কক্সবাংলা ডটকম(১২ ডিসেম্বর) :: ভারতের পশ্চিমাঞ্চলের আজি, আমবিকা ও বানাস নদীর তীরবর্তী শহর ও সেখানকার রাজ্যে প্রথম দফায় শেষ হয়েছে বিধানসভা নির্বাচন। মুখোমুখি ঐতিহ্যবাহী প্রধান দুই রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টি বা বিজেপি এবং ভারতীয় ন্যাশনাল কংগ্রেস বা কংগ্রেস। মুখ্যমন্ত্রীর পদে বসতে ও ক্ষমতার মসনদের দখল নিতে প্রায় মরিয়া হয়ে উঠেছে দুপক্ষই।
উপমহাদেশে রাজনীতির প্রতি পদে পদে পক্ষে ও বিপক্ষে যেখানে আঘাত করেছে ধর্মীয় অনুভূতি, জাত প্রথা, জনগণের মনস্তাত্ত্বিক ও গোষ্ঠীগত আবেগ; সেখানে শিল্পমাধ্যমের সাথে রাজনীতিবিদদের ক্ষমতার লড়াইয়ের বিরোধ ঐতিহাসিক। নিজেদের স্বার্থ হাসিলে প্রায়ই শিল্প মাধ্যমের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছেন শাসকগোষ্ঠীর নেতারা। এই নিমর্মতার সর্বশেষ বলি পরিচালক সঞ্জল লীলা বানসালির চলচ্চিত্র ‘পদ্মাবতী’।
ছবিটির বিরুদ্ধে ইতিহাস বিকৃতি ও রাজপুতদের বিশ্বাসের অনুভূতিতে আঘাত হানার মতো গুরুত্বপূর্ণ অভিযোগ দায়ের করছেন রাজনীতিবিদরা। বিজেপির পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, গুজরাটের বিধান সভার নির্বাচনের আগে এই ছবি মুক্তি দিলে ভোটারদের অনুভূতিতে বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি হতো এবং পরিচালক বানসালী, ছবিতে দিল্লির শাসক সুলতান আলাউদ্দিনের সাথে চিতোরের রাণী পদ্মাবতীর সাক্ষাৎ হয়েছে, এমন একটি দৃশ্য দেখিয়েছেন যা ইতিহাস বিরুদ্ধ বলে গণ্য ভারতের রাজপুত সমাজে।
রাজপুতরা নিজেদের বিশ্বাসকে আরো পুঁজি করে বলছেন, ছবিতে দিল্লির শাসকের সাথে রাণী পদ্মাবতীর বিকৃত কামনা চরিতার্থ করার একটি স্বপ্নময় আবেগঘন দৃশ্যের অবতারণা করেছেন পরিচালক বানসালী, যার মাধ্যমে রাজপুত সমাজে ‘বিজেতাদের কাছে সম্ভ্রম দেয়ার চেয়ে মৃত্যুই শ্রেয় বলে প্রায় ১৬ হাজার নারীকে নিয়ে অগ্নিকুণ্ডে ঝাঁপ দিয়ে জওহরব্রত পালন করা’ রাণী পদ্মাবতীর সম্মানহানি হয়েছে।
গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, বরাবরই রাজনীতিবিদ ও রাজপুত সমাজের প্রতিনিধিত্বকারী করনী সেনা ও রাজপুত সাবহাদের এসব অভিযোগকে অস্বীকার ও খণ্ডন করে আসছেন পরিচালক সঞ্জয় লীলা বানসালি এবং সংশ্লিষ্টরা। তবে অভিযোগ অস্বীকার ও পাল্টা যুক্তির বিষয়টি যথেষ্ট নয় বলেই পদ্মাবতীর মুক্তির দিনক্ষণের জট গলেনি এবং ছবি মুক্তির তারিখ বেশ খানিকটা পিছিয়ে দিয়ে আপাতদৃষ্টিতে জয়ী হয়েছেন রাজনীতিবিদরা।
ভারতের গুজরাটের বিধানসভা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা কংগ্রেসের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, ‘পদ্মাবতী’ চলচ্চিত্রটির বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে ইতিহাস বিকৃতির। এখানে পদ্মাবতী ছবি মুক্তির দিন তারিখ পিছিয়ে দেয়ার মাধ্যমেই কেবল রাজপুতদের ক্ষোভ প্রশমন করা সম্ভব নয় এবং ছবিটিতে ইতিহাসের বিকৃতি সত্যিই ঘটলে সেটি বাজেয়াপ্ত করাও প্রয়োজন। টুকে রাখার মতো বিষয় হলো, পদ্মাবতী মুক্তির মাত্র ৭ দিন পরে ভারতে বিধানসভার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ায় ঘড়ির কাঁটার মতো ঝুলে গেছে পদ্মাবতীর ভবিষ্যত ও ছবি মুক্তির দিনক্ষণ, নইলে ভিন্ন হতো ইতিহাস।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, রাজস্থানে রাজপুতদের প্রভাবের তুলনায় গুজরাটে রাজপুতের বসতি ও প্রভাব কম থাকলেও, কেবল মাত্র রাজপুত জাতিগোষ্ঠীর অনুভূতি ও আবেগকে পুঁজি করে গুজরাটে বিধানসভা নির্বাচনে পদ্মাবতীকে থামিয়ে দেয়ার রাজনীতি করছেন না বিজেপি বরং রাজ্য সরকারের মুখ্যমন্ত্রী ও দলীয় রাজ্য প্রধান বিজয় রুপানীর স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতি ও অন্য বিধায়কদের প্রশাসনের উপর লাগামহীন প্রভাবকে আড়াল করতেই এবং নিজেদের ধর্মীয় রক্ষণশীল ভোট ব্যাংককে কোন প্রকার উসকানি না দিয়েই মুনাফা লাভ করতে পদ্মাবতীকে আটকে দিয়ে দাবার খেলায় নতুন ছকে বসিয়েছেন ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের নেতারা। এই মুহূর্ত পর্যন্ত পাল্টা আঘাত দিয়ে বিজেপির সাফল্যের তিলককে নিজের ঘরে তুলতে সমর্থ হচ্ছেন না ভারতীয় ন্যাশনাল কংগ্রেসের নেতারা।
প্রায় ৩শ বছর আগে চিতোরের রাণী পদ্মাবতীর ঐতিহাসিক ত্যাগকে কেন্দ্র করে বানানো এই চলচ্চিত্রটি নিয়ে যে পরিমাণ রাজনৈতিক ঢাকঢোল বাজানো হচ্ছে, সেখানে ভবিষ্যতে সবচেয়ে বেশী ফায়দা লুটে তুরুপের তাস হয়ে উঠতে পারেন রাজস্থানের মুখ্যমন্ত্রী বসুন্ধরা রাজে।
মরু রাজ্য গেরুয়া রঙ ছড়িয়ে পড়ার যে রাজনৈতিক সুফল ক্ষমতায় বসার প্রথমদিকে পাচ্ছিলেন তিনি, সেটি আগামী বছরের প্রথমার্ধে অনুষ্ঠিত হওয়া রাজস্থানের বিধানসভা নির্বাচনের আগে বেশ খানিকটা ফিকে হয়ে যেতে পারে ধারণা করা হচ্ছে।
সুতরাং রাজপুতদের ঐতিহাসিক আবেগকে পুনরায় কাছে টেনে নিয়ে গত পাঁচটি বিধানসভার নির্বাচনের মধ্যে রাজস্থানে চতুর্থবারের মতো মুখ্যমন্ত্রীর আসনে বিজেপিকে অধিষ্ঠিত করার কৌশলে সবচেয়ে বড় প্রভাবক হয়ে উঠবেন তিনিই।
এখন অপেক্ষার পালা, দর্শকদের জন্য কবে মুক্তি মিলবে পদ্মাবতীর। চিতোরের রাণীর প্রস্থান কিংবা আগমন কখনোই সহজলভ্য ছিল না পৃথিবীতে, বারবার সেটি প্রমাণ করে আজও প্রায় ৭শ একর জমির উপর সৃষ্ট তিন মাইল দীর্ঘ বিশাল সুরক্ষিত চিতোর দূগের্র আনাচে কানাচে মিশে রয়েছেন রাণী পদ্মাবতী যেখানে জওহরব্রত পালন, একজন রুপবতী রাণীর গল্প ছাড়াও রাজপুতের শৌর্য্য ও সংস্কৃতির মূল সত্তাধিকারী হয়ে টিকে রয়েছেন তিনি।
Posted ১:৫৭ পূর্বাহ্ণ | বুধবার, ১৩ ডিসেম্বর ২০১৭
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta