কক্সবাংলা ডটকম(১১ মার্চ) :: মধ্যবিত্তের আরেকটি ভরসার জায়গা কমল। অনেক মধ্যবিত্ত সঞ্চয়পত্রের পাশাপাশি ব্যাংকে স্থায়ী আমানত বা এফডিআর করে মুনাফার টাকায় দৈনন্দিন খরচ চালান। আমানতে সুদের হার ৬ শতাংশে নামিয়ে আনায় এই মধ্যবিত্তরা বিপাকে পড়বেন।
নতুন সুদের হারে বছর শেষে টাকার অঙ্কে হয়তো লাভ হবে। সেই লাভের টাকা মূল্যস্ফীতি খেয়ে ফেলবে। ফলে তাঁরা ব্যাংকে টাকা রাখার বদলে সঞ্চয়পত্রে যেতে পারেন। যদিও তাঁরা সঞ্চয়পত্রে আগের মতো উৎসাহ দেখাচ্ছেন না। কেউ কেউ জমি, বাড়ি কেনার মতো অনুৎপাদনশীল খাতেও বিনিয়োগ করতে পারেন। অন্য বিকল্প এখন ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগ। বেশি মুনাফার আশায় কেউ কেউ স্থানীয় সমবায় সমিতি কিংবা এমএলএম ব্যবসার খপ্পরে পড়তে পারেন। ইতিমধ্যে এই প্রবণতা দেখাও দিয়েছে। আর অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, এই পথে সাদা টাকা কালো হয়ে যাবে।
সরকার ব্যাংক সুদের হারে ‘নয়-ছয়’ পদ্ধতি অনুসরণ করছে। আগামী এপ্রিল থেকে ঋণের ওপর সুদের হার ৯ শতাংশ পর্যন্ত বেঁধে দেওয়া হয়েছে। আর ফেব্রুয়ারি মাস থেকে আমানতের ওপর সুদ ৬ শতাংশ নির্ধারণ করেছে ব্যাংকগুলো।
ব্যাংক আমানতে কত লাভ
স্থায়ী আমানত (এফডিআর) করলে আসলে মুনাফা কত হবে—এর উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। ধরুন, আপনার কাছে ১ লাখ টাকা আছে। আপনি ব্যাংকে এক বছরের জন্য রাখলে ৬ শতাংশ সুদ পাবেন। এক বছর পর আপনার হিসাবে ৬ হাজার টাকা যোগ হয়ে ১ লাখ ৬ হাজার টাকা থাকবে। কিন্তু আপনি এই টাকা পুরোটা হাতে পাবেন না।
প্রথমেই আপনার সুদের টাকার ওপর ১০ শতাংশ উৎসে কর কেটে রাখা হবে। শর্ত হলো, কর শনাক্তকরণ নম্বর (টিআইএন) থাকতে হবে। টিআইএন না থাকলে ১৫ শতাংশ উৎসে কর বসবে। টিআইএন থাকলে আপনার কাছ থেকে উৎসে কর হিসেবে ৬০০ টাকা কেটে রাখা হবে। তখন আপনার টাকা কমে হয়ে যাবে ১ লাখ ৫ হাজার ৪০০ টাকা। এখানেই শেষ নয়, আপনার স্থায়ী আমানত হিসাবে সুদের ৬ হাজার টাকা যুক্ত হওয়ার কারণে আপনার হিসাব থেকে আবগারি শুল্কও কেটে রাখা হবে। কোনো ব্যাংক হিসাবে বছরের যেকোনো সময়ে একবার টাকার অঙ্ক ১ লাখ টাকা পেরোলেই আবগারি শুল্ক ১৫০ টাকা কাটবে। আপনি হাতে পাবেন আসল ও সুদসহ ১ লাখ ৫ হাজার ২৫০ টাকা। ব্যাংকে ১ লাখ টাকা রেখে এক বছরে এই হলো আপনার লাভ।
লাভের টাকা খাবে মূল্যস্ফীতি
এক বছর পর ১ লাখ টাকার এফডিআর ভাঙানোর পর হাতে যে লাভ পাবেন, সেটিও মূল্যস্ফীতি খেয়ে ফেলবে। মূল্যস্ফীতির কারণে আপনার ক্রয়ক্ষমতা কমে যাবে।
চলতি অর্থবছরে মূল্যস্ফীতির লক্ষ্য সাড়ে ৫ শতাংশ। গত জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত অর্থাৎ গত এক বছরে গড় মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৫ দশমিক ৫৯ শতাংশ। আগামী এক বছরে যদি গড়ে সাড়ে ৫ শতাংশ মূল্যস্ফীতি হয়, তবে আপনার ব্যাংকে টাকা রেখে লাভবান হওয়ার সুযোগ কম।
বেশি মুনাফার আশায় স্থানীয় সমবায় সমিতি, এমএলএম প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগে উৎসাহ পাবেন ক্ষুদ্র সঞ্চয়কারীরা।
মূল্যস্ফীতির কারণে জীবনযাত্রার খরচ বাড়ে। এখন আপনি ১ লাখ টাকা দিয়ে গড়ে যেসব পণ্য ও সেবা কিনতে পারেন, মূল্যস্ফীতির বর্তমান ধারা বজায় থাকলে এক বছর পরে ওই পণ্য ও সেবা কিনতে ১ লাখ ৫ হাজার ৫০০ টাকা লাগবে। কিন্তু ব্যাংকে রাখলে বছর শেষে ওই পরিমাণ টাকা পাবেন না।
এ বছর আবার মূল্যস্ফীতির চাপ বৃদ্ধির দুটি উপলক্ষ তৈরি হয়ে গেছে। বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর কারণে মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির শঙ্কা আছে। আবার করোনাভাইরাসের কারণে বাজারে বহু পণ্যের দাম বেড়ে যাচ্ছে।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর এই বিষয়ে বলেন, ‘মধ্যবিত্তরা এখন আর লাভের আশায় ব্যাংকে এফডিআর করবেন না। নিরাপত্তার কারণে হয়তো ব্যাংকে টাকা রাখবেন। ব্যাংকের বাইরে তাঁদের প্রথম পছন্দের জায়গা হবে সঞ্চয়পত্র। এ ছাড়া বেশি লাভের আশায় অনেক মধ্যবিত্ত স্থানীয় সমবায় সমিতির মতো ঝুঁকিপূর্ণ খাতে বিনিয়োগে উৎসাহিত হবেন। কেউ কেউ জমি, বাড়ির মতো অনুৎপাদনশীল খাতেও টাকা খরচ করে ফেলবেন। আবার অনেকেই বছরজুড়ে ভোগেও উৎসাহিত হতে পারেন।’ তবে তিনি মনে করেন, শেয়ারবাজারের বর্তমান সংকটে মধ্যবিত্তরা সেখানে উৎসাহিত হবেন না।
স্থায়ী আমানত ছাড়াও ব্যাংকে সঞ্চয়ী হিসাবে টাকা রাখার সুযোগ আছে। সঞ্চয়ী হিসাবে সাধারণত দৈনন্দিন লেনদেন করা হয়। এই হিসাবে সুদের হার বড়জোর ৪-৫ শতাংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ। সঞ্চয়ী হিসাবে টাকা রাখলে আরও লোকসানে পড়তে হবে। সুদের টাকার সঙ্গে মূল্যস্ফীতি সমন্বয়, আবগারি শুল্ক, হিসাবের বিপরীতে সেবা মাশুল কেটে রাখলে আসলের কিছু অংশ উধাও হয়ে যেতে পারে।
ব্যাংকের এমডিদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সভাপতি আলী রেজা ইফতেখার বলেন, আমানতের সুদের হার কমানোর ফলে মধ্যবিত্তদের একটু কষ্ট হবে। তবে আমানতে সুদ নির্দিষ্ট করার বিষয়ে এখনো কোনো নির্দেশনা আসেনি। তাই ব্যাংকগুলো চাইলে এই হার হ্রাস-বৃদ্ধি করতে পারে।
তাহলে বিকল্প কী
এবার দেখা যাক, ব্যাংকের বিকল্প কী। সঞ্চয়পত্র প্রধান বিকল্প। এই সঞ্চয়পত্র এখন সাধারণ মানুষের উৎসাহ ও আস্থা হারাতে চলেছে। বিভিন্ন ধরনের সঞ্চয়পত্র মুনাফার হার ১১ শতাংশের বেশি। ব্যাংক থেকে মুখ ফিরিয়ে অনেকেই এখন সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগে উৎসাহিত হবেন, সেই জো নেই। তবে সেখানেও বিপত্তি। ইতিমধ্যে সঞ্চয়পত্রের গড় সুদের হার কমিয়ে আনার ঘোষণা দিয়েছে সরকার। ফলে সীমিত আয়ের মানুষ ও মধ্যবিত্তরা অনেকেই সঞ্চয়পত্র কেনায় উৎসাহ হারিয়ে ফেলবেন। দুঃসময়ের সঙ্গী এই নিরাপদ বিনিয়োগ খাতটি থাকছে না। সুদের হার কমানোর ঘোষণাসহ নানা ধরনের বিধিনিষেধের কারণে ইতিমধ্যে সঞ্চয়পত্র কেনা ব্যাপক হারে কমে গেছে। গত জুলাই-ডিসেম্বর মাসে সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রি হয়েছে মাত্র ৫ হাজার ৪৩৩ কোটি টাকা। আগের বছরের ছয় মাসে এর পরিমাণ ছিল ২৪ হাজার ৯৯৩ কোটি টাকা।
গত মাসে ডাকঘর সঞ্চয় স্কিমে এখন সুদের হার কমানো হয়েছে। সাধারণ স্কিমে সাড়ে ৭ থেকে ৫ শতাংশ এবং তিন বছর মেয়াদের ক্ষেত্রে ১১ দশমিক ২৮ থেকে ৬ শতাংশ করা হয়েছে। সম্প্রতি অর্থমন্ত্রী এই সুদের পুনর্বিবেচনার ঘোষণা দিয়েছেন।
আর থাকল শেয়ারবাজার। তবে এ বাজারের প্রতি ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের আস্থার সংকট আছে।
সর্বশেষ বিকল্পটি বেশ ঝুঁকিপূর্ণ ও বেআইনি। ক্ষুদ্র সঞ্চয়কারীদের সামনে স্থানীয় পর্যায়ে গড়ে ওঠা সমবায় সমিতি, বহুস্তর বিপণন কোম্পানিতে (এমএলএম) বিনিয়োগের প্রলোভন আসবে। ফাঁদে পড়তে পারেন তাঁরা। এ নিয়ে সরকার এরই মধ্যে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তিও ছেপেছে।
অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন এ নিয়ে বলেন, সঞ্চয়পত্রে সুদের হার কমানোর ঘোষণায় মধ্যবিত্তরা ইতিমধ্যে উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছেন। শেয়ারবাজারের প্রতি ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের আস্থা কম। এই সুযোগে স্থানীয় পর্যায়ে গড়ে ওঠা সমবায় সমিতিগুলো এখন উচ্চ মুনাফার প্রলোভন দেখাবে। এমএলএম কোম্পানি গড়ে উঠবে। বেশি মুনাফার আশায় ক্ষুদ্র সঞ্চয়কারীরা এসব প্রতিষ্ঠানে ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগে উৎসাহিত হবেন। অতীতে এমন কিছু প্রতিষ্ঠান গরিব মানুষের কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে উধাও হয়ে গেছে।
Posted ১১:৫৯ পূর্বাহ্ণ | বুধবার, ১১ মার্চ ২০২০
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta