৫টি কোম্পানির ২টি করে, ৭টি কোম্পানির ৫টি করে, একটি কোম্পানির ৬টি, দুটি কোম্পানির ৭টি এবং একটি করে কোম্পানির ৮ ও ৯টি শেয়ার হাতবদল হয়েছে।
আরও ২৬টি কোম্পানির এক শ টির কম, ১৫টি কোম্পানির ১০০ থেকে ২০০টি, ১৩টি কোম্পানির ২০০ থেকে ৩০০টি, আরও ১০টি কোম্পানির ৫০০টির কম শেয়ার হাতবদল হয়েছে।
ফ্লোর প্রাইসে লেনদেন হওয়া ২৩৪টি কোম্পানিতে হাতবদল হয়েছে ১৬ কোটি ৭৪ লাখ ৮৫ হাজার টাকা।
যে লেনদেন হয়েছে তার মধ্যে কেবল ১০টিতেই লেনদেনের অর্ধেক হয়েছে। শীর্ষ এই দশে লেনদেন হয়েছে ২৭০ কোটি ৯৭ লাখ ৬৬ হাজার টাকা।
দর কমেছে ব্যাপক হারে
ফ্লোর প্রাইসের বেশি আছে, এমন কোম্পানিগুলোর মধ্যে যেগুলোর দর কমেছে, তার মধ্যে বহুগুলোর পতনের হার ছিল অনেক বেশি।
এর মধ্যে চারটি কোম্পানির দর কমেছে ৯ শতাংশের বেশি, দুটির ৮ শতাংশের বেশি, ৬টির ৭ শতাংশের বেশি, দুটি করে কোম্পানির ৬ ও ৫ শতাংশের বেশি, তিনটির দর কমেছে ৪ শতাংশের বেশি। আরও ৮টির দর কমেছে ৩ শতাংশের বেশি।
এর মধ্যে বেশি কমেছে, এমন কোম্পানিগুলোর শেয়ারদর গত ৩১ জুলাই থেকে ফ্লোর প্রাইস কার্যকরের পর থেকে ক্রমাগত বাড়ছিল।
সবচেয়ে বেশি ৯.৯২ শতাংশ কমেছে ফ্লোর প্রাইস দেয়ার পর ৩৮ টাকা থেকে ৫৪ টাকা হয়ে যাওয়া লাভেলো আইসক্রিম। এই পতনে দর নেমে এসেছে ৩৮ টাকা ১০ পয়সায়।
দ্বিতীয় সর্বোচ্চ এডিএন টেলিকমের দর কমেছে ৯.৮৮ শতাংশ। এই কোম্পানিটির শেয়ারদর ফ্লোর প্রাইসে ৬০ টাকা থেকে বেড়ে ১৫৪ টাকায় উঠে গিয়েছিল। বর্তমান দর ১১২ টাকা ২০ পয়সা।
৫৪ টাকা ১০ পয়সা থেকে ১৪৭ টাকা ৯০ পয়সায় উঠে যাওয়া ইস্টার্ন হাউজিংয়ের দর এখন নেমে এসেছে ৯২ টাকা ৮০ পয়সায় নেমে এসেছে। এটির দাম কমেছে ৯.৭২ শতাংশ।
লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়ে বিস্ময় জাগানো ওরিয়ন ফার্মা দর হারিয়েছে আরও ৯.১২ শতাংশ। ফ্লোর প্রাইসে ৮১ টাকা থেকে বেড়ে ১৫৬ টাকা ৫০ পয়সায় উঠে গিয়ে এরপর কমতে কমতে দর দাঁড়িয়েছে ৯৩ টাকা ৭০ পয়সায়।
একই গ্রুপের আরেক কোম্পানি বিকন ফার্মা দর হারিয়েছে ৮.৪৫ শতাংশ। ফ্লোর প্রাইস দেয়ার পর কোম্পানিটির শেয়ারদর ২৪৬ টাকা ৯০ পয়সা থেকে বেড়ে হয়ে যায় ৩৯৩ টাকা। বিনিয়োগকারীর ব্যাপক আর্থিক ক্ষতির কারণ হয়ে এখন দর দাঁড়িয়েছে ২৫২ টাকা ২০ পয়সা।
৩১ জুলাই ১৬৫ টাকা ২০ পয়সা থেকে টানা বেড়ে পেপার প্রসেসিংয়ের দর উঠে গিয়েছিল ৩৩৯ টকো ৪০ পয়সায়। ৮.৩৭ শতাংশ কমে দর দাঁড়িয়েছে ২১০ টাকা ২০ পয়সায়।
ইন্ট্রাকো রিফুয়েলিং স্টেশনের শেয়ার দর হারিয়েছে ৭.৮০ শতাংশ। দর স্থির হয়েছে ৪১ টাকা ৪০ পয়সা। ফ্লোর প্রাইস দেয়ার পর কোম্পানিটির শেয়ারদর ৩১ টাকা ৭০ পয়সা থেকে বেড়ে ৫২ টাকা হয়ে গিয়েছিল।
সোনালী পেপার দর হারিয়েছে ৭.৪৩ শতাংশ। এই কোম্পানিটির শেয়ারদর ফ্লোর প্রাইস দেয়ার পর ৬৩০ টাকা ৬০ পয়সা থেকে বেড়ে ৯৬৫ টাকা ৮০ পয়সায় উঠে গিয়েছিল। সেখান থেকে কমতে কমতে এখন দাঁড়িয়েছে ৬৯২ টাকা ৬০ পয়সায়।
সোনালী আঁশের দর কমেছে ৬৩ টাকা ৯০ পয়সা বা ৭.৩৮ শতাংশ। কোম্পানিটির শেয়ারদর ফ্লোর প্রাইস দেয়ার পর ৪৪৬ টাকা থেকে বেড়ে ৯৬১ টাকা হয়ে গিয়েছিল। কমতে কমতে এখন দাঁড়িয়েছে ৮০১ টাকা ৬০ পয়সা্।
রাষ্ট্রায়ত্ত বাংলাদেশ শিপিং মিলস-বিএসসি দর হারিয়েছে ৭.৩৭ শতাংশ। দর নেমে এসেছে ১১৪ টাকা ৩০ পয়সায়। ৩১ জুলাই ফ্লোর প্রাইস কার্যকর হওয়ার দিন কোম্পানিটির শেয়ারদর ছিল ১০৯ টাকা ৮০ পয়সা। পরে উঠে যায় ১৭৩ টাকায়। সেখান থেকে কমতে কমতে ফ্লোরের আশেপাশে নেমে এসেছে।
সর্বাধিক দরপতনের দশম স্থানে ছিল জেএমআই হসপিটাল। এটির দর কমেছে ৭.৩৫ শতাংশ। দিন শেষে দর দাঁড়িয়েছে ৭৫ টাকা ৭০ পয়সা। ফ্লোর প্রাইস দেয়ার দিন দর ছিল ৭১ টাকা ১০ পয়সায়। অস্বাভাবিক হারে বাড়তে বাড়তে দর উঠে যায় ১৪২ টাকা ৮০ পয়সায়। বেড়ে যাওয়া প্রায় সব টাকাই হারিয়ে গেছে।
ওরিয়ন গ্রুপের কোম্পানি কোহিনূর কেমিক্যালস দর হারিয়েছে ৭.১৯ শতাংশ। শেয়ারদর নেমেছে ৪৬৭ টাকা ৬০ পয়সায়। এই কোম্পানির শেয়ারদর ফ্লোর প্রাইসে ৩৬৩ টাকা ৬০ পয়সা থেকে বেড়ে উঠে যায় ৭৫৭ টাকা ৪০ পয়সায়।
ফ্লোর প্রাইস দেয়ার পর সবচেয়ে বিস্ময় জাগানো ওরিয়ন ইনফিউশন এদিন দর হারিয়েছে ৫২ টাকা বা ৬.২৯ শতাংশ। ফ্লোর প্রাইস দেয়ার পর ১০৪ টাকা ৭০ পয়সা থেকে এক হাজার টাকায় উঠে যাওয়া শেয়ারদর এখন নেমেছে ৭৮৫ টাকা ৮০ পয়সায়। দুই দিনই দর কমল দুই শ টাকা।
সূচক কমার প্রধান দায় ওরিয়ন গ্রুপের
ফ্লোর প্রাইস দেয়ার পর যে গ্রুপটির শেয়ারদর ক্রমাগতভাবে বৃদ্ধি নিয়ে নানা আলোচনা তৈরি হয়, লভ্যাংশের ঘোষণার পর হতাশা থেকে এই গ্রুপটির শেয়ারদর এখন কমছে সবচেয়ে বেশি।
মঙ্গলবার সূচক যতটা কমেছে, তার মধ্যে বেশিরভাগই কমেছে এই গ্রুপের চার কোম্পানির কারণে। সবচেয়ে বেশি সূচক কমিয়ে যে ১০টি কোম্পানি, তার মধ্যে আছে এই কোম্পানিগুলো।
বিকন ফার্মার দরপতনেই দর কমেছে ১১.৬ পয়েন্ট। ওরিয়ন ফার্মার কারণে কমেছে ৪.৭৪ পয়েন্ট। এছাড়া ওরিয়ন ইনফিউশন ২.৩১ পয়েন্ট আর কোহিনূর ক্যামিকেলস সূচক কমিয়েছে ১.৯৯ পয়েন্ট।
সব মিলিয়ে এই চার কোম্পানির কারণেই সূচক কমেছে ২০.৬৪ পয়েন্ট।
এছাড়া লভ্যাংশের কারণে সমন্বয়ে জেএমআই সিরিঞ্জের কারণে ৪.৩৮ পয়েন্ট, সোনালী পেপারের কারণে ৩.৯৫ পয়েন্ট, বিএসিসির কারণে ২.৯৯ পয়েন্ট, ইস্টার্ন হাউজিংয়ের কারণে ২.০১ পয়েন্ট, এডিএন টেলিকমের কারণে ১.৭১ পয়েন্ট এবং জেএমআই হসপিটালের কারণে ১.৬২ পয়েন্ট সূচক কমেছে। সব মিলিয়ে এই ১০টি কোম্পানির কারণে সূচক কমেছে ৩৭.৩ পয়েন্ট।
বিপরীতে সবচেয়ে বেশি পয়েন্ট বাড়িয়েছে এমন ১০টি কোম্পানির কারণে সূচকে যোগ হয়েছে ১০.৬ পয়েন্ট।
এর মধ্যে বসুন্ধরা পেপার একাই বাড়িয়েছে ৩.৬ পয়েন্ট। দীর্ঘদিন পর স্কয়ার ফার্মার দর বৃদ্ধিতে সূচকে যোগ হয়েছে ১.৭২ পয়েন্ট আর ইউনিক হোটেল ১.২৭ পয়েন্ট এবং জেনেক্স ইনফোসিস যোগ করেছে ১.০৫ পয়েন্ট।
অলিম্পিক ইন্ডাস্ট্রিজ, বাটা সু, লুব রেফ, ইস্টার্ন ক্যাবলস, মবিল যমুনা এবং সামিট অ্যালায়েন্স পোর্ট সূচকে কিছু পয়েন্ট যোগ করেছে।
ফ্লোর প্রাইসের নিচে শেয়ার বিক্রির অনুমতি
বিএসইসির নির্দেশনায় বলা হয়েছে, সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ অধ্যাদেশে প্রদত্ত ক্ষমতা প্রয়োগ করে কমিশন ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই), চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ (সিএসই) এবং সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি বাংলাদেশকে (সিডিবিএল) নির্দেশ দেয় যে, বর্তমান বাজার পরিস্থিতি বিবেচনা করে এক্সচেঞ্জগুলো ব্লক মার্কেটে গ্রাহকদের ক্ষেত্রে বর্তমানে সার্কিট ব্রেকার সিস্টেম ও ফ্লোর প্রাইস থেকে ১০ শতাংশ পর্যন্ত কম দামে শেয়ার লেনদেন করার অনুমতি দিতে পারবে।
এক্ষেত্রে আগের দিনে পাবলিক বা স্পট মার্কেটে লেনদেন শেষে শেয়ারের সর্বশেষ দর থেকে ১০ শতাংশ পর্যন্ত কম দামে শেয়ার বিক্রি করা যাবে।
এছাড়া কমিশনের ২০১৯ সালে ১৪ নভেম্বর এ জারি করা আদেশের অন্যান্য শর্ত অপরিবর্তিত থাকবে৷ এ বিষয়টি অবিলম্বে কার্যকর হবে৷
Posted ৬:০৬ অপরাহ্ণ | মঙ্গলবার, ১৫ নভেম্বর ২০২২
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta