কক্সবাংলা ডটকম(১৬ ফেব্রুয়ারী) :: ব্যবসা-বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও ভূরাজনৈতিক দিক থেকে পশ্চিমা দেশগুলোর ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে ২০০৯ সালে লুক ইস্ট নীতি গ্রহণ করে সরকার। এরপর পেরিয়েছে এক দশকেরও বেশি। কিন্তু এ দীর্ঘ সময়ের মধ্যেও এখনো প্রাচ্যের দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক কাঙ্ক্ষিত অবস্থানে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। বরং নানা কারণে গভীর হওয়ার আগেই এ সম্পর্ক ধাক্কা খাচ্ছে বারবার।
বাংলাদেশের সম্পর্ক বৃদ্ধি নিয়ে একাধিক চুক্তি রয়েছে। সরাসরি ফ্লাইট চালু, কৃষি, যোগাযোগ, সংস্কৃতি, দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যসহ অনেক কিছু। তবে দীর্ঘদিন এ চুক্তি বা সম্পর্কগুলোকে সুযোগ দেয়া হচ্ছে না। বাংলাদেশের কাছে গুরুত্বপূর্ণ দেশগুলোকে যে মনোযোগ দেয়া হয়, তার ১ শতাংশ মনোযোগও চীন ছাড়া পূর্বের অন্য দেশগুলোয় দেয়া হয়নি।
পূর্বে বাংলাদেশের লুক ইস্ট নীতির আওতাভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে সব দিক থেকেই সবচেয়ে প্রভাবশালী দেশ চীন। স্বাভাবিকভাবেই এ নীতিতে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে চীন। যদিও দেশটির কাছ থেকে প্রত্যাশা মতো অনেক কিছুই আদায় করতে পারেনি বাংলাদেশ।
২০১৬ সালে দেশটির প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সফরের মধ্য দিয়ে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক অন্য উচ্চতায় পৌঁছার প্রত্যাশা তৈরি হয়। প্রায় ৩০ বছরে কোনো চীনা প্রেসিডেন্টের প্রথম বাংলাদেশ সফর ছিল সেটি। মূলত বেল্ট অ্যান্ড রোড উদ্যোগ এগিয়ে নেয়ার প্রয়াস থেকেই ওই সময়ে বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন শি জিনপিং। সে সময় দুই দেশের বাণিজ্য ও বিনিয়োগে সহযোগিতার কয়েকটি ক্ষেত্র নির্দিষ্ট করা হয়। এগুলো হচ্ছে ভৌত অবকাঠামো, শিল্প উৎপাদনে সক্ষমতা বাড়াতে সহযোগিতা, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি, সড়ক যোগাযোগ, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি এবং কৃষি। চীনা প্রেসিডেন্টের ওই সফর চলাকালে দুই দেশের মধ্যে ২ হাজার ৫৩ কোটি ডলারের ঋণ চুক্তি হয়। এ ঋণ বাবদ পাওয়া অর্থ ব্যয় হওয়ার কথা ছিল ২৭টি উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে, যার সবগুলোই ছিল চলতি বছরের মধ্যে বাস্তবায়নযোগ্য। কিন্তু অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) তথ্য বলছে, গত অক্টোবর পর্যন্ত এসব প্রকল্পের মধ্যে চূড়ান্ত ঋণ চুক্তি সই হয়েছে মাত্র ছয়টি প্রকল্পে। এসব প্রকল্পের জন্য চীন থেকে পাওয়া যাবে ১০৬ কোটি ৭৭ লাখ ডলার।
বাংলাদেশের জন্য এ মুহূর্তে সবচেয়ে বড় সমস্যাগুলোর একটি রোহিঙ্গা সংকট। এ সংকট মোকাবেলায় চীনকে পাশে পায়নি বাংলাদেশ। বরং শুরু থেকেই একপেশে আচরণ করে এসেছে দেশটি। ধারাবাহিকভাবে কূটনৈতিক প্রয়াস চালানোর পরও ইস্যুটিতে শুরু থেকেই মিয়ানমারের প্রতি সহানুভূতি দেখিয়ে এসেছে চীন। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে এ সমস্যা সমাধানে গৃহীত অনেক প্রয়াস অকার্যকর হয়েছে শুধু চীন ও রাশিয়ার ভেটোতে।
প্রস্তাবিত বিসিআইএম অর্থনৈতিক করিডোর রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে ভূমিকা রাখবে বলে বারবার বক্তব্য দিয়েছেন চীনা প্রতিনিধিরা। যদিও রোহিঙ্গা সংকটের মতো এ অর্থনৈতিক করিডোর স্থাপনের বিষয়টিও এখন এক ধরনের অচলাবস্থার মধ্যে রয়েছে। এছাড়া এখন পর্যন্ত চীনের সঙ্গেই বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি সবচেয়ে বেশি। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে চীনে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি ছিল ১ হাজার ১০১ কোটি ডলার।
এ বিষয়ে কূটনীতিকদের মন্তব্য হলো, চীনকে যে মনোযোগ দেয়া হয়েছে, তাতে ঘাটতির জায়গাটি খুঁজে বের করতে হবে। কারণ এত কূটনৈতিক বিনিয়োগের পরও সে অর্থে চীনকে পাশে পাচ্ছে না বাংলাদেশ। ফলে এখনো বাংলাদেশ আয় ও সহযোগিতার ক্ষেত্রে পশ্চিমা নির্ভরশীল। আর পূর্বে চলছে বড় অংকের বাণিজ্য ঘাটতি আর দায় নিয়ে।
চীনের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক আরেক দফা হোঁচট খেয়েছে চলমান নভেল করোনাভাইরাস সংকটে। এ সংকটের কারণে সমস্যায় পড়তে যাচ্ছে তৈরি পোশাকসহ দেশের রফতানি খাতের অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান। কারণ বাংলাদেশ থেকে রফতানিজাত বিভিন্ন পণ্যের কাঁচামালের প্রায় ৭০ শতাংশই আসে চীন থেকে। নভেল করোনাভাইরাসের কারণে কারখানা বন্ধ থাকায় সময়মতো কাঁচামাল শিপমেন্ট হচ্ছে না দেশটি থেকে। বাংলাদেশের আমদানি-রফতানি বাণিজ্যে এর প্রভাব অতিসত্বর দৃশ্যমান হতে যাচ্ছে।
সন্দেহ নেই, করোনাভাইরাসের কারণে চীনের সঙ্গে বাণিজ্যিক স্থবিরতা দীর্ঘ হলে দেশের পুরো রফতানি খাত সংকটে পড়বে। কারণ ইউরোপ, আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশে যে রফতানি হচ্ছে, তার প্রায় ৭০ শতাংশ কাঁচামাল চীন থেকে আসে। অন্যদিকে দুই দেশের ব্যবসায়ীদের মধ্যে এক দেশ থেকে অন্য দেশে যাতায়াতও এখন বন্ধ। সরকারও সম্প্রতি চীনা নাগরিকদের জন্য অন-অ্যারাইভাল ভিসা সুবিধা সাময়িকভাবে স্থগিত করে দিয়েছে।
শুধু বাণিজ্য নয়, দ্বিপক্ষীয় আরো অনেক বিষয়কেই ঝুঁকিতে ফেলে দিয়েছে নভেল করোনাভাইরাস। গত কয়েক বছরে চীনে বাংলাদেশী শিক্ষার্থী গমনের হার অনেক বেড়েছে। কিন্তু নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়তেই সেখান থেকে ফিরে আসতে চাইছেন শিক্ষার্থীরা। এ সংকটের কারণে ভবিষ্যতেও সেখানে বাংলাদেশ থেকে শিক্ষার্থী গমনের হার হ্রাস পাওয়ার ব্যাপক শঙ্কা রয়েছে।
শুধু চীন নয়, নভেল করোনাভাইরাসের কারণে চীনসহ পূর্বের সব দেশেই বাংলাদেশীদের ভ্রমণ কমে এসেছে। হংকং, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, জাপানসহ পূর্বের দেশগুলোয় ভ্রমণের সূচি বাতিল করছেন অনেকে। সরকারও চীন ভ্রমণ নিরুৎসাহিত করছে।
শুধু পশ্চিমা নির্ভরশীল না হয়ে পূর্বের সঙ্গেও সম্পর্ক গাঢ় করার সিদ্ধান্ত ছিল বাংলাদেশের। তবে সম্পর্ক সে অর্থে বাড়েনি। সম্পর্ক বাড়ানোর ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখে রাজনৈতিক সম্পর্ক উন্নয়ন। চীন সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন প্রতিনিধি দলের সফর আদান-প্রদান হলেও বাস্তবিক অর্থে সম্পর্ক গাঢ় হয়নি। বাংলাদেশের যুক্তিসংগত কারণ রোহিঙ্গা সংকটে চীনকে পাশে পায়নি ঢাকা। অন্যদিকে পূর্বে চীনের বন্ধু দেশগুলোও এ সংকটে এক প্রকার নিশ্চুপই থেকেছে। সার্বিকভাবে পূর্বের দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক ঠিক কাঙ্ক্ষিত অবস্থানে নিয়ে যাওয়া যায়নি। দ্বিপক্ষীয় রাজনৈতিক সম্পর্কে শক্ত অবস্থান তৈরি না হওয়ায় সেসব দেশে বাংলাদেশী পণ্যের বাজারও সে অর্থে তৈরি হয়নি। দ্বিপক্ষীয় রাজনৈতিক সম্পর্ক গাঢ় করার আগেই রোহিঙ্গা সংকট ও করোনাভাইরাসের কারণে বাংলাদেশের লুক ইস্ট নীতির ফল বাস্তবে পরিণত হচ্ছে না, বারবার বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
আসিয়ানের সদস্য দেশগুলোর মধ্যে পণ্য পরিবহন, জনশক্তির আদান-প্রদান, মুক্ত সেবা, শুল্ক ও অশুল্কসহ কোনো ধরনের বাধা এখন আর নেই। বাংলাদেশ চেয়েছিল আসিয়ানভুক্ত দেশের সঙ্গে সম্পর্ক দৃঢ় করার মাধ্যমে এই একত্রীকরণের সুবিধা নিতে। এজন্য ফিলিপাইনসহ আসিয়ানের সদস্য রাষ্ট্রগুলোর কয়েকটির সঙ্গে সরকারি ও কূটনৈতিক পাসপোর্টধারীদের মধ্যে ভিসামুক্ত প্রবেশাধিকারের চুক্তিও সই হয়েছে। সরকারি ও কূটনৈতিক পাসপোর্টধারীদের মধ্যে ভিসামুক্ত প্রবেশাধিকার হলেও রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্কে তার প্রভাব পড়েনি। আসিয়ানের বাজারে বাংলাদেশী পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার পেতে পণ্য পরিবহন, জনশক্তির আদান-প্রদান, মুক্ত সেবা, শুল্ক ও অশুল্কসহ বিভিন্ন বিষয় আলোচনার টেবিলে এলেও তা কার্যকর হয়নি।
এ বিষয়ে সরকারের বক্তব্য হলো, আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোসহ পূর্বের দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক এগিয়ে নেয়ার চেষ্টা চলছে। পূর্বে আমাদের যে বিশাল অংকের বাণিজ্য ঘাটতি, তা কমাতে বাজার সম্প্রসারণের দৃষ্টিকোণ থেকে লুক ইস্ট নীতি সময়পোযোগী। তবে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক সম্পর্ক গাঢ় না হওয়ার কারণে পূর্বের সঙ্গে সম্পর্ক ঠিক সেভাবে এগিয়ে নেয়া সম্ভব হচ্ছে না। ফলে পূর্বের দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক এখনো ‘শুধু বন্ধুত্বের’ পর্যায়েই রয়েছে। তবে ভালো দিক হচ্ছে, দেশগুলোর সঙ্গে একটা যোগাযোগ স্থাপন হয়েছে।
বাংলাদেশ একসঙ্গে জাপানের ‘বিগ বি’, চীনের ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড’, ইউরোপের ‘ইউরোএশিয়া’ এবং যুক্তরাষ্ট্রের ‘ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল’ সবগুলোয় রয়েছে। ফলে বাংলাদেশ আসলে কোন দিকে, তা বুঝতে সময় নিচ্ছে দেশগুলো। স্বাভাবিক সম্পর্ক এগিয়ে নিয়ে গেলেও গাঢ় বন্ধুত্ব এখনো গড়ে ওঠেনি। গত ১০ বছরে কূটনৈতিক দিক থেকে বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ ছিল ভারত, চীন ও রাশিয়ায়। এ তিনটি দেশ রোহিঙ্গা সংকটের মতো আইনসিদ্ধ সংকটেও পাশে আসেনি। যেখানে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক সম্পর্ক গাঢ় নয়, সেখানে অর্থনৈতিক সম্পর্ক গাঢ় হওয়া মুশকিল।
লুক ইস্ট নীতিকে ভালো ধারণা বললেও এটি বাস্তবায়নের জন্য যে দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি, কূটনৈতিক কাঠামো ও সমন্বয়ের প্রয়োজন ছিল, তার অভাব রয়েছে, বেশ লম্বা সময় ধরে আমরা লুক ইস্ট নীতি নিয়ে আলোচনা করছি। দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি, কূটনৈতিক কাঠামো ও সমন্বয়ের অভাবে এর প্রত্যাশিত সুফল আমরা পাইনি। তবে তার অর্থ এই নয়, এ থেকে আমরা সুফল পাব না। যেকোনো নীতি করলে কিছু প্রশ্নের সমাধান করতে হয়। সে নীতি কেন করছি? কীভাবে করব? আর কী লক্ষ্যে পৌঁছতে চাই? এটার একটা সুনির্দিষ্ট কাঠামো দরকার। আমাদের সমস্যা হচ্ছে, আমরা নীতি তৈরি করি। কিন্তু তার সঙ্গে যে সাপোর্ট ও অবকাঠামোগুলো দরকার, তা নিয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো গবেষণা নেই। ফলে নীতিগুলো বিচ্ছিন্নভাবে আবির্ভূত হয়। যখন বাস্তবায়ন করতে যাওয়া হয় বা প্রত্যাশা তৈরি হয়, তখন সেই প্রত্যাশার সঙ্গে বাস্তবতার মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। এ নিয়ে আমাদের আরো গবেষণা দরকার।
আর এ লুক ইস্ট নীতির কারণে পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্কে কিছুটা ভাটা পড়েছে। বিশেষ করে পশ্চিমা দেশগুলোর বাংলাদেশে সহায়তা কমে এসেছে। বিভিন্ন সূচকে বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়া এবং গ্রামীণ উন্নয়ন নিয়ে পশ্চিমা দেশগুলো আগে যে পরিমাণ সোচ্চার ছিল, তা এখন কমে এসেছে। বর্তমানে দেশগুলো ব্যবসাকে লক্ষ্য করে, বিশেষ করে পোশাক শিল্পের জন্য বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। ফলে সম্পর্কে হূদ্যতা কমে এসেছে। পোশাক শিল্পে বাংলাদেশের যে তুলনামূলক সুবিধা রয়েছে, তা ভাঙতে আফ্রিকার দেশগুলোয় পশ্চিমা বিনিয়োগ বাড়ালেও বিকল্প হয়ে উঠতে পারেনি কেউই।
লেখক : তাসনিম মহসিন
Posted ৮:২৩ অপরাহ্ণ | রবিবার, ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২০
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta