শুক্রবার ৩রা মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ২০শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

শিরোনাম

শুক্রবার ৩রা মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

শিরোনাম

মুসৌরির চমকপ্রদ ইতিহাস

বৃহস্পতিবার, ০৯ এপ্রিল ২০২০
582 ভিউ
মুসৌরির চমকপ্রদ ইতিহাস

কক্সবাংলা ডটকম(৯ এপ্রিল) :: বিশাল বড় দেশ ভারত। সেখানে পাহাড়ি এলাকার ছড়াছড়ি। তবে সব পাহাড়ের রানী কিন্তু একটিই, সেটি হলো মুসৌরি। ভারতের অন্যতম শৈলশহরও বটে উত্তরাখন্ডের গারওয়াল অঞ্চলে অবস্থিত মুসৌরি।

অনিন্দ্যসুন্দর বনবীথি, উত্তেজনাপূর্ণ পাহাড়-পর্বত, চমকপ্রদ জলপ্রপাত এবং বিভিন্ন সমৃ্দ্ধ উদ্ভিদকূলের জন্য প্রসিদ্ধ এই শহর। তবে বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, অপার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি এই শহরটির বয়স কিন্তু একদমই বেশি নয়। আসছে ২০২৩ সালে দুইশ বছর পূর্ণ হবে।

কিন্তু এত অল্প বয়সেই শহরটির রয়েছে দারুণ চমকপ্রদ ইতিহাস। চলুন পাঠক, এখন আপনাদের সামনে সেসব ইতিহাসেরই উন্মোচন করা যাক।

মুসৌরির মেঘাচ্ছন্ন সকাল; Image Source: Wikipedia

যেভাবে নাম হয়েছে মুসৌরি

ব্রিটিশরা আসার আগে মুসৌরিতে যাতায়াত ছিল কেবল রাখালবালকদের। তারা তাদের গবাদি পশু চরাতে নিয়ে আসত পাহাড়ি ঢালে, যেখানে পাওয়া যেত মানসুর নামক একপ্রকার গুল্ম। এবং এই মানসুর থেকেই মুসৌরি শহর পেয়েছে তার নাম। স্থানীয়দের কাছে এখনো মুসৌরির নাম হলো মানসুরি।

ব্রিটিশ দখলদারিত্ব

১৮০৩ সালে উমার সিং থাপার নেতৃত্বে গুরখারা জয় করে গারওয়াল ও দেহরা। তখন থেকেই মূলত মুসৌরির বিকাশের সূচনা। খুব স্বাভাবিকভাবেই, কয়েক বছরের মধ্যে গুরখাদের সাম্রাজ্য বিস্তারকারী নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় ব্রিটিশরা। তাই দুই পক্ষের মধ্যে লড়াই অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে। শেষমেষ ১৮১৪ সালের ১ নভেম্বর যুদ্ধ শুরু হয়। যুদ্ধের ফলস্বরূপ ১৮১৫ সালের মধ্যেই দেহরাদুন ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয় গুরখারা, আর ১৮১৯ সালে দেহরাদুনকে সাহারানপুর জেলার সাথে সংযুক্ত করে ফেলে ব্রিটিশরা।

এক আইরিশের হাত ধরে গোড়াপত্তন হয় মুসৌরির; Image Source: HolidayIQ

এক আইরিশের হাত ধরে গোড়াপত্তন

একটি পৃথক শহর হিসেবে মুসৌরির গোড়াপত্তন ঘটে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়ার আইরিশ বংশোদ্ভূত লেফটেন্যান্ট ফ্রেডরিক ইয়ংয়ের হাত ধরে। তার আরো একটি পরিচয় হলো, তিনি ১৮১৫ থেকে ১৮৪২ সাল পর্যন্ত ছিলেন সিরমুর ব্যাটালিয়নের কমান্ডিং অফিসার। পশু শিকারের লক্ষ্যে ১৮২৩ সালে, তৎকালীন দুনের জয়েন্ট ম্যাজিস্ট্রেট ও সুপারিনটেনডেন্ট এফজে শোরের সাথে মিলে মুসৌরিতে তিনি একটি ছোট কুঁড়েঘর নির্মাণ করেন। তারা শ্যুটিং বক্স হিসেবে ব্যবহার করতেন সেটিকে। তবে ঘটনাক্রমে সেটি মুসৌরির প্রথম স্থাপনাও বটে।

শিকার করতে এসে মুসৌরির প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের প্রেমে পড়ে যান ক্যাপটেন ইয়ং। তাই কয়েক বছর পর তিনি মনস্থির করলেন এখানেই নিজের একটি বাসস্থান নির্মাণ করবেন। যেই ভাবা সেই কাজ। বানিয়ে ফেলেন প্রাসাদোপম একটি বাড়ি, যার নাম দেন মুলিঙ্গার।

জনপ্রিয়তা লাভ

আধুনিক সভ্যতার প্রথম পরশ লাগে মুসৌরির গায়ে। অসাধারণ আবহাওয়া, পাশাপাশি শিকার ও খেলাধুলার উপযোগী পরিবেশের ফলে মুসৌরি আকৃষ্ট করতে থাকে ইউরোপ থেকে আসা অন্যান্য ভিনদেশীদেরও। ততদিনে গোটা দুন অঞ্চলই ভারতবর্ষজুড়ে পরিচিতি লাভ করেছে। ফলে ১৮২৭ সাল নাগাদ, মুলিঙ্গার নির্মাণেরও আগে, ব্রিটিশ সরকার সিদ্ধান্ত নেয় এখানে লান্দারের সৈন্যদের স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধারের কেন্দ্র গড়ে তোলার। ভারতীয় মহারাজাও এখানে এসে ছুটি কাটাবার উপযোগী অভিজাত বাসস্থান গড়ে তুলতে থাকেন। সব মিলিয়ে মুসৌরি শহরের অবস্থা দারুণ রমরমা হয়ে ওঠে।

মুসৌরির জর্জ এভারেস্ট পিক; Image Source: YouTube

বিখ্যাত ব্যক্তিদের আবাসস্থল

মুসৌরি শহরে বাস করতে শুরু করেন বহু স্বনামধন্য ব্যক্তিত্ব। তাদের মধ্যে সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য হলেন স্যার জর্জ এভারেস্ট, যার নামানুসারে নামকরণ হয়েছে বিশ্বের সর্বোচ্চ পর্বত মাউন্ট এভারেস্টের। ১৮৩২ থেকে ১৮৬০ সাল পর্যন্ত মুসৌরিতে বাস করেছেন তিনি। ১৮২৩ থেকে ১৮৪৩ পর্যন্ত বিশ বছর তিনি ছিলেন গ্রেট ট্রাইগোনোমেট্রিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার সুপারিনটেন্ডেন্ট ইন চার্জ। জরিপের কাজ শুরু হয়েছিল ভারতের দক্ষিণ প্রান্ত মাদ্রাস থেকে। এভারেস্ট চেয়েছিলেন সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার অফিস মুসৌরিতে স্থাপন করতে। অবশ্য তার সে চাওয়া পূরণ হয়নি। অফিসটি স্থাপিত হয়েছিল নিকটবর্তী দেহরাদুনে, যার অস্তিত্ব এখনো বিদ্যমান। মুসৌরির আরেক বিখ্যাত অধিবাসী হলেন অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান লেখক রাসকিন বন্ড। পূর্ণবয়সের অধিকাংশ সময়ই তিনি কাটিয়েছেন এই শহরে।

বিস্ময়কর হলেও সত্যি

ভাবতে অবাক লাগে, যে ক্যাপটেন ইয়ংয়ের কারণে মুসৌরি পৌঁছেছে আজকের অবস্থান, গোটা শহরে কোথাও নেই তার কোনো স্মৃতিচিহ্ন। স্থানীয় মানুষজনও যেন ভুলতে বসেছে তাকে। তার নির্মিত প্রাসাদটি আজও আছে, অথচ সেটির ব্যাপারেও যেন বিশেষ ভ্রুক্ষেপ নেই কারো!

মদ প্রস্তুতের ইতিহাস

ঔপনিবেশিক অতীতের কল্যাণে, মুসৌরির রয়েছে মদ প্রস্তুতের লম্বা ইতিহাস। স্যার হেনরি বোহলে মুসৌরিতেই গড়ে তোলেন ভারতের সর্বপ্রথম ব্রিউয়িং হাউজ ‘দ্য ওল্ড ব্রিউয়ারি’। শুরুতে কেবল বিয়ার প্রস্তুত হতো সেখানে। পরবর্তীতে পৃষ্ঠপোষকদের ব্যাপক চাহিদার সূত্র ধরে তারা হুইস্কি উৎপাদনও শুরু করে। লাইসেন্সজনিত সমস্যার কারণে দ্য ওল্ড ব্রিউয়ারি বারবার বন্ধ হতে থাকে, আবার খুলতে থাকে। এভাবে দীর্ঘদিন চলার পর, ১৮৫০ সালে স্যার জন ম্যাকিননের (বোহলের শ্যালক) হাত ধরে পুনরায় পুরোদমে কার্যক্রম শুরু হয় দ্য ওল্ড ব্রিউয়ারির। তিনি এর নতুন নাম রাখেন ‘ম্যাকিনন অ্যান্ড কোং’।

মুসৌরি লেক; Image Source: Trawell.in

মহারাজা দুলীপ সিংয়ের আগমন

১৮৫২ সালের মে মাসে মুসৌরিতে ঘটে একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। এখানে পা রাখেন পাঞ্জাবের শেষ মহারাজা দুলীপ সিং, যিনি ছিলেন মহারাজা রণজিৎ সিংয়ের পুত্র। কয়েকদিন তিনি কাটান লান্দারের ক্যাসল হিস এস্টেটে। দুইটি অ্যাংলো-শিখ যুদ্ধের পর, পাঞ্জাব তখন প্রস্তুত ছিল ব্রিটিশদের কাছে আত্মসমর্পণ করতে। দুলীপ সিংকে পাঞ্জাব রাজ্য ও তার সকল সম্পদ ভারতের গভর্নর জেনারেল লর্ড ডালহৌসির কাছে লিখে দিতে হয়েছিল। আরো ত্যাগ করতে হয়েছিল কোহিনূর হীরার মালিকানাও।

দুলীপ সিংয়ের মাকে নির্বাসনে পাঠানো হয়েছিল, আর প্রাপ্তবয়স্ক না হওয়ায় তার দায়িত্ব বর্তেছিল ডক্টর জন স্পেনার লোগিনের কাঁধে। ভারত ত্যাগের পূর্বে মুসৌরি বেড়াতে এসেছিলেন দুলীপ সিং। এরপর আবারো একবার ১৮৫৪ সালে মুসৌসি আসেন তিনি। কিন্তু ১৯৫৪ সালের ১৯ এপ্রিল তাকে ইংল্যান্ডে পাঠিয়ে দেয়া হয়, যেখানে তার বাকি জীবন নির্বাসিত অবস্থায় কাটে।

ভারতীয়রা যখন কুকুরের সমতুল্য

মুসৌরির নামের সাথে জড়িয়ে আছে আরো একটি চরম লজ্জাজনক ইতিহাসও। ব্রিটিশ শাসনামলে গোটা ভারতবর্ষজুড়েই বর্ণবাদ ও শ্রেণীবৈষম্য ছিল বটে, কিন্তু মুসৌরিতে তা যেন একটু বেশিই মাত্রা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। মুসৌরির বেশ কিছু ব্রিটিশ স্থাপনার বাইরে ইংরেজিতে লেখা হয়েছিল, “Indians and Dogs not allowed”। ভারতীয়দের জন্য এটি ছিল চরম অবমাননাকর। ভারতের অসংখ্য প্রভাবশালী রাজা-মহারাজা ও জমিদাররা মুসৌরিতে ছুটি কাটাতে এলেও, ব্রিটিশদের নির্মিত ক্লাব, হোটেল প্রভৃতিতে ঢুকতে পারতেন না তারা। ব্রিটিশদের সাথে স্থানীয়দের ব্যবধান এভাবেই স্পষ্ট হয়ে উঠত। তবে একজন ছিলেন যিনি এই ব্যবধান ঘোচানোর চেষ্টা করেছিলেন। তিনি মতিলাল নেহেরু। নেহেরু পরিবার নিয়মিতই মুসৌরিতে আসত ছুটি কাটাতে। তখন মতিলাল নেহেরু ইচ্ছা করে ব্রিটিশদের বানানো নিয়ম ভাঙতেন, আর জরিমানা গুনতেন।

কুকুর ও ভারতীয়দের প্রবেশ নিষেধ; Image Source: Uttarakhand Stories

দালাই লামার সম্পৃক্ততা

মুসৌরি জড়িয়ে আছে তিব্বত মুক্তি আন্দোলনের সাথেও। ১৯৫৯ সালে তিব্বতে গণঅভ্যুত্থানের চেষ্টা যখন চীন সেনাবাহিনী কর্তৃক নস্যাৎ হয়ে গেল, তখন চতুর্দশ দালাই লামা ভারতে পালিয়ে আসেন, এবং মুসৌরিতে ‘সেন্ট্রাল টিবেটিয়ান অ্যাডমিনিস্ট্রেশন’ গড়ে তোলেন। পরে অবশ্য সেটি ধরমশালায় স্থানান্তর করা হয়।

১৯৬০ সালে দালাই লামা ও জওহরলাল নেহেরুর মিলিত উদ্যোগে মুসৌরিতে গড়ে তোলা হয় ‘সেন্ট্রাল স্কুল ফর টিবেটান্স’-এর। এখনো এই স্কুলটির কার্যক্রম অব্যহত রয়েছে। মুসৌরি ও আশেপাশের এলাকায় এখন পাঁচ হাজারেরও বেশি তিব্বতির বাস।

প্যারাগ্লাইডিংয়ের জন্য বিখ্যাত মুসৌরি; Image Source: Travel Triangle

শেষ কথা

ব্রিটিশ শাসনামলে সিমলার হাতে যেমন আনুষ্ঠানিক ক্ষমতা ছিল (সিমলা ছিল দাপ্তরিকভাবে গ্রীষ্মকালীন রাজধানী), মুসৌরির তা ছিল না কখনোই। তারপরও নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কারণে বরাবরই ভ্রমণপিপাসু মানুষের চোখের মণি হয়ে ছিল এই শহরটি। এমনকি ভারতসহ বিশ্বের অন্য অনেক দেশের রোমান্টিক দম্পতিদের কাছে আজও এটি বিবেচিত হচ্ছে ভারতের ‘আনঅফিসিয়াল হানিমুন ক্যাপিটাল’ হিসেবে।

তবে মুসৌরি ভ্রমণের জন্য সাথে একজন ভালোবাসার মানুষ থাকা আবশ্যক নয়। যেকোনো পর্যটকের কাছেই এটি যেন এক স্বর্গভূমি। কী নেই এখানে! গান হিল, কেম্পটী জলপ্রপাত, ভট্ট জলপ্রপাত, ঝরিপানি জলপ্রপাত, মুসৌরি লেক, লেক মিস্ট, ক্লাউন্ড এন্ড, বনচেতনা কেন্দ্র, মিউনিসিপ্যাল গার্ডেন প্রভৃতি তো আছেই, আরো আছে জ্বালাজী মন্দির, নাগ দেবতা মন্দির, স্যার জর্জ এভারেস্ট হাউস আর নাথা এস্টেটও।

শুধু প্রকৃতিপ্রেমী নন, সেই সাথে আগ্রহ রয়েছে ইতিহাসেও, এমন ভ্রমণপিয়াসীদের বাকেট লিস্টে খুব সহজেই জায়গা করে নেয়ার যোগ্য মুসৌরি।

582 ভিউ

Posted ৯:১৯ অপরাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ০৯ এপ্রিল ২০২০

coxbangla.com |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

এ বিভাগের আরও খবর

Editor & Publisher

Chanchal Dash Gupta

Member : coxsbazar press club & coxsbazar journalist union (cbuj)
cell: 01558-310550 or 01736-202922
mail: chanchalcox@gmail.com
Office : coxsbazar press club building(1st floor),shaheed sharanee road,cox’sbazar municipalty
coxsbazar-4700
Bangladesh
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
বাংলাদেশের সকল পত্রিকা সাইট
Bangla Newspaper

ABOUT US :

coxbangla.com is a dedicated 24x7 news website which is published 2010 in coxbazar city. coxbangla is the news plus right and true information. Be informed be truthful are the only right way. Because you have the right. So coxbangla always offiers the latest news coxbazar, national and international news on current offers, politics, economic, entertainment, sports, health, science, defence & technology, space, history, lifestyle, tourism, food etc in Bengali.

design and development by : webnewsdesign.com