কক্সবাংলা ডটকম(২০ মার্চ) :: ১৫ মে, ১৫৫৫ সাল। এই দিন সন্ধ্যার কিছুক্ষণ আগে আফগান সেনাবাহিনীর মুখোমুখি হয় বৈরাম খানের নেতৃত্বাধীন ক্ষুদ্র মুঘল সেনাবাহিনী। তবে মাত্র ১০ ঘন্টার মাঝেই সম্পূর্ণরুপে পরাজিত হয় ৩০,০০০ সৈন্যের সুগঠিত আফগান সেনাবাহিনীটি। পাঞ্জাবের মাছিওয়ারায় এ বাহিনীটি পরাজিত হওয়ায় সিকান্দার শাহ সুরি বুঝলেন আদিল শাহের সাথে বোঝাপড়া পরে করলেও চলবে। আগে মুঘলদের ঠেকাতে হবে। দ্রুত তিনি ৮০,০০০ সৈন্যের শক্তিশালী একটি বাহিনী নিয়ে এসে মুঘলদের সদ্য দখলকৃত সিরহিন্দ দুর্গ অবরোধ করলেন।
দুর্গের ভেতরে অবরুদ্ধ বৈরাম খানের সাহায্য প্রার্থনার পত্র পেয়ে ২৮ মে সম্রাট হুমায়ুন দ্রুতগতিতে সিরহিন্দ এসে পৌঁছালেন। সম্রাট হুমায়ুনের অগ্রসর হওয়ায় সংবাদ পেয়ে আফগানরা সিরহিন্দ থেকে কিছুটা পিছু হটে সিরহিন্দ আর দিল্লির মাঝামাঝি ঘাটি গেড়ে অবস্থান নিলো। মুঘল সেনাবাহিনীর অতর্কিত হামলা থেকে বাঁচতে ঘাটি বরাবর দীর্ঘ পরিখা খনন করা হলো। অন্যদিকে, মুঘল সেনাবাহিনী সিরহিন্দে নিজেদের অবস্থান শক্ত করে আফগানদের মুখোমুখি অবস্থান নিলো।
আফগানদের মুখোমুখি হয়েই সম্রাট হুমায়ুন তার বাহিনীকে চারটি ভাগে ভাগ করে ফেললেন। একটি অংশ নিজের নিয়ন্ত্রণে রেখে অন্য একটি অংশের নেতৃত্ব দিলেন খান-ই-খানান বৈরাম খানকে। তৃতীয় অংশের নেতৃত্বে ছিলেন শাহ আবুল মালী ও তরদী বেগ, আর চতুর্থ অংশের নিয়ন্ত্রণে ছিলেন সিকান্দার খান উজবেক ও আলা কুলী আন্দারাবী।
প্রায় ১ মাস এই দুই বাহিনী নিশ্চুপ অবস্থায় বসে বসে অন্য পক্ষের আক্রমণের জন্য অপেক্ষা করলো। অবশ্য পুরোপুরি নিশ্চুপ যে ছিলো, ঠিক তা-ও না। প্রায়ই কোনো না কোনো জায়গা থেকে ছোটখাট সংঘর্ষের সংবাদ পাচ্ছিলেন সম্রাট হুমায়ুন ও সিকান্দার শাহ সুরি দুজনেই। অবশ্য তাতে কিছু আসে যায় না, মূল যুদ্ধ এখনো বাকি।
এদিকে সম্রাট হুমায়ুন তরদী বেগের নেতৃত্বে দক্ষ একদল অশ্বারোহী নিয়োজিত করলেন আফগানদের রসদ সরবরাহ বাধাগ্রস্থ করতে। মুঘল অশ্বারোহীদের দুর্ধর্ষ আক্রমণে আফগানদের রসদ সরবরাহ ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখোমুখি হলো। টানা কয়েকটি পরাজয়ে আফগানরা এমনিতেই কিছুটা অস্বস্তিতে ছিলো, তার উপর রসদ সরবরাহ বাধাগ্রস্থ হওয়ায় আফগান শিবিরে উত্তেজনা বৃদ্ধি পেতে লাগলো।
অবশেষে আফগানরাই প্রথম আক্রমণ চালালো। দিনটি ছিলো ১৫৫৫ সালের ২২ জুন।
বৈরাম খানের বাহিনীটি আকারে বেশ বড় হওয়ায় আফগানরা এই বাহিনীকেই মুঘলদের মূল বাহিনী ভেবে বসলো। তাদের ধারণা ছিলো সম্রাট হুমায়ুন এই বাহিনীতেই অবস্থান করছেন। কাজেই এই বাহিনীকে পরাজিত করতে পারলে মুঘল সেনাবাহিনীর বাকি অংশের মনোবল ভেঙে যাবে। তাই বাহিনীটিকে দ্রুত বিপর্যস্ত করে তুলতে সিকান্দার শাহ সুরি তার হস্তিবাহিনীকে এগিয়ে দিয়ে একযোগে তীব্র আক্রমণ চালালেন।
তীব্র আফগান আক্রমণে বৈরাম খান চোখে-মুখে অন্ধকার দেখতে লাগলেন। আফগান হস্তীবাহিনীর পায়ের তলায় পিষ্ট হয়ে প্রচুর মুঘল সৈন্য নিহত হচ্ছিলো । বৈরাম খানের পুরো বাহিনী মৃত্যু বিভীষিকায় আতঙ্কগ্রস্থ হয়ে উঠলো। আফগানদের এই তীব্র আক্রমণের মুখে শেষমেষ বৈরাম খান বাধ্য হলেন পিছু হটতে। উৎসাহী আফগান বাহিনীও এই বাহিনীকে পুরোপুরি ধসিয়ে দিতে যুদ্ধকে টেনে সামনে এগিয়ে নিয়ে এলো।
এদিকে বৈরাম খানের বাহিনীর বিপর্যয়ের কথা জানতে পারলেন সম্রাট। সাথে সাথেই তিনি শাহ আবুল মালী ও তরদী বেগের নেতৃত্বাধীন তৃতীয় বাহিনীকে পেছন থেকে আফগান সৈন্যদের ঘিরে ধরতে নির্দেশ দিলেন। কিছু বুঝে উঠার আগেই আফগান বাহিনী মুঘল সেনাবাহিনীর ঘেরাওয়ের মাঝে পড়ে গেলো।
মুহূর্তেই যুদ্ধের ফলাফল মুঘলদের দিকে ঘুরে গেলো। অবরুদ্ধ আফগান বাহিনীর ওপর ভয়াবহ আক্রমণ চালানো হলো। পরিস্থিতি বুঝে উঠার আগেই আফগানরা দলে দলে মারা পড়তে লাগলো। তারপরেও কিছুক্ষণ লড়াই চালিয়ে গেলো আফগানরা। কিন্তু শেষ রক্ষা আর হলো না। মনোবল হারিয়ে বিপুল সংখ্যক যোদ্ধার লাশ পেছনে ফেলে আফগানরা যে যেভাবে পারলো যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ করলো। সিকান্দার শাহ সুরিও যুদ্ধক্ষেত্রে ত্যাগ করলেন। তিনি পালিয়ে উত্তর পাঞ্জাবের শিবালিক পর্বতে আশ্রয় নিলেন।
সিরহিন্দের এই যুদ্ধে বিজয়ী হয়ে সম্রাট হুমায়ুন সিকান্দার খান উজবেককে দ্রুত দিল্লি অধিকার করার জন্য পাঠিয়ে দিলেন। সিকান্দার খান উজবেক বিনা বাধায় দিল্লি অধিকার করলেন। এদিকে শাহ আবুল মালীকে পাঞ্জাবের গভর্নর নিয়োজিত করা হলো। তবে তাকে জলন্ধরেই অবস্থান করতে নির্দেশ দিলেন সম্রাট। সিকান্দার শাহ সুরি যদিও পরাজিত হয়েছেন, তবে তিনি যে তার ভূখন্ড পুনরুদ্ধারের চেষ্টা চালাবেন, তা চোখ বন্ধ করেই বলে দেয়া যায়। তিনি যদি সে চেষ্টা করতে পর্বত থেকে বেরিয়ে আসেন, শাহ আবুল মালী তাকে প্রতিহত করবেন।
শাহ আবুল মালিকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিয়ে সম্রাট হুমায়ুন দ্রুত ছুটলেন দিল্লি বরাবর। সিরহিন্দ থেকে সামান হয়ে ১৫৫৫ সালের ২০ জুলাই সম্রাট সলিমগড়ে গিয়ে পৌঁছান। এর তিনদিন পরে, অর্থাৎ, ১৫৫৫ সালের ২৩ জুলাই তিনি দ্বিতীয়বারের মতো দিল্লির মসনদ অধিকার করলেন!
মুঘল সাম্রাজ্য পুনরুদ্ধারের পূর্বে সিরহিন্দের এই যুদ্ধটিই আফগান আর মুঘলদের মাঝে সংগঠিত শেষ বড় আকারের যুদ্ধ। সিরহিন্দে আফগানদের পরাজয়ের ফলে দিল্লির দরজা মুঘলদের জন্য খুলে গেলো। সম্রাট হুমায়ুন খুব সহজেই নিজেকে আবারও দিল্লির মসনদে প্রতিষ্ঠিত করে ফেললেন।
হিন্দুস্তান পুনরুদ্ধারের অভিযানে সম্রাট হুমায়ুন বাস্তবিক অর্থে ছোট সেনাবাহিনী নিয়ে খুব সহজেই আফগানদের বিশাল বিশাল বাহিনীকে পরাজিত করেছেন। তা-ও বেশ কয়েকবার। প্রশ্ন হলো, যে আফগানদের ভয়ে একদিন মুঘল সম্রাট বাধ্য হয়েছিলেন হিন্দুস্তান ছাড়তে, সেই আফগান বাহিনীর এমন কী হয়ে গেলো যে, বড় বড় সেনাবাহিনী নিয়েও মুঘলদের অগ্রযাত্রা ঠেকানো গেলো না? এর উত্তর পেতে হলে কিছুটা পেছনে তাকাতে হবে।
শের শাহের উত্থানের সময় থেকেই আফগান সেনাবাহিনী বিভিন্ন সময়ে হিন্দুস্তানের বিভিন্ন প্রান্তে দাপিয়ে বেড়াচ্ছিলো। ১৫৪০ সালে সম্রাট হুমায়ুন আফগানদের নিকট চূড়ান্তভাবে পরাজিত হওয়ার পর থেকে আফগানদের সমকক্ষ কোনো সেনাবাহিনীই হিন্দুস্তানে ছিলো না। এক হিসেবে বলা যায়, সময়টা আফগানদের জন্য স্বর্ণযুগ ছিলো। কিন্তু ভাগ্য সবসময় এক যায় না। আফগানদেরও গেলো না। মাত্র ৫ বছর হিন্দুস্তান শাসন করার পর, ১৫৪৫ সালের ২২ মে, মৃত্যুবরণ করেন শের শাহ সুরি।
শের শাহ সুরির মৃত্যুর পর সুরি সাম্রাজ্যের মসনদে বসেন তার কনিষ্ঠ পুত্র ইসলাম শাহ সুরি। অল্প কিছু ত্রুটি ছাড়া তার শাসনকাল বেশ ভালোই ছিলো। তবে ঐ ত্রুটিগুলোই বিরাট আকারে ধরা দিলো পরবর্তী শাসক আদিল শাহ সুরির শাসনামলে।
ইসলাম শাহ মারা গিয়েছিলেন ১৫৫৩ সালের ৩০ অক্টোবর। তার মৃত্যুর পর সুরি সাম্রাজ্যের মসনদে বসেছিলেন তার ১২ বছরের পুত্র ফিরোজ শাহ সুরি। তবে তার শাসনকাল স্থায়ী হয়েছিলো ৩ দিন। কাজেই কার্যত তিনি শাসনকার্য পরিচালনাই করতে পারেননি।
পরবর্তী শাসক আদিল শাহ সুরির অযোগ্যতায় বিশাল সুরি সাম্রাজ্যে ফাটল ধরে। সাম্রাজ্য ৫টি অংশে ভাগ হয়ে যায়। এবং এই ৫ অংশের শাসক প্রত্যকেই প্রত্যেকের বিরুদ্ধে এক অদ্ভুত যুদ্ধে জড়িয়ে যান। প্রত্যেকেরই ইচ্ছা, অন্য চারজনকে পরাজিত করে নিজেই বিশাল সুরি সাম্রাজ্যের সম্রাট হবেন। ফলস্বরূপ, শের শাহের মৃত্যুর অল্প কয়েক বছর পরেই সুরি সাম্রাজ্য ভুগতে থাকে গৃহযুদ্ধে।
ঐক্যই শক্তি। শের শাহের সময় আফগানরা ঐক্যবদ্ধ হয়েছিলো, তাই তারা শক্তিশালী ছিলো। কিন্তু, এই গৃহযুদ্ধ আফগানদের ঐক্যের বন্ধন ছিড়ে দিলো। ফলে আফগানদের সমস্ত শক্তি শেষ হয়ে গেলো। তার উপর সম্রাট হুমায়ুন যখন পাঞ্জাব দিয়ে আক্রমণ চালালেন, তখন সম্রাটকে প্রতিরোধ করার পুরো দায়িত্ব গিয়ে পড়লো সিকান্দার শাহ সুরির উপর। আফগানদের গৃহযুদ্ধে সিকান্দার শাহ সুরি বেশ কয়েকটি যুদ্ধে বড় ধরনের সাফল্য পেয়েছিলেন সত্য, তবে তিনি তেমন সামরিক যোগ্যতাসম্পন্ন জেনারেল ছিলেন না। তার অধীনস্থদের মাঝেও তেমন সামরিক মেধা পাওয়া যায়নি।
অন্যদিকে, সম্রাট হুমায়ুনের সামরিক যোগ্যতা ছিলো প্রশ্নাতীত। তিনি সম্রাট বাবরের নিজের হাতে গড়া ছিলেন। তবে, প্রথম রাজত্বকালে অলসতা, যথাসময়ে উপযুক্ত সিদ্ধান্ত না নেয়ার ফলে তাকে দীর্ঘদিন নির্বাসনে থাকতে হয়েছে। জীবনের এই শিক্ষাটুকুই তার মাঝে আমূল পরিবর্তন এনে দিয়েছিলো। তাছাড়া, সম্রাট হুমায়ুনের পাশে ছিলেন বৈরাম খান, তরদী বেগ, সিকান্দার খান উজবেক আর শাহ আবুল মালীর মতো যোগ্যতাসম্পন্ন বাঘা বাঘা জেনারেলরা। কাজেই নিঃসন্দেহে সিকান্দার শাহ সুরির আফগান বাহিনীর চেয়ে চেয়ে সম্রাট হুমায়ুনের মুঘল সেনাবাহিনী সামরিক যোগ্যতার দিক দিয়ে শুরু থেকেই এগিয়ে ছিলো।
সিকান্দার শাহ সুরির আরেকটি মারাত্মক ভুল ছিলো শুরুতেই মুঘলদের প্রতিরোধ না করে লাহোর আর পাঞ্জাবের বিস্তীর্ণ ভূখন্ড তাদের হাতে ছেড়ে দেয়া। তার উচিত ছিলো সিন্ধু নদের তীরেই মুঘলদের প্রতিহত করা। সিন্ধুর তীরে মুঘলদের প্রতিরোধ করলে হয়তো এত দ্রুত তার পতন হতো না।
সে যা-ই হোক, সিরহিন্দে মুঘল সেনাবাহিনী আফগানদের শোচনীয়ভাবে পরাজিত করেছে, সিকান্দার শাহ সুরির পতন হয়ে গিয়েছে আর সম্রাট হুমায়ুন লাহোর থেকে দিল্লি পর্যন্ত নিজের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিয়েছেন। হুমায়ুন নিজেকে আবারও ‘হিন্দুস্তানের সম্রাট’ হিসেবে ঘোষণা করলেন। আর এর সাথে সাথেই তার দীর্ঘ ১৫ বছরের নির্বাসিত জীবনের সমাপ্তি হলো। তবে সম্রাট জানেন, এটাই শেষ না। সামনের দিনগুলো এর চেয়েও কঠিন হবে।
আফগান শাসকদের মাঝে পতন হয়েছে মাত্র একজনের। আরও তিনজন শাসক বহাল তবিয়তেই আছেন এখনো। আদিল শাহ সুরি এখনো আগ্রা ধরে রেখেছেন। তার জেনারেল হিমু একজন যোগ্য ও বিচক্ষণ ব্যক্তি। সিকান্দার শাহ সুরিকে যেভাবে সহজেই পরাজিত করা গিয়েছে আদিল শাহকে পরাজিত করা এত সহজ হবে না। আর, ইব্রাহীম শাহ সুরি তো আদিল শাহের কাছে পরাজিত হয়ে উড়িষ্যাতেই চলে গেছেন। তিনি সম্রাটের জন্য তেমন কোনো সমস্যা না।
তবে, সম্রাট খবর পেয়েছেন বাংলায় মুহাম্মদ শাহ সুরি নিজের সামরিক সক্ষমতা বৃদ্ধি করছেন। মালবে বাজবাহাদুরও শক্ত অবস্থান নিয়ে অপেক্ষা করছেন। তারা কেউই মুঘল সাম্রাজ্যের এই ‘পুনরুত্থানকে’ সহজে মেনে নিবে না। কাজেই সম্রাটকেও প্রস্তুত থাকতে হবে।
Posted ১১:৫২ পূর্বাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ২১ মার্চ ২০১৯
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta