কক্সবাংলা ডটকম(৪ মে) :: আরএসএফ (রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস)-এর সাম্প্রতিক রিপোর্টে বাংলাদেশে সেন্সরশিপের দুটো কারণের কথা বলা হয়েছে, কিন্তু রিপোর্টটি বিভ্রান্তিমূলক। এখানে বলা হয়েছে, ইসলামিক চরমপন্থা এবং আইসিটি ৫৭ ধারা বাংলাদেশের অবাধ ও মুক্তি গণমাধ্যমের অবস্থার অবনতি হয়েছে। পশ্চিমা দৃষ্টিকোণ দ্বারা প্রভাবিত এই বিশ্লেষণে হতাশার বহি:প্রকাশ ছাড়া বেশি কিছু নেই।
এমন নয় যে বাংলাদেশে সেন্সরশিপের মাত্রা কম বরং এটা অনেক ব্যাপক। তার কারণ হলো প্রায় সবাই এখানে সেন্সরশিপের ব্যাপারে আগ্রহী। এটা একটা সহযোগিতামূলক সেন্সরশিপের রাষ্ট্র যেখানে সরকার, মালিক, মিডিয়া কর্মী এমনকি গ্রাহক সবাই এখানে জড়িত। অন্য কিভাবে এটা জনপ্রিয় হতে পারতো?
আরএসএফ’র উদ্ধৃতিগুলোর সীমাবদ্ধতা
সেন্সরশিপের প্রথম কারণ হিসেবে যেটির উল্লেখ করা হয়েছে, সেটা হলো ডিজিটাল আইন বিশেষ করে আইসিটি ৫৭। অনেকেই এই আইনের শিকার হয়েছেন। কিন্তু যে কোন পর্যালোচনাতেই দেখা যাবে যে অধিকাংশ মামলা অ-সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে দায়ের করা হয়েছে এবং যারা মামলা করেছেন তাদেরও অধিকাংশই জনগণের অংশ, সরকারের নয়। দুটো কারণ দেখানো হয়েছে। অধিকাংশ মামলায় করা হয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশিত পোস্টের বিরুদ্ধে, মূলধারার মিডিয়ার বিরুদ্ধে নয় তাই সংবাদপত্রের স্বাধীনতাকে হামলা করা হয়নি, বরং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের স্বাধীনতাকে হামলা করা হয়েছে।
সাংবাদিকদের বিরুদ্ধেও মামলা হয়েছে কিন্তু অধিকাংশই স্থানীয় পর্যায়ে এবং সেগুলোর কারণও স্থানীয় বিবাদ। এই হয়রানি করাটা যদি সরকারের উদ্দেশ্য হতো, তাহলে তারা পুলিশ ক্লিয়ারেন্সের ব্যাপারটি বাধ্যতামূলক করতো না। তাছাড়া আওয়ামী লীগ মামলা করার আগে দলীয় কর্মীদের ক্লিয়ারেন্স নেয়ার নির্দেশনাও দিতো না।
যদিও এরপরও মামলা চলছে, কিন্তু গত বছরের তুলনায় সংখ্যাটা কম। উভয় পক্ষের মিডিয়া কর্মীরা একজোট হয়ে সরকারকে চাপ দেয়ার পর পরিস্থিতির এই উন্নতি হয়েছে। মূলধারার মিডিয়া কর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা করলে সেজন্য রাজনৈতিক মূল্য দিতে হয় এবং আইসিটি অনেকটা এন্টি-মিডিয়া আইন হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। কিন্তু মামলাগুলোর একটা বড় সংখ্যা হলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের পোস্টের বিরুদ্ধে। এমনকি সবশেষ বিডিজবস.কমের সিইও’র বিরুদ্ধে যে মামলাটি হয়েছে, সেটিও তার একটি আপত্তিকর পোস্টের কারণে যেখানে প্রধানমন্ত্রীকে বিদ্রুপ করা হয়েছে।
তাই মামলাগুলোর প্রধান লক্ষ্য মূলত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। সাধারণ মিডিয়ার বিরুদ্ধেও অনেক মামলা হয়েছে কিন্তু সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী তারা নয়, যেমনটা আরএসএফের রিপোর্টে বলা হয়েছে।
অন্য কারণ হিসেবে বলা হয়েছে চরমপন্থার প্রভাব। কিন্তু, বিষয়টি সম্পর্কে যাদের ধারণা রয়েছে, তারা জানেন যে এটা সত্য নয়। যেটা করতে হবে সেটা হলো যে কোন সংবাদপত্র খুলে দেখা এবং যাচাই করা কিভাবে জঙ্গি সংক্রান্ত খবর প্রকাশিত হয়েছে। মিডিয়া জঙ্গিদের ব্যাপারে ভীত নয় এবং এই হুমকি যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা হয়েছে। আসলে এই ব্যাপারে যদি কোন বাধা থাকতো, তাহলে এ সংক্রান্ত রিপোর্টগুলো আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর প্রেস রিলিজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকতো। কিন্তু সে ধরনের রিপোর্ট সামান্যই হয়েছে।
মালিকপক্ষ ও মিডিয়া কর্মীদের সেন্সরশিপ
বাংলাদেশের সেন্সরশিপের একটা বড় অংশই হলো মালিক ও কর্মীদের স্ব-সেন্সরশিপ আরোপ। যেভাবে কাজ করে এটা:
মিডিয়া মালিকরা সেন্সরশিপের প্রাথমিক অভিভাবক এবং প্রতিটি মিডিয়াতেই এরা রয়েছেন। পুঁজিপতিদের নেটওয়ার্কে যোগাযোগ থাকার কারণেই এই মালিকরা মিডিয়াতে বিনিয়োগ করার সামর্থ্য অর্জন করেন। প্রকৃতপক্ষে, মিডিয়াগুলোকে চালু করা হয় বর্তমান সময়ে নিরাপত্তা দেয়া এবং ভবিষ্যতে প্রবৃদ্ধি অর্জনের জন্য। তাই মালিকরা যদি প্রথম সেন্সর হিসেবে কাজ না করেন, তাহলে তাদের আর্থ-সামাজিক অবস্থান ধ্বংস হয়ে যাবে। তাই মালিকরা এটা নিশ্চিত করার চেষ্টা করেন যাতে যথাযথ জায়গায় যথাযথ ব্যক্তিকে নিয়োগ দেয়া হয় এবং যাতে এমন কোন রিপোর্ট প্রচারিত না হয়, যেটা মালিককে সমস্যায় ফেলতে পারে।
অর্থনৈতিক মুনাফা লাভের জন্য নয়, বরং সামাজিক মর্যাদার জন্যই মিডিয়াতে বিনিয়োগ করেন মালিকরা। এটা সুস্পষ্ট কারণ মিলিয়ন মিলিয়ন বিনিয়োগ করেও এখান থেকে আর্থিক প্রতিদান আশা করেন না তারা। নিজের টিকে থাকার স্বার্থেই সেন্সরশিপ নিশ্চিত করেন তিনি। আর এ ক্ষেত্রে তার নিয়োগ প্রক্রিয়া একটা প্রধান ভূমিকা পালন করে।
সেখান থেকেই আসে সেন্সরশিপ আরোপকারী দ্বিতীয় পক্ষ যারা হলো মিডিয়া কর্মী। এটা এমন নয় যে, ‘অবাধ ও স্বাধীন’ মিডিয়া কর্মীদের দিয়ে জোর করে এটা করানো হচ্ছে। বরং আস্থা বৃদ্ধি ও অর্জনের খাতিরে ইচ্ছা করেই মিডিয়া কর্মীরা এটা করছেন। স্বেচ্ছায় নিজ থেকে সেন্সরের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে এই মিডিয়া কর্মীরা গল্পকে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে উপস্থাপন করছেন যাতে বৈষয়িক অর্জন নিশ্চিত হয়।
এই অর্জন অর্থনৈতিক হতে পারে, তবে রাজনৈতিকও হয়ে থাকে। যেহেতু মিডিয়া কর্মীরা রাজনৈতিক পরিচয়ে বিভাজিত। তাই দলকানা আনুগত্য দিয়ে যে কোন জিনিস অর্জন করা সম্ভব। তারা হয় বিশ্বাস থেকে নয়তো প্রতিশ্রুতি থেকে এটা করে থাকে। প্রায়ই এটা করা হয় যৌথভাবে। কিন্তু পুরো মিডিয়া জুড়ে বিপুল সংখ্যক মিডিয়া কর্মী ছড়ানো না থাকলে রাজনৈতিক স্বার্থ রক্ষা হতে পারে না। তাই একই বর্ণের রাজনৈতিক চিন্তার কর্মীরা একজোট হয়ে কাজ করে।
ভুল ভুক্তভোগী সিনড্রোম
কিন্তু সরকারী দল সেন্সরের ভূমিকায় রয়েছে এবং বাকিরা এর শিকার – এই ধারণাটা ভুল। বিরোধী কর্মীরাও একই মাত্রায় পক্ষপাতদুষ্ট এবং সংবাদ ও যুক্তি বিকৃত করে তারা তাদের নিজস্ব পক্ষপাতমূলক মিডিয়া প্রতিবেদন তৈরি করছে। তাই, সব ধরনের রাজনীতিই নির্ধারণ করে কি ধরনের মিডিয়া প্রতিবেদন তৈরি করা হবে এবং সেগুলো দুটো ভিন্ন পক্ষের পক্ষপাতমূলক সেন্সরশিপ দ্বারাই চালিত হয়।
সেন্সরশিপ জনপ্রিয় কারণ তথ্যভিত্তিক সংবাদ ও মতামত যেগুলো মিডিয়াতে প্রকাশিত হয়, সেগুলো বাংলাদেশে খুবই অজনপ্রিয়। মিডিয়াকে এখানে দেখা হয় রাজনীতির একটা অঙ্গ হিসেবে এবং সাংবাদিকতার গৌরবের অধ্যায় হিসেবে এখনও ১৯৭১-পূর্ববর্তী জাতীয়তাবাদী মিডিয়াকে উদাহরণ হিসেবে উদ্ধৃত করা হয়।
পক্ষপাত যদি দেশাত্মবোধক হয়, তাহলে সেটাকে ইতিবাচক মনে করা হয়। যেহেতু কেউই বলতে পারে না কোনটি দেশাত্মবোধক আর কোনটি ষড়যন্ত্রমূলক, ব্যক্তিকেন্দ্রিক সততার উপরই তাই নির্ভর করতে হয়। সেন্সরশিপের অবস্থাও একই রকম।
আফসান চৌধুরী,
Posted ১১:৪৩ পূর্বাহ্ণ | শুক্রবার, ০৪ মে ২০১৮
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta