কক্সবাংলা ডটকম(২৯ ফেব্রুয়ারী) :: শুধু পর্যটন খাতের দিকে তাকালেই এ কথা সত্য বলে প্রমাণিত হয় যে, বাংলাদেশ হলো সোনার দেশ! একদম মন থেকে, বুকে হাত দিয়ে, গর্ব করে এ কথা বলতে পারি কোনো দ্বিধা ছাড়াই। প্রতিটি সাপ্তাহিক বন্ধ, ছুটি আর অন্যান্য উৎসবে আমাদের পর্যটন স্পটগুলোর দিকে তাকালেই এর সত্যতা পাওয়া যাবে অনেকখানি।
অন্য সবকিছু বাদ দিয়ে শুধু যদি আমাদের দেশের পর্যটন সম্ভাবনার কথা বলি, তাতে করেই সোনার দেশের অমিত সম্ভাবনা দেখতে পাওয়া যায়। কিন্তু পর্যটনের অপার সুযোগও আমরা হেলায় হারিয়ে ফেলছি প্রতিদিন, প্রতিনিয়ত শুধু আমাদের সততা, পরিকল্পিত পরিকল্পনা, দেশপ্রেম আর দূরদর্শিতার অভাবে।
যা আমি আমাদের দেশের পর্যটন স্পটসহ আনাচে-কানাচে আর ভারতের ২২টির বেশি প্রদেশ এবং সেসব প্রদেশের নানা জায়গায় ঘুরে ঘুরে দেখেছি, অভিজ্ঞতা পেয়েছি, অনুভব করেছি এবং মনে মনে আমাদের দেশের পর্যটন ব্যবস্থাপনার সঙ্গে তুলনা করে আফসোস করেছি।
চলুন একটু ভিন্ন দৃষ্টি দিয়ে আর অন্যভাবে শুধু পর্যটন খাতকে বিবেচনায় নিয়ে দেখি কীভাবে সত্যি সত্যি আমাদের দেশ অপার সম্ভাবনাময়, সোনার দেশ কিন্তু সেই অপার সম্ভাবনাময় সোনার খনিকে আমরা কোনো কাজেই লাগাতে না পেরে দিন দিন পিছিয়ে পড়ছি।
সংখ্যার তথ্য বা বিশ্লেষণ বাদ দিয়ে শুধু আপাতদৃষ্টিতে যদি দেখি, তাহলেই বুঝতে পারব আর স্বীকার করতে বাধ্য হব যে, পর্যটন সত্যি আমাদের দেশের জন্য অপার সম্ভাবনাময় একটি খাত। যে খাতের সঠিক, সর্বোচ্চ আর পরিকল্পিতভাবে ব্যবহার করতে পারলেই এ থেকে বৈদেশিক মুদ্রা আয়সহ নিজের দেশের বিপুল অর্থ দেশেই ব্যয় করার মতো সুযোগ তৈরি করতে পারতাম, যা দিয়ে কর্মসংস্থান বাড়ানোর পাশাপাশি অন্যান্য আর্থিক উন্নয়নেও ভূমিকা রাখা যেত। সেই সুযোগ, সম্ভাবনা, সাধ্য আমাদের আছে। যা নেই, সেটা হলো মানসিকতা, সততা, দেশপ্রেম আর দেশের প্রতি সত্যিকারের মমতা বা ভালোবাসা।
চলুন ছোট একটা উদাহরণ দেয়া যাক। তাও শুধু আমার নানা রকম ভ্রমণের অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে।
আমি আমার পরিবার নিয়ে গত তিন বছরে বেশ কয়েকবার চেষ্টা করেছি কক্সবাজার আর সেন্ট মার্টিন গিয়ে কয়েকটা দিন চুপচাপ উপভোগ করে আসার। কিন্তু প্রতিবার টাকার হিসাব করতে গিয়ে পিছিয়ে এসেছি। কারণ সবচেয়ে কম খরচের হিসাব করেও মাত্র তিনদিনের জন্য আমাদের তিনজনের ছোট্ট পরিবারের মোটামুটি মানের খরচও ৩০ হাজারের নিচে নামাতে পারিনি। ভাবা যায়?
ঢাকা থেকে কক্সবাজারের এসি বাসের টিকিট ১ হাজার ৮০০ থেকে ২ হাজার টাকা। তার মানে শুধু মূল যে জার্নি, তাতেই তিনজনের খরচ হয়ে যাবে ১২ হাজার টাকা। দুই থেকে তিন রাত যদি হোটেলে থাকতে হয়, দিনপ্রতি ২ হাজার ৫০০ থেকে ৩ হাজার টাকার নিচে কোনো রুম পাওয়া যায় না, একটু মানসম্মত চাইলেই। তার মানে তিন রাতের হোটেল খরচেই চলে যাবে ৮ হাজার থেকে ৯ হাজার টাকা! অর্থাৎ ২০ হাজার টাকা দুই খাতেই শেষ হয়ে যাচ্ছে। এরপর রয়েছে খাওয়া, যেটা জনপ্রতি প্রতিদিন ১ হাজার টাকার নিচে হয়ে ওঠে না। পাশাপাশি অন্যান্য ট্রান্সপোর্ট আর খুচরো খরচ তো আছেই।
সবকিছু মিলিয়ে ৩০ হাজার টাকাতেও হয়ে ওঠে না বা হলেও খুবই হিসাব করে টানাটানি করে চলতে হবে পুরো ট্যুরে। ঠিক সে সময়ই চলে আসে আমাদের পাশের দেশ ভারত ভ্রমণের তুলনা। আর তখনই কক্সবাজারের পরিবর্তে চলে গেছি হয় দার্জিলিং, মেঘালয়, নয় কলকাতা অথবা আরো একটু দূরের দিল্লি কিংবা আগ্রা। সেই ৩০ হাজার টাকাতেই তিনজনের দিব্যি ঘোরা হয়ে গেছে ভারতের এসব দর্শনীয় জায়গার কোনো একটা।
এতে কি হলো? যে টাকাটা আমি দেশে খরচ করতে চেয়েছিলাম, যে টাকাটা আমার দেশেই পুনর্বিনিয়োগের সম্ভাবনা জেগেছিল, সে টাকাটাই অন্য দেশে চলে গিয়ে সেই দেশের জিডিপিতে যোগ হলো, সেই দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে অল্প হলেও অবদান রাখল। এটা একটা আমার মতো খুবই সাধারণ একজনের উদাহরণ মাত্র। আমার পরিচিত ট্র্যাভেল কমিউনিটিতে এমন অন্তত কয়েকশ মানুষকে পাওয়া যাবে, যারা শুধু এই খরচের তুলনা করেই দেশে না বেরিয়ে বিদেশে বেড়াতে যায় সময় আর সুযোগ পেলেই। আর এর সঙ্গে তো যুক্ত আছেই নানা রকম হয়রানি, নিরাপত্তার অভাব, মেয়েদের নিয়ে বেড়াতে যাওয়ার নানা রকম ঝুঁকি।
ঠিক এসব কারণেই দেশের মানুষের ভ্রমণের ইচ্ছা ও সম্ভাবনা কমে যাওয়ার পাশাপাশি বিদেশীদের এ দেশে বেড়াতে আসার হার আশঙ্কাজনক হারে কমে গেছে। যেটা পর্যটন অধিদপ্তরের বিদেশীদের যাওয়া-আসার সাম্প্রতিক তথ্য বিশ্লেষণ করলেই দেখা যাবে।
তার মানে কী দাঁড়াল? শুধু অতিরিক্ত যানবাহন, হোটেল আর খাওয়ার খরচের পাশাপাশি নিরাপত্তা ও নানা রকম ঝুঁকির কথা বিবেচনা করে দেশের পাশাপাশি বিদেশী পর্যটকরাও আমাদের দেশ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। যার অর্থ হলো, বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সম্ভাবনা তো মুখ থুবড়ে পড়লই, পাশাপাশি দেশীয় মুদ্রা পুনর্বিনিয়োগের বদলে অন্য কোনো দেশে চলে গিয়ে অর্থনীতির চাকা মন্থর করে দিচ্ছে!
তাহলে এবার আপনিই বলুন, আমাদের পর্যটন এগোল না পেছাল? আমাদের পর্যটনের যে সম্ভাবনা ছিল, সেটা জোয়ারের পানিতে সামনে এল নাকি ভাটার টানে পিছিয়ে গেল? আমাদের সামগ্রিক অর্থনীতির চাকা কীভাবে মন্থর হয়ে গেল? আমাদের প্রবৃদ্ধি কীভাবে থেমে গেল বা আরো যেটা বাড়তে পারত, সেটা হলো না!
এ অবস্থা শুধু কক্সবাজারের যে খরচের উদাহরণ দেয়া হলো সেখানেই নয়, একই চিত্রের দেখা মেলে আমাদের দেশের পর্যটনের প্রায় প্রতিটি উল্লেখযোগ্য জায়গাতেই। সিলেট হোক বা সুন্দরবন, বান্দরবান হোক বা রাঙ্গামাটি। খরচের এত এত অপ্রাসঙ্গিক অবস্থার কারণেই আমরা দেশের চেয়ে বিদেশে ঘুরতে যেতেই বেশি পছন্দ করি।
আমি ভেবে পাই না, ঢাকা থেকে কক্সবাজার মাত্র ৪০০ কিলোমিটার পথের ভাড়া কেন ২ হাজার টাকা হবে? ভারতে বা অন্য দেশে যে দূরত্বের ভাড়া খুব বেশি হলে ১ হাজার ২০০ টাকা। আমাদের কক্সবাজারে যে মানের হোটেলের ভাড়া ৩ হাজার টাকা, সেই একই মানের হোটেল ভারতে বা অন্য দেশেও পাওয়া যায় ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকায়। আমাদের দেশে যেখানে ১ হাজার টাকার কমে একদিন খাওয়া যায় না, সেখানে অন্য দেশে ৫০০-৬০০ টাকায় সারা দিন বেশ ভালোভাবে খাওয়া যায়।
কিন্তু কেন? এ খরচটা কম হতে পারে না? হওয়া উচিত ছিল না? যার কৈফিয়ত দেয়ার কেউ নেই, দেবেও না। যে কারণে দিন দিন দেশের অপার সম্ভাবনাময় পর্যটন খাত আর এ খাত থেকে আয় হতে পারা দেশী-বিদেশী মুদ্রা আমরা হারিয়ে ফেলছি ভীষণ অবহেলায়, অসততা আর আমাদের যেকোনোভাবে অর্থ উপার্জনের মনোভাবের কারণে।
যে কারণে আমাদের পর্যটন খাত, এর সম্ভাবনা আর এখান থেকে অর্জনের সুযোগ প্রতিদিন আমরা হারিয়ে ফেলছি। নিজেদের অদূরভবিষ্যতের ক্ষতি নিজেরাই করছি। এভাবেই সম্ভাবনাময় পর্যটন থেকে আমরা এগিয়ে যাওয়ার পরিবর্তে প্রতিদিন পিছিয়ে যাচ্ছি।
Posted ১১:৩১ পূর্বাহ্ণ | রবিবার, ০১ মার্চ ২০২০
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta