কক্সবাংলা ডটকম(১৮ জানুয়ারী) :: সাম্প্রতিক মার্কিন ড্রোন হামলায় ইরানি জেনারেল কাসেম সোলেমানি হত্যা আন্তর্জাতিক অঙ্গনকে উত্তপ্ত করে তুলেছে। জেনারেল সোলেমানি ইরাক সফরে গিয়েছিলেন। ইরাকের জনসংখ্যার প্রায় ৭০ শতাংশ শিয়া মুসলমান। ইরান বিশ্বের সর্ববৃহৎ শিয়া মুসলমান অধ্যুষিত দেশ হওয়ার কারণে পার্শ্ববর্তী আরব দেশগুলোর শিয়া সম্প্রদায়ের ওপর তাদের বেশ প্রভাব আছে।
ইরাকে বর্তমান শিয়া শাসকদের সঙ্গে ইরানের সম্পর্ক বেশ উষ্ণ। আইএস জঙ্গিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ব্যাপারে ইরাক সরকার এবং সেখানকার আধা সামরিক মিলিশিয়াদের নানাবিধ সামরিক সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে ইরান। অন্যদিকে বর্তমান মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং তার সরকারের সঙ্গে ইরানের সম্পর্ক বেজায় বৈরিতাপূর্ণ।
ইরাকে আবার কয়েকটি মার্কিন সামরিক ঘাঁটি আছে, যা ইরানের পছন্দনীয় নয়। ড্রোন হামলার কয়েকদিন আগে ইরানসমর্থক ইরাকি শিয়ারা বাগদাদে মার্কিন দূতাবাসের সামনে বড় ধরনের বিক্ষোভ সমাবেশ করে। মনে হয়, ট্রাম্পের ড্রোন হামলায় প্রভাবশালী ইরানি জেনারেল সোলেমানি এবং তার সঙ্গে ইরাকের আধা সরকারি শিয়া মিলিশিয়াদের ডেপুটি কমান্ডার মুহান্দিসকে হত্যার এটাই বড় কারণ। উল্লেখ্য, বাগদাদ বিমানবন্দরের কাছে নিহত সোলেমানি ও মুহান্দিস একই গাড়িতে ছিলেন।
এর প্রতিক্রিয়ায় ইরান সরকার বড় ধরনের প্রতিশোধ নেয়ার ঘোষণা দেয়। তারই ফলস্বরূপ ৭ জানুয়ারি ইরান ইরাকের দুটি মার্কিন সামরিক স্থাপনায় বেশ কয়েকটি মিসাইল হামলা চালিয়েছে।
এ লেখা যখন লিখছি, তখন ইরানি মিসাইল হামলার ব্যাপারে ট্রাম্পের প্রতিক্রিয়া বেশ শীতল মনে হল। তিনি টুইট করে বলছেন, অষষ রং বিষষ, অর্থাৎ সবই ভালো আছে। তবে ট্রাম্পের এ শীতল প্রতিক্রিয়া যে শিগগির ইরানের বিরুদ্ধে বড় ধরনের গরম প্রতিক্রিয়া এবং প্রতিশোধমূলক আক্রমণে রূপায়িত হবে, তাতে সন্দেহ নেই।
ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর থেকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নানাভাবে এবং নানা বিষয়ে যে চরম প্রতিক্রিয়াশীল ও যুদ্ধাংদেহি মনোভাব দেখাচ্ছেন, তাতে তাকে একটি খ্যাপা ষাঁড় বলা যায়। তিনি বৈশ্বিক উষ্ণতাকে অস্বীকার করে বিশ্ব আবহাওয়া তহবিলে অনুদান দেননি।
ইসরাইলের অন্যান্য অবৈধ কর্মকাণ্ডে নিন্দা জানানোর কারণে ট্রাম্প ইউনেস্কো থেকে সদস্যপদ প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। ইহুদিবাদী উগ্র রাষ্ট্র ইসরাইলের সবরকম অন্যায় আবদারের পরম বন্ধু ও পৃষ্ঠপোষক হচ্ছেন বর্তমান মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ট্রাম্প-ইসরাইলের ব্যাপারে আরও কিছু কথা পরে বলা যাবে।
তবে চীনের সঙ্গে তার বাণিজ্যযুদ্ধ বিদ্যমান বিশ্ববাণিজ্য ব্যবস্থাটিকেও ঝুঁকি বহুল করে তুলেছে। চীন এখন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনৈতিক শক্তি। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চীনের বাণিজ্যিক লেনদেন বিশাল আকারের। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে চীনের আমদানি-রফতানিকে বাধাগ্রস্ত করার মানসে ট্রাম্প ক্রমাগত শুল্ক এবং অশুল্ক বাধা আরোপ করে চলেছেন। তার সঙ্গে আন্তর্জাতিকভাবে চীনের প্রভাব খর্ব করার জন্যও ট্রাম্পের প্রচেষ্টার অন্ত নেই।
চীনের মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া বৈরী দ্বীপ তাইওয়ানকে সামরিক সহায়তা প্রদান, দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের একাধিপত্য খর্ব করা এবং হংকংয়ে বর্তমানে বেইজিং সরকারবিরোধী আন্দোলনে মদদদানের মাধ্যমে ট্রাম্পের চীন বিরোধিতা স্পষ্ট। অনুমান করতে অসুবিধা হয় না, চীন একটি পরাশক্তি হিসেবে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আবির্ভূত- হোক এটি ট্রাম্প চান না।
ট্রাম্পের ইরান বিরোধিতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির ব্যাপারে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নসহ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তি থেকে যখন যুক্তরাষ্ট্র একতরফাভাবে সরে আসে। তারপর দেশটির বিরদ্ধে অসংখ্য নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে, যা এখনও বিরতিহীনভাবে চলছে। ইরানের মিসাইল হামলার পর ট্রাম্প নতুন কিছু নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন, যদিও বাইরের দুনিয়ার ধারণা ছিল ট্রাম্প তার পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী ইরানের ৫২টি স্থানে সামরিক হামলা চালাবেন। ইরানের বিরুদ্ধে ট্রাম্পের এ ভয়ানক বৈরিতার কারণ আসলে ইসরাইলের প্রতি তার ভয়ানক আনুগত্য।
মধ্যপ্রাচ্যে ইরান একমাত্র দেশ যে ইসরাইলকে প্রকাশ্যে নিন্দা করে। ইসরাইলের ফিলিস্তিনি নির্যাতন, পার্শ্ববর্তী দেশগুলোকে ভীতি প্রদর্শন এবং সামরিক বাহাদুরি প্রদর্শনের বিরুদ্ধে ইরানই চ্যালেঞ্জ জানায়। ইরান পরমাণু শক্তিধর হয়ে উঠলে ইসরাইলের বিপদ হতে পারে- এ আশঙ্কাই ট্রাম্পের ইরান বিরোধিতার মূল কারণ। তার সঙ্গে আছে যুক্তরাষ্ট্রের বশংবদ সৌদি আরবসহ কিছু উপসাগরীয় দেশ, যারা ওই এলাকায় শিয়া ইরানের প্রভাব দেখতে চায় না।
হরমুজ প্রণালির ওপর ইরানের প্রভাবের বিরুদ্ধেও সক্রিয় এ দেশগুলো। কারণ বিশ্বের জ্বালানি তেল বাণিজ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ পথ হচ্ছে হরমুজ প্রণালি। ইরাক, সিরিয়া ও লেবাননের জনসংখ্যার সংখ্যাগরিষ্ঠ শিয়াদের ওপর ইরানের প্রভাবকে ওই এলাকায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ মিত্র ইসরাইলের প্রতি বড় হুমকি বলেও মনে করেন ট্রাম্প। বস্তুত, ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরাইলের নির্যাতনের সবচেয়ে বড় বিরোধিতাকারী হচ্ছে ইরান এবং তাই ইরান ইসরাইলের বড় শত্রু। আর প্রভাবশালী ইরানি জেনালের সোলেমানির বাগদাদ সফর ইরানের সামরিক সাহায্য এবং প্রভাব বিস্তারের অংশ বিবেচনা করেই ট্রাম্পের এ ড্রোন হামলা এবং তাকে হত্যা।
এর প্রতিক্রিয়ায় ইরানের মিসাইল হামলার পর ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু তার দেশের স্বার্থে ইরানকে মোকাবেলার হুমকি দিয়েছেন। এতেই প্রমাণ হয়, ট্রাম্পের আমেরিকা এবং ইসরাইলের অভিন্ন স্বার্থ ও সৌহার্দের বিষয়টি।
মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইল এক বিরাট সামরিক শক্তি। দেশটি জাতিসংঘসহ সারা বিশ্বকেই তোয়াক্কা করে না। পার্শ্ববর্তী আরব দেশগুলো তার কাছে কিছুই নয়। ১৯৬৫ সালে আরব-ইসরাইল যুদ্ধে মিসর, সিরিয়া ও জর্ডানের সম্মিলিত শক্তিকে ইসরাইল একা পরাজিত করে মিসরের সুয়েজ খাল পর্যন্ত পৌঁছে যায়। ওই যুদ্ধে দখলকৃত পশ্চিমতীরকে আস্তে আস্তে ইহুদি বসতি স্থাপনের মাধ্যমে ইসরাইলের অংশ করে নিচ্ছে, যা আন্তর্জাতিক আইন এবং জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞার লঙ্ঘন।
এরই মধ্যে জেরুজালেমকে ইসরাইলের রাজধানী বলে ট্রাম্প স্বীকৃতি দিয়ে মার্কিন দূতাবাস সেখানে সরিয়ে নিয়েছেন। এটিও জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞাবিরোধী। এ ধরনের নিষেধাজ্ঞা অবহেলা করে ট্রাম্পের মদদে ইসরাইল অধিকৃত সিরিয়ার গোলান মালভূমিকেও ইসরাইলের অংশ করে নিয়েছে। জেরুজালেম ও গোলান মালভূমির মালিকানা ইসরাইলকে প্রদান করে ট্রাম্প যে দলিল স্বাক্ষর করে, সে বিষয়টি উল্লেখের দাবি রাখে।
সাংবাদিকদের ডেকে ফটোসেশন করে দলিলে স্বাক্ষরের ঘটনাটি ট্রাম্প বিশ্ববাসীকে প্রদর্শন করেন। এত বড় একটি অন্যায় কাজ আরব দেশগুলোসহ বিশ্ববাসীকেও জানিয়ে তিনি তার ঔদ্ধত্য প্রকাশ করেছেন। ইসরাইল পশ্চিমা বিশ্ব, বিশেষ করে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতা ও সাহায্যেই সৃষ্টি। দেশটির বর্তমান মানচিত্রটি একটি ডেগারজাতীয় ছুরির মতো। আরব বিশ্বে ইসরাইল এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরম সুহৃদ এবং শক্তিশালী লাঠিয়াল। তবে সম্প্রতি মার্কিন সহায়তায় তৈরি বৃহত্তর ইসরাইলের সে মানচিত্র দেখা গেল, তাতে লেবানন-সিরিয়াও অন্তর্ভুক্ত হয়ে আছে। আর তা যদি হয়, তবে মার্কিন-ইসরাইলের যৌথ সামরিক অভিযানেই তা সম্ভব হবে।
প্রশ্ন হতে পারে, আমাদের মতো গরিব দেশের মানুষের এ নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কী দরকার? উত্তর হল, আমরা এক ও অভিন্ন বিশ্বে বাস করি। মার্কিন ও ইসরাইলি এসব কর্মকাণ্ড ও পরিকল্পনা যদি বাধাহীনভাবে চলতে থাকে, তবে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ‘জোর যার মুল্লুক তার’ নীতিটিই নিয়ম হয়ে দাঁড়াবে। ক্ষুদ্র ও দুর্বল রাষ্ট্রগুলোর স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা দুরূহ হয়ে পড়বে। ভাবতে আশ্চর্য লাগে, ইহুদিবাদী ইসরাইল হল গত মহাযুদ্ধে হিটলারের ইহুদি নিধনযজ্ঞের শিকার ইহুদিদের সৃষ্ট একটি রাষ্ট্র। হিটলারের এই বর্বর ইহুদিবিরোধী হত্যাযজ্ঞ, যা ইতিহাসে ‘হলোকস্ট’ নামে পরিচিত, তা বিশ্বব্যাপী চরম নিন্দিত হয়েছে।
গণহত্যার শিকার ইহুদিদের প্রতি সারা বিশ্ব সহানুভূতি ও সমবেদনা জানিয়েছে। আজ তারাই জোরপূর্বক ফিলিস্তিনিদের দেশ প্যালেস্টাইন দখল করে ইসরাইলি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছে। তারপর ফিলিস্তিনিদের ওপর এহেন নির্যাতন-নিপীড়ন নেই যা চালায়নি। সেই নিপীড়ন এখনও অনবরত চলছে। এখানেই প্রশ্ন ওঠে, মানুষ কি স্বভাবগতভাবে ভালো, নাকি সে সুযোগমতো ভালো হয়! এককালের চরম নির্যাতন ভোগকারী মানুষ সুযোগ ও ক্ষমতা পেলে যে নিজেরা চরম নির্যাতক ও হত্যাকারী হয়ে উঠতে পারে, ইসরাইলের ইহুদিরা এটাই প্রমাণ করেছে। অথচ বিশ্বের জ্ঞান-বিজ্ঞানে তাদের বিরাট অবদান আছে।
বিগত শতকের বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রতিভাবান ব্যক্তি আইস্টাইন ইহুদি ছিলেন। এ পর্যন্ত বিশ্বের মোট নোবেল পুরস্কার বিজয়ীদের প্রায় ২০ শতাংশ ইহুদি। অথচ বিশ্বের মোট জনসংখ্যার অর্ধশতাংশও ইহুদি নয়। বিলাতে দীর্ঘদিন পড়াশোনা ও চাকরির সুবাদে আমি ব্যক্তিগতভাবেও বেশকিছু ইহুদি পেয়েছি, যারা অতিশয় সজ্জন। মানববিদ্বেষী বা ইহুদিবিদ্বেষী হওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়।
বর্তমান ভূ-রাজনীতির প্রেক্ষাপটে আমাদের সহানুভূতি ইরানের পক্ষে; কারণ দুর্বলের ওপর সবলের অত্যাচার মেনে নেয়া যায় না। তবে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান ও ধন-সম্পদে শক্তিশালী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কি পেরে উঠবে ইরান? জেনারেল সোলেমানির জানাজা অনুষ্ঠানে ইরানের দুই শহরে পদদলিত হয়ে প্রায় ১০০ মানুষের মৃত্যুতে তাদের শিক্ষা ও শৃঙ্খলার নিদারুণ অভাবই প্রমাণিত হয়।
ইতিহাসে দেখা যায়, জ্ঞান-বিজ্ঞানে পশ্চাৎপদ দেশগুলো উন্নত-সমৃদ্ধ দেশের কাছে বারবার হেরে গেছে। সুতরাং ইরানসহ বিশ্বের অনুন্নত দরিদ্র দেশগুলোকে বাস্তববাদী হতে হবে। তবে জাতীয় স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে বিকিয়ে দিয়ে নয়। অন্যদিকে মনে রাখতে হবে, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও ধন-সম্পদে শক্তিশালী হওয়াই স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের বড় গ্যারান্টি বা শক্তি। তবে স্বস্তির কথা, আলোচ্য সংকট ও সংঘর্ষের ব্যাপারে উভয় পক্ষই তাদের সুর এখন নরম করেছে। ইরানের মিসাইল হামলার বিরুদ্ধে ট্রাম্প পাল্টা হামলা চালায়নি। ট্রাম্প ও ইরান পারস্পরিক বৈরিতা ও উত্তেজনা প্রশমনের পক্ষে মতামত প্রকাশ করেছে। ধারণা করা যায়, বিশ্ব নতুন আরেকটি যুদ্ধের হাত থেকে বাঁচল।
মো. মইনুল ইসলাম : সাবেক অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
Posted ২:৩৪ পূর্বাহ্ণ | রবিবার, ১৯ জানুয়ারি ২০২০
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta