কক্সবাংলা ডটকম(২৪ মে) :: ফুটবল বিশ্বকাপ পৃথিবী জুড়ে কোটি কোটি মানুষের মধ্যে উন্মাদনা সৃষ্টি করে। সেই সাথে খেলোয়াড় থেকে শুরু করে ভক্ত, সবারই প্রচুর অ্যাড্রেনালিন খরচ হয়ে থাকে ম্যাচের উত্তেজনায়। কিছু কিছু উত্তেজনা কখনো কখনো বিতর্কে রূপ নেয়। বিশ্বকাপের ইতিহাসে অনেকগুলো বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। যার সাথে জড়িত ছিলেন খেলোয়াড়, রেফারি, কর্মকর্তাসহ কোনো কোনো দেশের রাষ্ট্রপ্রধানও। আগামী মাসে আবার অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ফুটবল বিশ্বকাপ। তার আগে চলুন দেখে আসি পূর্ববর্তী বিশ্বকাপগুলোর সবচেয়ে বিতর্কিত ১০টি ঘটনা।
১৯৬৬ সালে বিশ্বকাপ ফাইনালে মুখোমুখি হয় ইংল্যান্ড এবং পশ্চিম জার্মানি। নির্ধারিত সময়ের খেলা ২-২ গোলে সমতা থাকায় ম্যাচ গড়ায় অতিরিক্ত সময়ে। অতিরিক্ত সময়ের খেলার ১১ মিনিটে ইংল্যান্ডের জিওফ হার্স্টের শট ক্রসবারের ঠিক নিচে লেগে বলটি নিচে বাউন্স করে।
কিন্তু বলটি গোললাইন অতিক্রম করেছিল কিনা সে বিষয়ে নিশ্চিত ছিলেন না রেফারি গডফ্রায়েট ডায়েন্সট। পরবর্তীতে তিনি সোভিয়েত লাইন্সম্যান তোফিক বাহরামভের সাথে দীর্ঘ আলোচনা করে গোল হিসেবে ঘোষণা দেন কিন্তু জার্মান খেলোয়াড়েরা আজও সেটি মেনে নেননি।
পরবর্তীতে লাইন্সম্যান জানান, বলটি গোললাইনের ভিতরে নাকি বাইরে পড়েছে সেটি তিনি ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করতে পারেননি। তিনি এই বিতর্কের আগুন আরও ঘি ঢেলে যান মৃত্যুর আগে। মৃত্যুশয্যায় বাহরামভকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল যে, তিনি কিভাবে নিশ্চিত ছিলেন বলটি গোললাইন অতিক্রম করেছে। উত্তরে তিনি শুধু বলেন, স্ট্যালিনগ্রাদ। উল্লেখ্য, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে স্ট্যালিনগ্রাদে জার্মানির নাৎসি বাহিনী এবং সোভিয়েত বাহিনীর যুদ্ধে ৭৫ হাজার সোভিয়েত সৈন্য মারা গিয়েছিল।
২০০৬ সালের জার্মানি বিশ্বকাপে গ্রুপ পর্বে অস্ট্রেলিয়া এবং ক্রোয়েশিয়ার ম্যাচে রেফারি ছিলেন গ্রাহাম পুল। কিন্তু তিনি সেই ম্যাচে জন্ম দেন বিতর্কিত এক ঘটনার। রেফারি হিসেবে তিনি হলুদ কার্ডের হিসাব সঠিকভাবে রাখতে পারেননি। ক্রোয়েশিয়ার খেলোয়াড় জসিপ সিমুনিককে তিনি পরপর ২ বার কার্ড দেখালেও তিনি তাকে লাল কার্ড দেখিয়ে মাঠের বাইরে পাঠাননি। কারণ তিনি জসিপ সিমুনিকে প্রথমবার পাওয়া হলুদ কার্ডটি ভুলক্রমে ১ জন অস্ট্রেলিয়ান খেলোয়াড়ের নামে লিপিবদ্ধ করেন।
পরবর্তী ম্যাচে রেফারির মতের বিরোধীতা করার কারণে জসিপ সিমুনিককে তৃতীয়বারের মতো রেফারি গ্রাহাম পুল হলুদ কার্ড দিয়ে মাঠ ছাড়া করেন। ম্যাচটি ২-২ গোলে ড্র হয় কিন্তু অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় রেফারি গ্রাহাম পুল পরবর্তী বিশ্বকাপের আর কোনো ম্যাচ পরিচালনা করতে পারেননি।
বিশ্বকাপ ফুটবলের ইতিহাসে সবচেয়ে ন্যাক্কারজনক ম্যাচের খেতাব পেয়েছে ১৯৬২ বিশ্বকাপের চিলি বনাম ইতালির ম্যাচটি, যেটি ফুটবল বিশ্বে পরিচিতি পেয়েছে ‘ব্যাটল অব সান্তিয়াগো’ নামে। ঘটনার সূত্রপাত হয় মাঠের বাইরে। ইতালির ২ জন সাংবাদিক চিলিকে বিশ্বকাপ আয়োজন করতে দেওয়া পাগলামি হয়েছে বলে খবর প্রকাশ করলে চিলির জনগণ ফুঁসে উঠে। তারা এতটাই ফুঁসে উঠেছিল যে, ইতালির সাংবাদিক ভেবে আর্জেন্টিনার ১ জন সাংবাদিককে পিটিয়ে আহত করে।
পরবর্তীতে দুই দলের খেলা শুরু হলে ১২ সেকেন্ডের মধ্যেই ইতালির জর্জিও ফেরেনি ফাউল করেন। এরপর থেকে শুরু ৯০ মিনিটের ফুটবল ম্যাচ এক যুদ্ধ। ১২ মিনিটে ফেরেনি আবারও ফাউল করলে তাকে রেফারি কেন অ্যাস্টন মাঠ থেকে বের করে দিতে চাইলেও তিনি যেতে অনিচ্ছুক ছিলেন। পরে পুলিশের সহায়তায় তাকে মাঠ থেকে বের করে দেওয়া হয়। ম্যাচের পরবর্তী সময় জুড়েই চলে ২ দলের খেলোয়াড়দের কিল, ঘুষি, লাথিসহ ধুন্ধুমার সব কান্ড। ম্যাচটি চিলি ১-০ গোলে জিতলেও তাদের বেশ কয়েক খেলোয়াড়কে ম্যাচ শেষে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়। পরবর্তীতে সেই ম্যাচের রেফারি কেন অ্যাস্টন বলেন,
প্রচণ্ড ভীত ছিলাম। দুই দলের খেলা দেখে মনে হচ্ছিলো ওরা যেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ফিরে গেছে!
একজন ব্রিটিশ সাংবাদিক বলেন,
ফুটবল ইতিহাসে এটি ছিল সবচেয়ে বিশ্রী, ভয়ঙ্কর, ঘৃণ্য এবং অপমানজনক একটি ম্যাচ।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আগে ১৯৩৮ সালে ফ্রান্সে তৃতীয় বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হয়। বিশ্বকাপে ফ্রান্সের দর্শকরা ইতালির ফ্যাসিবাদের বিপক্ষে ছিল এবং ফ্যাসিবাদের বিপক্ষে থাকা ইতালির অনেক জনগণ ফ্রান্সে চলে এসেছিল।
তারা ইতালিকে দুয়ো দেওয়ার জন্য প্রতি ম্যাচে উপস্থিত হতো। যেদিন ইতালির বিপক্ষে ফ্রান্সে ম্যাচ ছিল সেদিন ফ্রান্স নীল রঙের জার্সি পড়ে খেলতে নামে। ইতালি তখন ফ্রান্সকে তাদের অন্য জার্সি পরে খেলতে বলে, যেটি ছিল সাদা। পরবর্তীতে ইতালির খেলোয়াড়েরা মুসোলিনীর ফ্যাসিবাদী আন্দোলনের প্রতীক কালো রঙের জার্সি এবং শর্টস পড়ে খেলতে নামে যেটা ছিল ফ্রান্সের দর্শকদের জন্য ঘরের মাঠে অপমান। দর্শকরা এটি মেনে নিতে না পেরে উত্তেজিত হয়ে পড়ে। কিন্তু ইতালিয়রা রাজনৈতিকভাবে হারানোর পাশাপাশি মাঠের খেলায়ও ফ্রান্সকে পরাজিত করে। ইতালি পরবর্তীতে টানা দ্বিতীয়বারের মতো বিশ্বকাপ জিতে নেয়।
বিশ্বের অন্যতম সেরা খেলোয়াড় জিনেদিন জিদান ২০০৬ সালের বিশ্বকাপে ইতালির বিপক্ষে ফাইনালে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেননি। তিনি রাগের মাথায় ইতালির খেলোয়াড় মার্কো মাতেরাজ্জির মাথায় ঢুঁ মেরে বসেন। পরবর্তীতে জিদান জানান, মাতেরাজ্জি তার মা-বোনকে উদ্দেশ্য গালি দেওয়ার কারণেই তিনি ঢুঁ মারেন।
সেই ফাইনালে ইতালির কাছে পেনাল্টিতে হেরে বিশ্বকাপ হারায় ফ্রান্স। পরবর্তীতে মাতেরাজ্জির কাছে জিদানকে ক্ষমা চাইতে বলা হলে তিনি জানান,
এর থেকে মরে যাওয়া ভালো।
২০০২ সালের বিশ্বকাপে জাপানের সাথে সহআয়োজক ছিল দক্ষিণ কোরিয়াও। দ্বিতীয় রাউন্ডে দক্ষিণ কোরিয়া মুখোমুখি হয় ইতালির বিপক্ষে। সেই ম্যাচে ইকুয়েডরের রেফারি বায়রন মরেনো বেশকিছু ন্যাক্কারজনক ঘটনার জন্ম দেন। ড্রাইভ দেওয়ার অপরাধে ইতালির ফ্রান্সিসকো টট্টিকে মরেনো দ্বিতীয় হলুদ কার্ড দিয়ে মাঠের বাইরে পাঠান কিন্তু পরবর্তীতে রিপ্লেতে দেখা যায় টট্টিকে ফাউল করা হয়েছিল।
এরপর অতিরিক্ত সময়ে ইতালির ১টি গোল অফসাইডের কারণে বাতিল করে দেন, যদিও সেটি অফসাইড ছিল না। দক্ষিণ কোরিয়া অতিরিক্ত সময়ে ২-১ গোলের জয় তুলে নিলেও রেফারি বায়রন মেরেনোর বিরুদ্ধে অনেকে ম্যাচ ফিক্সিংয়ের অভিযোগ তুলেছিলেন।
১৯৮২ বিশ্বকাপে আলজেরিয়া, পশ্চিম জার্মানি এবং অস্ট্রিয়া একই গ্রুপে ছিল। গ্রুপ পর্বের শেষ ম্যাচ ছিল পশ্চিম জার্মানি এবং অস্ট্রিয়া। কিন্তু এই ৩ দলের সমীকরণ ছিল খুবই জটিল। অস্ট্রিয়া যদি জার্মানির বিপক্ষে ড্র করে বা জয় পায় তাহলে পশ্চিম জার্মানি বিশ্বকাপ থেকে বাদ পড়ে যাবে। আর অন্যদিকে যদি জার্মানি ৩ বা তার বেশি গোলের ব্যবধানে জিতে যায় তাহলে অস্ট্রিয়া বাদ পড়ে যাবে কিন্তু যদি জার্মানি ১ বা ২ গোলের ব্যবধানে জিতে তাহলে আলজেরিয়া বাদ পড়ে যাবে। ম্যাচের ১০ মিনিটের মধ্যে জার্মানি গোল করে এবং ১-০ গোলে এগিয়ে যায় তারা।
এরপর ২ দলের খেলোয়াড়রা পুরো ম্যাচ জুড়ে এদিক সেদিক বল ছোঁড়াছুঁড়ি করতে থাকে। তাদের মাঝে গোল করার কোনো ইচ্ছাই দেখা যাচ্ছিলো না। যেটা ছিল আলজেরিয়ার বিপক্ষে এক প্রকার ষড়যন্ত্র। সেই ষড়যন্ত্রের বলি হয়ে সেবার বিশ্বকাপ থেকে আলজেরিয়া বাদ পড়ে যায়। ফিফার কাছে আলজেরিয়া অভিযোগ জানালেও ফিফা কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। কিন্তু সবাই জানতো এটি একটি ষড়যন্ত্র ছিল।
১৯৮২ বিশ্বকাপে সেমিফাইনালে মুখোমুখি হয়েছিল ফ্রান্স এবং পশ্চিম জার্মানি। দ্বিতীয়ার্ধে ফ্রেঞ্চ ডিফেন্ডার প্যাট্রিক বাত্তিস্তন বল নিয়ে পেনাল্টি বক্সে ঢুকে পড়েন।
তাকে আটকানোর জন্য এগিয়ে আসেন জার্মান গোলরক্ষক হ্যারল্ড শুখামার। প্যাট্রিক বাত্তিস্তন যখন বলে শট নিতে যাবেন তখন শুখামার এসে তাকে সজোরে আঘাত করেন। বাত্তিস্তন অজ্ঞান হয়ে পড়েন এবং তার ৩টি দাঁত ভেঙে যায়। মাথায় প্রচন্ড আঘাতের কারণে তিনি পরবর্তীতে কোমায় চলে যান। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে রেফারি এই ঘটনায় কোনো ফাউলের নির্দেশ দেননি। ম্যাচটিতে পশ্চিম জার্মানি জয় পায় এবং ফাইনালে উঠে যায়।
১৯৭৮ সালের বিশ্বকাপের আসর বসেছিল আর্জেন্টিনায়। কিন্তু এই বিশ্বকাপটি নানাভাবে বিতর্কিত ছিল। সবচেয়ে বড় বিতর্ক ছিল আর্জেন্টিনা বনাম পেরু ম্যাচটি ঘিরে। দ্বিতীয় রাউন্ডে ৪টি দলকে ২টি গ্রুপ ভাগ করা ছিল।
প্রতিটি গ্রুপ থেকে ২টি দল সেমিফাইনালে যাবে। একই গ্রুপে ছিল পেরু, ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা এবং পোল্যান্ড। সেমিফাইনালে ওঠার জন্য আর্জেন্টিনার সামনে সমীকরণ দাঁড়ায় কমপক্ষে ৪ গোলের ব্যবধানে জয়। প্রথমার্ধে আর্জেন্টিনা ২-০ গোলে এগিয়ে থাকার পর দ্বিতীয়ার্ধে পেরু ইচ্ছাকৃতভাবে আর্জেন্টিনার কাছে আত্মসমর্পণ করে।
আর্জেন্টিনা ৬-০ গোলে ম্যাচটি জিতে নেয়। পরবর্তী এই ম্যাচ ঘিরে অনেক গুজব ছড়িয়ে পড়ে। কেউ বলেন, আর্জেন্টিনার জান্তা সরকার পেরুর খেলোয়াড়দের ভয় দেখিয়েছে। আবার কেউ বলেন, আর্জেন্টিনার কাছে থেকে বাণিজ্যিক সুবিধা নেওয়ার জন্য পেরু ম্যাচটি ইচ্ছাকৃতভাবে হেরে যায়। পরবর্তীতে আর্জেন্টিনা ঘরের মাঠের বিতর্কিত বিশ্বকাপ জিতে নেয়।
১৯৮৬ বিশ্বকাপে কোয়ার্টার ফাইনালে মুখোমুখি হয় ইংল্যান্ড এবং আর্জেন্টিনা। প্রথমার্ধে ১-১ গোলে সমতা থাকার পর দ্বিতীয় ষষ্ঠ মিনিটের খেলার সময় ইংল্যান্ডের বক্সে বল আসে। ইংল্যান্ডের স্টিভ হজ ব্যাকপাস করেন গোলকিপার পিটার শিল্টনকে। কিন্তু হাওয়ায় ভাসানো বলটি হেড করার জন্য লাফিয়ে উঠেন ম্যারাডোনা। কিন্তু ম্যারাডোনা হেড না করে কৌশলে হাত দিয়ে বলটি জড়ান, যেটি রেফারি আল বিন নাসের ধরতে না পেরে গোলের বাঁশি দেন এবং আর্জেন্টিনা সেই গোলের সুবাদে ২-১ গোলে ম্যাচ জিতে নেয় আর্জেন্টিনা।
ম্যাচ শেষে ম্যারাডোনাকে গোলের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন,
সামান্য ম্যারাডোনার হেড ছিল এবং সামান্য ঈশ্বরের হাত ছিল।
সেই থেকে এই ঘটনার নাম হয়ে যায় ‘হ্যান্ড অব গড’। ফুটবলের সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা এটি।
Featured Image: thesefootballtimes.co
Posted ২:৫৫ পূর্বাহ্ণ | শুক্রবার, ২৫ মে ২০১৮
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta