কক্সবাংলা ডটকম(২৭ এপ্রিল) :: আগামী ৭ মে মহাকাশের পথে স্বপ্নযাত্রা শুরু করবে ‘বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট’। নতুন করে সংকট তৈরি না হলে এটাই চূড়ান্ত দিনক্ষণ বলে বলা হচ্ছে সরকারের তরফ থেকে। প্রতিবেশী দেশ ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কার সঙ্গে মর্যাদার আসনে যুক্ত হচ্ছে বাংলাদেশও। উেক্ষপণের দিনটি হবে বাংলাদেশের জন্য অন্যরকম একটি দিন।
আগামী ১৫ বছরের জন্য মহাকাশের স্থায়ী বাসিন্দা হতে রওনা হবে ‘বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট’। যুক্তরাষ্ট্রের বেসরকারি মহাকাশ অনুসন্ধান ও প্রযুক্তি কোম্পানি ‘স্পেসএক্স’ এর ফ্যালকন-৯ রকেট ফ্লোরিডার কেপ ক্যানাভেরালের লঞ্চিং প্যাড থেকে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটকে নিয়ে মহাকাশের পথে উড়াল দেবে।
গত ১৬ ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উেক্ষপণের কথা থাকলেও হারিকেন আরমায় ফ্লোরিডায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হওয়ায় কেপ ক্যানাভেরাল থেকে স্যাটেলাইট উেক্ষপণ বন্ধ হয়ে গেলে বিভিন্ন দেশের স্যাটেলাইট উেক্ষপণ পিছিয়ে যায়, বাংলাদেশও পড়ে সূচির জটে। এখন সূচির জট না থাকলেও আবহাওয়া একটা বড় কারণ। ৭ মে আবহাওয়া যদি কোনো ধরনের জটিলতা তৈরি না করে তাহলে ওই দিনই সেই মাহেন্দ্রক্ষণ।
২০১৫ সালের ২১ অক্টোবর সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি ‘বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট’ উেক্ষপণে ‘স্যাটেলাইট সিস্টেম’ কেনার প্রস্তাব অনুমোদন দেয়। এটার জন্য ২ হাজার ৯৬৭ কোটি ৯৫ লাখ টাকা খরচ ধরা হয়। এর মধ্যে সরকারি অর্থ ১ হাজার ৩১৫ কোটি ৫১ লাখ টাকা। আর বিদেশি অর্থায়ন ১ হাজার ৬৫২ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। যদিও শেষ পর্যন্ত স্যাটেলাইট উড়াতে সর্বমোট খরচ হচ্ছে ২ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা।
বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উেক্ষপণে অর্থায়নের জন্য হংকং সাংহাই ব্যাংকিং করপোরেশনের (এইচএসবিসি) সঙ্গে প্রায় এক হাজার ৪০০ কোটি টাকার ঋণচুক্তি করেছে বিটিআরসি।
বিটিআরসি চেয়ারম্যান বলেন, ‘১৫৭ দশমিক ৫ মিলিয়ন ইউরো যা বাংলাদেশের টাকায় প্রায় ১৪০০ কোটি টাকার এই ঋণের ইন্টারেস্ট রেট এক দশমিক ৫১ শতাংশ। ঋণ শোধের সময় ১২ বছর এবং ২০ কিস্তিতে এ ঋণ শোধ করতে হবে।’
বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট নির্মাণ : বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট নির্মিত হয়েছে ফ্রান্সের থ্যালেস এলিনিয়া স্পেস ফ্যাসিলিটিতে। নির্মাণ, পরীক্ষা, পর্যালোচনা ও হস্তান্তর শেষে বিশেষ কার্গো বিমানে সেটি কেপ ক্যানাভেরালের লঞ্চ সাইটে পাঠানো হয়। এর মধ্যেই তিন দশমিক ৭ টন ওজনের স্যাটেলাইটটি উেক্ষপণে শুরু হয়ে গেছে ‘লঞ্চ ক্যাম্পেইন‘। গত ৩০ মার্চ স্যাটেলাইটটি ফ্লোরিডার লঞ্চিং প্যাডে পৌঁছে। এর আগে ২০১৫ সালের নভেম্বরে থ্যালেস এলিনিয়া স্পেসের সঙ্গে ডিজাইন ও নির্মাণের চুক্তি করে সরকার। এই চুক্তিটি ছিল ১ হাজার ৯৫১ কোটি ৭৫ লাখ টাকার।
মহাকাশের পথে যেভাবে উড়াল দেবে : বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের প্রকল্প পরিচালক মো. মেজবাহুজ্জামান জানান, ফ্যালকন-৯ রকেটে চারটি অংশ রয়েছে। ওপরের অংশে থাকবে স্যাটেলাইট, তারপর অ্যাডাপটর। এরপর স্টেজ-২ এবং সবচেয়ে নিচে থাকে স্টেজ-১। নির্ধারিত সময়ে রকেটটি সব ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরই উেক্ষপণ করা হবে। উেক্ষপণের পরপরই স্টেজ ওয়ান চালু হয়ে ওপরের দিকে উঠতে শুরু করবে রকেট। প্রচণ্ড শক্তিতে ধাবিত হবে মহাকাশের দিকে।
তিনি বলেন, এ উেক্ষপণ দেখতে হলে আগ্রহীদের উেক্ষপণ স্থানের তিন থেকে চার কিলোমিটার দূরে অবস্থান নিতে হবে। সাত মিনিটের কম সময় দেখা যাবে, তার পরপরই উচ্চগতির রকেট চলে যাবে দৃষ্টিসীমার বাইরে। একটি নির্দিষ্ট সময়ের পর রকেটের স্টেজ-১ খুলে নিচের দিকে নামতে থাকে, এরপর চালু হয় স্টেজ-২। পুনরায় ব্যবহারযোগ্য স্টেজ-১ পৃথিবীতে এলেও স্টেজ-২ একটি নির্দিষ্ট দূরত্ব পর্যন্ত স্যাটেলাইটকে নিয়ে গিয়ে মহাকাশেই থেকে যায়।
দু’টি ধাপে এই উেক্ষপণ প্রক্রিয়া শেষ হয় জানিয়ে প্রকল্প পরিচালক বলেন, প্রথম ধাপটি হলো লঞ্চ অ্যান্ড আরলি অরবিট ফেজ (এলইওপি) এবং দ্বিতীয় ধাপ হচ্ছে স্যাটেলাইট ইন অরবিট। এলইওপি ধাপে ১০ দিন এবং পরের ধাপে ২০ দিন লাগবে। উেক্ষপণ স্থান থেকে ৩৬ হাজার কিলোমিটার দূরে যাবে এ স্যাটেলাইট। ৩৫ হাজার ৭০০ কিলোমিটার যাওয়ার পর রকেটের স্টেজ-২ খুলে যাবে।
স্যাটেলাইট উন্মুক্ত হওয়ার পরপর এর নিয়ন্ত্রণ যুক্তরাষ্ট্র, ইতালি এবং কোরিয়ার তিনটি গ্রাউন্ড স্টেশনে চলে যাবে। এই তিন স্টেশন থেকে স্যাটেলাইটটিকে নিয়ন্ত্রণ করে এর নিজস্ব কক্ষপথে (১১৯.১ পূর্ব দ্রাঘিমাংশে অরবিটাল স্লট) স্থাপন করা হবে।
গ্রাউন্ড স্টেশন : স্যাটেলাইটটি পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আনতে প্রায় ২০ দিন লাগবে। স্যাটেলাইটটি সম্পূর্ণ চালু হওয়ার পর এর নিয়ন্ত্রণ বাংলাদেশের গ্রাউন্ড স্টেশনে হস্তান্তর করা হবে। স্যাটেলাইটের গ্রাউন্ড স্টেশন স্থাপন করা হয়েছে গাজীপুরের জয়দেবপুর ও রাঙ্গামাটির বেতবুনিয়ায়। এদিকে দক্ষিণ কোরিয়া গত বছর ৩০ অক্টোবর একই স্থান থেকে একটি স্যাটেলাইট উেক্ষপণ করেছে। বাংলাদেশের স্যাটেলাইটটিও একইভাবে উেক্ষপণ হবে। সেখানে কেটি বা কোরিয়ান স্যাটেলাইট লেখা ছিল। আমাদের স্যাটেলাইটে লেখা থাকবে বিবি এবং থাকবে একটি সরকারি লোগো।
ব্যবসায়িক পরিকল্পনা : সরকারের তরফ থেকে আশা করা হচ্ছে, বর্তমানে বিদেশি স্যাটেলাইটের ভাড়া বাবদ যে ১৪ মিলিয়ন ডলার ব্যয় হয়, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উেক্ষপণের পর সেই অর্থ সাশ্রয় হবে। বাংলাদেশের টিভি চ্যানেলগুলো বিদেশি স্যাটেলাইট থেকে বর্তমানে সেবা নিচ্ছে। এতে বিপুল পরিমাণ ডলার বাইরে চলে যাচ্ছে।
এই স্যাটেলাইট উেক্ষপণ হলে সেই অর্থ দেশেই থেকে যাবে। উল্টো ভাড়া দিয়ে বৈদেশিক মুদ্রা দেশে আনা সম্ভব হবে বলেও জানিয়েছেন বিটিআরসি চেয়ারম্যান ড. শাহজাহান মাহমুদ। তিনি বলেন, আগামী ৭/৮ বছরের মধ্যে আমাদের বিনিয়োগের টাকা উঠে আসবে।
বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটে ৪০টি ট্রান্সপন্ডার থাকবে, যার ২০টি বাংলাদেশের ব্যবহারের জন্য রাখা হবে এবং বাকিগুলো ভাড়া দেয়া হবে। তবে আমাদের স্যাটেলাইট থেকে টিভি চ্যানেলগুলো যে সেবা নেবে সেখানে ব্যবসায়িক বিষয়ের বাইরেও চ্যানেলগুলোর সুযোগ-সুবিধা দেখার কথা বলেছেন একাত্তর টিভির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান সম্পাদক মোজাম্মেল বাবু।
তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট যে অরবিটাল স্লটে (১১৯.১ পূর্ব দ্রাঘিমাংশ) স্থাপন করা হবে, তার মাধ্যমে কাজ করা বাংলাদেশের টেলিভিশনগুলোর জন্য হবে একটি চ্যালেঞ্জ।
ডাক, টেলিযোগাযোগ ও আইসিটি মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বলেন, এটিকে শুধু ব্যবসায়িক দিক দিয়ে দেখলে হবে না। নিজস্ব স্যাটেলাইট উেক্ষপণে যে মর্যাদা তৈরি হবে সেটাও কম নয়। আমরা নিজস্ব স্যাটেলাইট ব্যবহার করে প্রত্যন্ত অঞ্চলে ইন্টারনেট সেবা পৌঁছে দিতে পারব। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও আমাদের মর্যাদা বাড়বে।
স্যাটেলাইট পরিচালনায় কোম্পানি : পাঁচ হাজার কোটি টাকার অনুমোদিত মূলধন নিয়ে ‘বাংলাদেশ কমিউনিকেশন স্যাটেলাইট কোম্পানি লিমিটেড’ গঠন করা হয়েছে। এই কোম্পানি স্যাটেলাইটের ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পালন করবে। এর ১০ টাকা মূল্যের পাঁচশ কোটি শেয়ার হবে। কোম্পানির বর্তমান এমডি টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব সাইফুল ইসলাম। সচিব পদাধিকারবলে এটার চেয়ারম্যান। এতে ১১ সদস্যের একটি বোর্ড আছে।
এতে টেলিযোগাযোগ, অর্থ বিভাগ, তথ্য মন্ত্রণালয়, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ও স্বশস্ত্র বাহিনী বিভাগের একজন করে প্রতিনিধি আছেন।
এ ছাড়া টেলিকমিউনিকেশন ডিপার্টমেন্টের মহাপরিচালক, স্পারসোর চেয়ারম্যান, সরকার মনোনীত দুইজন পরিচালক এবং বাংলাদেশ কমিউনিকেশন স্যাটেলাইট কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ কমিটিতে আছেন।
বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট প্রকল্প ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক টেলিকমিউনিকেশন সংস্থার (আইটিইউ) ‘রিকগনিশন অফ এক্সিলেন্স’ পুরস্কারও পেয়েছে।