কক্সবাংলা ডটকম(৫ এপ্রিল) :: গত ২৭ মার্চ বিশ্বের চতুর্থ দেশ হিসাবে ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে মহাকাশে ভাসমান একটি উপগ্রহ ধ্বংস করে ভারত। A-SAT ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে পৃথিবীপৃষ্ঠ থেকে ৩০০ কিলোমিটার উঁচুতে কক্ষে থাকা কৃত্রিম উপগ্রহটিকে ধ্বংস করেন DRDO-র বিজ্ঞানীরা। এর আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও চিনের হাতে এই ক্ষমতা ছিল। এবার সেই ক্ষমতা এল ভারতের হাতেও। কিন্তু পরীক্ষার পর থেকেই ভারতীয় বিজ্ঞানীদের কাণ্ডজ্ঞান নিয়ে প্রশ্ন তুলতে শুরু করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-সহ পশ্চিমি বিশ্বের একাংশ। আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়, ভারতের পরীক্ষার ফলে মহাকাশে উপগ্রহের যে টুকরোগুলি তৈরি হয়েছে তা ভবিষ্যতে মহাকাশ অভিযানকে আরও ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলবে।কিন্তু DRDO থেকে বলা হয়, ভারত পৃথিবীর খুব কাছাকাছি কক্ষে ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা করেছে। তাছাড়া এই সংঘর্ষের ফলে যে টুকরোগুলি তৈরি হয়েছে তার ভরবেগ এতই কম যে সেগুলি ৪৫ দিনের মধ্যে পৃথিবীর অভিকর্ষের ফলে বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করে ধ্বংস হয়ে যাবে।
শেষ পযন্ত ভারতের উপগ্রহ বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষা নিয়ে DRDO-র বক্তব্য মেনে নিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। নিজেদের মহাকাশ সংস্থা NASA-র বক্তব্যকে খারিজ করে পেন্টাগনের তরফে জানানো হয়েছে, ধ্বংস হওয়া উপগ্রহটির টুকরোগুলো কয়েকদিনের মধ্যেই আবহমণ্ডলে ঢুকে ধ্বংস হয়ে যাবে। এই টুকরোগুলির ফলে মহাকাশে কোনও বাড়তি ঝুঁকি তৈরি হবে না।
এর পরও খবরের জন্য মহাকাশ ৪৮ ঘন্টা বেশ গরম ছিল। ট্রাম্প প্রশাসন সিদ্ধান্ত নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র আবার চাঁদে যাবে। ২০২৪ সালের মধ্যে আমেরিকান নভোচারীরা চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে অবতরণ করবে। ট্রাম্প প্রশাসনের এ সিদ্ধান্তে খোদ নাসাসহ অনেককেই অবাক করেছে। বিতর্কও শুরু হয়েছে সিদ্ধান্ত নিয়ে। এই সময়ের মধ্যে সেটা সম্ভব কি না, এ জন্য নাসার যে প্রস্তুতি দরকার সেটার কারণে নাসার নিয়মিত কর্মকাণ্ড বাধাগ্রস্ত হবে কি না এবং স্পেস লঞ্চ সিস্টেম রকেট তৈরির জন্য যে বিশাল বাজেট দরকার, কংগ্রেস সেটা অনুমোদন দেবে কি না – এসব নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে। এমনভাবে সময়টা নির্ধারণ করা হয়েছে, যেটা হবে ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদের শেষ সময়, যদি তিনি দ্বিতীয়বারের মতো নির্বাচিত হন। আর এর উদ্দেশ্যটা ব্যাখ্যা করেছেন ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স – চীনের বিরুদ্ধে নতুন মহাকাশ প্রতিযোগিতার অংশ হিসেবে এই অভিযান চালানো হবে। মহাকাশ গবেষকদের জন্য বিষয়টা উত্তেজনাকর।
কিন্তু আরও নাটকীয় সংবাদ শোনা গেলো বুধবার সন্ধ্যায়। ভারত নিম্ন কক্ষপথে তাদের প্রথম স্যাটেলাইট-বিধ্বংসী অস্ত্রের পরীক্ষা চালিয়েছে। ভারতের অর্জনের প্রমাণ হিসেবে পরিচালিত এই ‘মিশন শক্তি’তে এএসএটিবাহী মিসাইল দিয়ে ৭৪০ কেজি ওজনের একটি মাইক্রোস্যাটেলাইট ধ্বংস করা হয়েছে। মিশন পরিচালনা করেছে ভারতের মহাকাশ সক্ষমতা নিয়ে কাজ করে যে প্রতিষ্ঠান – সেই ইন্ডিয়ান ডিফেন্স রিসার্চ অ্যান্ড ডেভলপমেন্ট অর্গানাইজেশান। যে স্যাটেলাইটটিকে ধ্বংস করা হয়েছে, সেটা ‘মাইক্রোস্যাট আর’ নামে পরিচিত একটি ‘লাইভ’ স্যাটেলাইট।
নিম্ন কক্ষপথ বা ৩০০ কিলোমিটার উচ্চতার অর্থ হলো মাইক্রোস্যাট আর ধ্বংসের অধিকাংশ ধ্বংসাবশেষ বায়ুমন্ডলে প্রবেশ করে দ্রুত পুড়ে নিঃশেষ হয়ে যাবে। সে বিবেচনায় ভারতের পরীক্ষাটা বেইজিং ২০০৭ সালে যে পরীক্ষা করেছিল তার থেকে কিছুটা আলাদা। বেইজিং ওই পরীক্ষাটা চালিয়েছিল ৮০০ কিলোমিটার উচ্চতায়, যেটার ধ্বংসাবশেষ এখনও কক্ষপথে রয়ে গেছে।
ভারতের পরীক্ষাটা ২০০৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের পরিচালিত বার্ন্ট ফ্রস্ট পরীক্ষার কাছাকাছি। সে সময় মার্কিন নৌবাহিনীর একটি জাহাজ থেকে এসএম-৩ মিসাইল ছুড়ে ২৮০ কিলোমিটার উচ্চতায় থাকা একটি অকার্যকর স্যাটালাইটকে ধ্বংস করা হয়েছিল। নিম্ন কক্ষপথে পরীক্ষার উদ্দেশ্য ছিল যাতে বিস্ফোরণের ধ্বংসাবশেষ ছড়িয়ে না পড়ে।
ভারতের এএসএটি পরীক্ষার উদ্দেশ্য হলো মহাকাশ সক্ষমতায় চীনের বিরুদ্ধে নয়াদিল্লীর সক্ষমতা প্রদর্শন – অন্তত নিম্ন কক্ষপথে হলেও এই সক্ষমতা দেখানো। ব্রায়ান উইডেন এবং ভিক্টোরিয়া স্যাম্পসন তাদের ২০১৮ সালের বৈশ্বিক মহাকাশ পর্যালোচনায় বলেছেন যে, চীন নিশ্চিতভাবে মার্কিন স্যাটেলাইট ধ্বংসের জন্য এএসএটি শ্রেণীর মিসাইল মোতায়েন করেছিল।
এই অস্ত্রগুলো সহজেই ভারতের বিরুদ্ধেও ব্যবহৃত হতে পারে। যে কোন সঙ্কটের সময় সেটা ব্যবহার করে চীন ভারতের সামরিক বাহিনীর মহাকাশ সক্ষমতা কমিয়ে দিতে পারবে। এটা কমান্ড অ্যান্ড কন্ট্রোলের কার্যকারিতা নষ্ট করে দেবে এবং মহাকাশ-ভিত্তিক গোয়েন্দা নজরদারী ব্যবস্থাকে নষ্ট করে দেবে, ফলে ভারতীয় বাহিনী কার্যত বোবা, কালা ও অন্ধ হয়ে যাবে। ভারতের এএসএটি সক্ষমতা না থাকলে চীনের আসলে ভারতকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই।
তাই এটা ধরে নেয়া যায় যে, চীনের বিরুদ্ধে মহাকাশ প্রতিরোধ গড়ে তুলতেই এই পরীক্ষা চালিয়েছে ভারত। হয়তো পাকিস্তানের বিষয়টিও মাথায় রয়েছে তাদের (যদিও পাকিস্তান মহাকাশ গবেষণায় ভারতের থেকে অনেক দূরে অবস্থান করছে)। এই পরীক্ষা ব্যালিস্টিক মিসাইল গড়ার ক্ষেত্রেও ভারতকে সহায়তা করবে। স্যাটেলাইট বিধ্বংসী এএসএটি পরীক্ষার মাধ্যমে যে সক্ষমতা প্রদর্শিত হলো, সেটা দিয়ে দূরপাল্লার মিসাইলকেও ঠেকানো সম্ভব। এটা পাকিস্তানের জন্য একটা বার্তা হতে পারে কারণ পাকিস্তানের শাহীন-টু এবং শাহীন-থ্রি মাঝারি পাল্লার ব্যালিস্টিক মিসাইল রয়েছে। আর চীন তো রয়েছেই, যাদের কাছে ভারতের যে কোন জায়গায় আঘাত হানার মতো মিসাইল রয়েছে।
এএসএটি পরীক্ষার দরজা হয়তো শিগগিরই বন্ধ হয়ে যাবে। দীর্ঘদিন ধরে মহাকাশ অস্ত্র নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চলে আসছে এবং মহাকাশ অস্ত্রের ব্যাপারে নীতিমালা আসতে পারে। বর্তমানে যে সব আইন রয়েছে, সেখানে এএসএটি পরীক্ষার ব্যাপারে কোন বিধিনিষেধ নেই। কিন্তু চীন ও রাশিয়া জাতিসংঘে একটা খসড়া উপস্থাপন করতে যাচ্ছে যেখানে মহাকাশে অস্ত্র মোতায়েন নিষিদ্ধ করা হবে। একই সাথে মহাকাশে অস্ত্র প্রতিযোগিতা বন্ধের বিষয়টি থাকছে ওই প্রস্তাবে। যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য দেশ এই ধারণাকে অবশ্য বাতিল করে দিয়েছে কারণ এ প্রস্তাব যাচাই বাছাইয়ের সুযোগ নেই এবং এর মাধ্যমে চীন ও রাশিয়ার সরাসরি নিক্ষিপ্ত এএসএটিগুলো অক্ষত থাকবে। ভবিষ্যতে যদি এ ধরনের কোন চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে হয়, সেই চিন্তা থেকেই ভারত আগাম এই পরীক্ষা করে রাখলো, যাতে সক্ষমতার জায়গায় তারা পিছিয়ে না পড়ে।
ভারতের দিক থেকে এএসএটি পরীক্ষা একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্জন যেটা জাতীয় সম্মান বাড়াবে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যেভাবে এই পরীক্ষার বিষয়টি প্রকাশ করেছেন, সেখানে ভারতের গর্বের বিষয়টি প্রকাশ পেয়েছে: ‘মিশন শক্তির অধীনে পরীক্ষা চালানোর মাধ্যমে আমরা স্পেস সুপার লিগে প্রবেশ করেছি’।
ভারতে সাধারণ নির্বাচনের আগ দিয়ে মোদি তার প্রতিরক্ষা ও জাতীয় নিরাপত্তার অর্জনগুলো প্রচারে নেমেছেন। বিশেষ করে পুলওয়ামা হামলার পর পাকিস্তানের বিরুদ্ধে অভিযান চালানোর প্রেক্ষিতে এই প্রচারণা আরও জোরদার হয়েছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে এএসএটি পরীক্ষা শুধু অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক এজেন্ডা হিসেবেই নয়, সেই সাথে বিশ্বব্যাপী ভারতের মর্যাদার প্রতীক হিসেবেও ব্যবহার করা হচ্ছে।
বলে রাখা ভাল- গোপন তথ্য সংগ্রহের জন্য চর উপগ্রহ ব্যবহার করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ। চর উপগ্রহের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় সামরিক ও অসামরিক তথ্য সংগ্রহ করেন গোয়েন্দারা। A-SAT-এর সফল পরীক্ষার পর তেমন কোনও সন্দেহজনক উপগ্রহ ধ্বংস করতে পারবে ভারত।
আর ভারতের এএসএটি পরীক্ষাকে কারণ হিসেবে দেখিয়ে চীন কি তাদের এএসএটি কর্মসূচি বাড়াবে? ভারত তখন কিভাবে জবাব দেবে? চীনের এএসএটি কর্মসূচি বাড়লে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়া কি হবে? এশিয়া থেকে মহাকাশ প্রতিযোগিতার সূত্রপাতের আশঙ্কাকে উড়িয়ে দেয়া যাচ্ছে না।
Posted ৪:০৬ অপরাহ্ণ | শুক্রবার, ০৫ এপ্রিল ২০১৯
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta