কক্সবাংলা ডটকম(২১ ফেব্রুয়ারি) :: ২০১৭ সালের ডিসেম্বরের এক শীতল দিনে চীনের গ্রেট হলে দেশটির প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এক বিশেষ অতিথি মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট আবদুল্লাহ ইয়ামিন আবদুল গাইয়ুমকে স্বাগত জানিয়েছিলেন। ইয়ামিন তখন পরিপূর্ণ নিয়ন্ত্রণের অধিকারী এক নেতার সদম্ভ পদক্ষেপে রেড কার্পেটে হেঁটেছিলেন। এর ঠিক এক সপ্তাহ আগে তার সরকার চীনের সঙ্গে ঐতিহাসিক একটি মুক্তবাণিজ্য চুক্তিতে (এফটিএ) বিরোধীদের উপেক্ষা করে পার্লামেন্টের অনুমোদন নিয়েছিল।
ওই সফরে চুক্তিটি চূড়ান্ত স্বাক্ষরিত হওয়ার কথা ছিল। অবশ্য কয়েক বছর ধরে মালদ্বীপের পররাষ্ট্রনীতি ধীরে ধীরে চীনের দিকে ঝুঁকে পড়ার গুরুত্বপূর্ণ একটি পয়েন্ট ছিল সেটি। ওই সফরে জিনপিং জোর দিয়ে ইয়ামিনকে ‘চীনের প্রতিবেশীদের সঙ্গে বিস্তৃত বৃহৎ পরিবারের একজন সদস্য’ হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন। কিন্তু ওই ঘটনার মাত্র দুই মাসের মাথায় দু’দেশের সম্পর্কের বন্ধন অপ্রত্যাশিত এক পরীক্ষার মাঝে পড়েছে।
সাবেক প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ নাশিদসহ বিরোধী দলের ৯ জন নেতৃত্বস্থানীয় সদস্যের বিরুদ্ধে থাকা সন্ত্রাসবাদের একটি মামলা সুপ্রিমকোর্ট বাতিল করার পর ২০১৮ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি মালদ্বীপে ১৫ দিনের জন্য জরুরি অবস্থা জারি করেন প্রেসিডেন্ট ইয়ামিন। এর কয়েক ঘণ্টার মাথায় নিরাপত্তা বাহিনী রাজধানী মালেতে ছড়িয়ে পড়ে এবং সুপ্রিমকোর্টের দু’জন বিচারপতিকে আটক করে। এছাড়া দেশটির সবচেয়ে বেশি সময় ক্ষমতায় থাকা সাবেক প্রেসিডেন্ট মামুন আবদুল গাইয়ুমসহ অনেক বিরোধীদলীয় নেতাকে গ্রেফতার করা হয়।
এ বছরের শেষের দিকে মালদ্বীপে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল; কিন্তু দেশটি বর্তমানে একটি সাংবিধানিক সংকটে পড়েছে। এসব ঘটনার তরঙ্গায়িত প্রভাব গোটা ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে অনুভূত হচ্ছে এবং প্রভাব বিস্তারের লক্ষ্যে ভারত ও চীনের কৌশলগত লড়াইকেও সেগুলো প্রভাবান্বিত করছে। এ দুটি দেশই অঞ্চলটিকে তাদের প্রভাব বিস্তারের ঐতিহ্যবাহী ক্ষেত্র হিসেবে বিবেচনা করে থাকে।
এ পরিপ্রেক্ষিতে ইয়ামিনের সিদ্ধান্তটি চীনের জন্য একটি কৌশলগত চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করেছে। এসব বুঝতে হলে এ অঞ্চলে চীনের উদ্দেশ্য, স্বার্থ ও পদক্ষেপ পরীক্ষা করে দেখতে হবে। গত বছরের অক্টোবরে চীনের ১৯তম পার্টি কংগ্রেসের বক্তব্যে শি জিনপিং চীনের স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্যের একটি রূপরেখা তুলে ধরেছিলেন। তাতে তিনি বলেছিলেন, চীনের লক্ষ্য হচ্ছে ২০৫০ সালে বৈশ্বিক নেতৃত্ব দানকারীর মর্যাদা পাওয়ার আগে এশিয়ায় নেতৃত্বদানকারী শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হওয়া।
চীনের ভাষায়- সমন্বিত জাতীয় শক্তি বিস্তৃতকরণ, নিজেদের ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক শক্তিকে উপজীব্য করে উন্নয়নশীল দেশগুলোর সঙ্গে কৌশলগত সম্পর্ক জোরদারের মাধ্যমে এবং নতুন আদর্শ তুলে ধরার পাশাপাশি বৈশ্বিক সুশাসনের বিভিন্ন ইস্যুতে প্রতিনিয়ত অধিকহারে কার্যকর ভূমিকা পালনের মধ্য দিয়ে লক্ষ্যগুলো অর্জন করতে চায় বেইজিং। এটি এমন এক উচ্চাকাক্সক্ষী এজেন্ডা, যার জন্য প্রয়োজন কুশলী কূটনীতি- তুলনামূলক ছোট দেশ এবং প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তিগুলোর মাধ্যমে সম্ভাব্য পাল্টা-ভারসাম্য আনার চেষ্টাকে প্রশমিত করা।
চীন-মালদ্বীপ সম্পর্কের ক্ষেত্রে এ মডেলের প্রয়োগে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় প্রকাশ পাচ্ছে। প্রথমত, যদিও মালদ্বীপের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বন্ধন আনুষ্ঠানিকভাবে ১৯৭২ সালে স্থাপন করেছে চীন, কিন্তু দেশ দুটির মধ্যে সম্পর্ক গভীর হওয়া শুরু হয়েছে ২০১১ সালে বেইজিং কর্তৃক মালেতে কূটনৈতিক মিশন স্থাপন করার মধ্য দিয়ে। তারপর থেকে এ সম্পর্ক বিস্তৃত হয়েছে লাফিয়ে লাফিয়ে এবং প্রথম চীনা রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে জিনপিং ২০১৪ সালে মালদ্বীপ সফর করেন।
এরই মধ্যে চীন দ্বীপদেশটির জন্য বহু মিলিয়ন ডলার অনুদানের প্রতিশ্র“তি দিয়েছে। মালদ্বীপে বিদেশি পর্যটকদের এক-চতুর্থাংশই যায় চীন থেকে। মালদ্বীপের বিভিন্ন দ্বীপে অনেক মেগা অবকাঠামো প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে চীনা কোম্পানিগুলো এবং দেশটি চীনের ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) প্রকল্পের অংশীদার। ২০১৫ সালে মালদ্বীপের সংবিধানের এক সংশোধনীর মাধ্যমে বিদেশিদের ভূমির মালিকানার অধিকার দেয়া হয়। চীনকে উদ্দেশ্য করেই এ পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে বলে মনে করা হয়। ওই সংশোধনীর পরই ২০১৭ সালে চীনের সঙ্গে মুক্তবাণিজ্য চুক্তি করে মালদ্বীপ।
মালদ্বীপের জন্য চীন স্পষ্টতই একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক অংশীদার হয়ে পড়েছে; কিন্তু চীনের রাজকোষ এবং বিশ্বের অন্যান্য অংশে এর বিনিয়োগের আকার বিবেচনায় নিলে সঠিক অর্থনৈতিক পরিভাষায় মালদ্বীপে বেইজিংয়ের বিনিয়োগ খুব বেশি কিছু নয়। অর্থনীতি বিশ্লেষণকারী সংস্থা মুডির মূল্যায়ন অনুযায়ী, ২০১৭ সালে মালদ্বীপে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ৪৮ কোটি ৫০ লাখ ডলার। ফলে অর্থনীতি এখানে চীনের মূল লক্ষ্য নয়; বরং এটি হচ্ছে কৌশলগত বিষয়, যার ওপর চীনা প্রেসিডেন্ট জোর দিচ্ছেন।
গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক রুটের নিরাপত্তা, জ্বালানি সরবরাহের নিশ্চয়তা এবং বিদেশে চীনের সম্পত্তি রক্ষায় সমুদ্রভিত্তিক একটি নৌবাহিনী গড়ে তোলার লক্ষ্যের কথা চীনের আধুনিকায়ন প্রকল্পের আওতার মধ্যে রয়েছে। পৃথিবীর এক-চতুর্থাংশ ভারী কার্গো চলাচল, এমনকি আরও বড় তেলবাহী জাহাজ ভারত মহাসাগর দিয়ে চলাচল করে। এ কারণে মালদ্বীপের ভৌগোলিক অবস্থান একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে পরিণত হয়েছে। ২০১৭ সালের আগস্টে প্রথমবারের মতো ‘শুভেচ্ছা সফরের’ অংশ হিসেবে চীনের নৌবাহিনীর তিনটি জাহাজ মালেতে পৌঁছানোর মধ্য দিয়ে এ এজেন্ডার স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া গেছে।
তবে দু’দেশের মধ্যে ক্রমবর্ধমান এ উষ্ণ সম্পর্ক মালদ্বীপে জরুরি অবস্থা জারির কারণে বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে। চীনের অবস্থান বিবেচনায় প্রেসিডেন্ট ইয়ামিন এক্ষেত্রে দুটি বিকল্প সামনে রেখেছেন- এমন এক মিত্রের পক্ষে দাঁড়াও, যার অজনপ্রিয়তা নিজের ক্ষতির কারণ হতে পারে অথবা গণতন্ত্রের দিকে ঝুঁকে পড়ো। অবশ্য সুড়ঙ্গের আলোর শেষ প্রান্তে এ দুটি বিকল্পের মাঝে রণকৌশল চালার সুযোগ আছে; তবে এগুলোর কোনোটিই অনুসরণ করা সহজ নয় এবং যে কোনোটির জন্যই নিজেকে বড় মূল্য দিতে হতে পারে।
উদাহরণস্বরূপ, চীনের অনমনীয় সমর্থন মালদ্বীপে জরুরি অবস্থার সময় বৃদ্ধি এবং বিরোধীদের ওপর আরও বেশি দমনপীড়নের পরিস্থিতি তৈরি করেছে, যা দেশটিতে অন্যান্য আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপের কারণ হতে পারে। এমন হস্তক্ষেপ হতে পারে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ থেকে শুরু করে গোপনে বা প্রকাশ্যে বল প্রয়োগের মাধ্যমেও।
মালদ্বীপের ঘটনাবলি কীভাবে গ্রহণ করছে দেশটির মিত্ররা এবং অন্যান্য বেল্ট অ্যান্ড রোড প্রকল্পভুক্ত (বিআরআই) দেশ, চীন সম্ভবত তা-ও খুব ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ ও পরিস্থিতি মূল্যায়নের চেষ্টা করে যাবে। দুঃসময়ে বিশ্বস্ত অংশীদারের পাশে না দাঁড়ালে তা নিকোলাস মাদুরো এবং রড্রিগো দুতার্তের মতো নেতাদের বিরূপ ইঙ্গিত দিতে পারে। অন্যদিকে ইয়ামিনকে শর্তহীন সমর্থন দেয়া বিআরআইভুক্ত দেশগুলোতে চীনের ব্যাপারে রাজনৈতিকভাবে ও সাধারণ মানুষের মনে নেতিবাচক ধারণা তৈরি করতে পারে। অধিকন্তু, এটি বৈশ্বিক মানদণ্ড তৈরিতে চীন ও পশ্চিমাদের মাঝে পদ্ধতিগত মূল্যবোধের প্রতিযোগিতাকে আরও তীব্র করে তুলতে পারে।
এরই মধ্যে চীনের বিভিন্ন পদক্ষেপে এসব লক্ষণ দেখা গেছে। যেমন- চীন প্রত্যাশিতভাবেই মালদ্বীপের জরুরি অবস্থাকে তার অভ্যন্তরীণ ইস্যু হিসেবে বর্ণনা করেছে এবং জাতিসংঘে ইয়ামিনের বিষয়টি আড়াল করেছে। তবে দেশটি ভারতের প্রভাবের বিষয়টিও স্বীকার করেছে এবং বলেছে, মালদ্বীপে স্থিতিশীলতা বজায় রাখা চীন ও ভারতের ‘অভিন্ন স্বার্থ’। এছাড়া বেইজিং ইঙ্গিত দিয়েছে, নিজেদের বিনিয়োগের সুরক্ষায় মালদ্বীপের সামরিক বাহিনীর ওপর আস্থা রেখে দেশটিতে যে কোনো বাহিনী পাঠানো থেকে বিরত থাকবে চীন। দেশটির প্রতিরক্ষামন্ত্রী ওয়াং ই মালদ্বীপে চীনের সাহায্য ও সহায়তার ধরন ‘নিঃশর্ত’ রাখার ওপর জোর দিয়েছেন।
এটা স্পষ্ট যে, সেখানে চীনকে একটি নমনীয় ভারসাম্যমূলক অবস্থানে থেকে নিজেদের কাজ চালাতে হবে এবং সে চেষ্টাই দেশটি করছে। দীর্ঘমেয়াদে মালেতে একটি সমর্থনমূলক সরকার দেখতে চায় বেইজিং। এ কারণে চীনকে সতর্কতার সঙ্গে ইয়ামিনকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে, আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক শক্তিগুলোর সঙ্গে অবশ্যই সহযোগিতা করতে হবে এবং মালদ্বীপের জনগণ যাতে বিরূপ মনোভাবাপন্ন হয়ে না ওঠে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
Posted ৩:২৬ পূর্বাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৮
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta