কক্সবাংলা ডটকম :: মূল্যস্ফীতির ক্রমবর্ধমান চাপে দিশাহারা হয়ে পড়েছে সাধারণ মানুষ, কঠিন হয়ে পড়েছে সংসারের হাল ধরে রাখা। খুবই জরুরি প্রয়োজন বা বিপদ-আপদের কথা ভেবে যারা দীর্ঘদিন ধরে অল্প অল্প করে হাতে কিছু টাকা জমিয়েছিলেন, সেই জমানো অর্থ ফুরিয়েছে মূল্যস্ফীতির ঘোড়া বেপরোয়াভাবে ছুটতে শুরু করার পরপরই। এখন ধারদেনা করে চলতে হচ্ছে তাদের। এ দুরবস্থা থেকে পরিত্রাণের পথ খুঁজে পাচ্ছেন না তারা।
খাদ্যপণ্যের দামই শুধু নয়, এর পাশাপাশি নিত্যপ্রয়োজনীয় অন্যান্য পণ্যের দামও বাড়ছে পাল্লা দিয়ে। মূল্যস্ফীতির জাঁতাকলে নিম্নআয়ের মানুষ তো বটেই, মধ্যবিত্তদেরও চিড়েচ্যাপটা হয়ে যাওয়ার দশা। আয়-ব্যয়ের হিসাব মেলাতে পারছেন না তারা।
আগস্টের শেষদিকে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) বৈঠক শেষে এক প্রশ্নের জবাবে পরিকল্পনামন্ত্রী বলেছিলেন, অর্থনীতির জন্য সবচেয়ে বড় দুশ্চিন্তা এখন অতিমাত্রায় মূল্যস্ফীতি। যদিও আমি মনে করি এ মাসে তা কমে আসবে। যদিও মাস শেষে হয়েছে এর উল্টোটি। আগস্টে মূল্যস্ফীতি কমেনি বরং আরও বেড়েছে।
বাংলাদেশে পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হালনাগাদ তথ্য বলছে, ২০২২ সালের আগস্ট থেকে চলতি বছরের আগস্ট পর্যন্ত অর্থাৎ এক বছর সময়কালে গ্রামাঞ্চলে খাদ্যপণ্যে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে ১২ দশমিক ৭১ শতাংশ। খাদ্যপণ্যে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ১২ দশমিক ৫৪ শতাংশ। আগের মাস জুলাইয়ে তা ছিল ৯ দশমিক ৭৬ শতাংশ। বিবিএস খাদ্যপণ্যসহ অন্যান্য পণ্য নিয়ে সার্বিক মূল্যস্ফীতি তৈরি করে থাকে।
বিবিএসের প্রতিবেদনে দেখা যায়, আগের দুই মাসে সামান্য কমার পর আগস্টে ফের ১০ শতাংশ ছুঁইছুঁই করেছে মূল্যস্ফীতি। আগস্টে দেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৯২ শতাংশ।
বিবিএস বলছে, খাদ্যপণ্যে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ১২ দশমিক ৫৪ শতাংশ। তার আগের মাস জুলাইয়ে তা ছিল ৯ দশমিক ৭৬ শতাংশ। কারও কারও ধারণা, গ্রামে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম কিছুটা কম। কিন্তু বিবিএসের সবশেষ প্রতিবেদন বলছে, তাদের এ ধারণা ভুল।
এদিকে শনিবার সরেজমিন রাজধানীর কয়েকটি বাজার ঘুরে দেখা যায়, প্রায় প্রতিটি সবজিরই চড়া দাম। প্রতি কেজি আলু দোকানভেদে বিক্রি হচ্ছে ৪৫ থেকে ৪৮ টাকায়। ঢেঁড়স প্রতি কেজি ৫০ টাকা, শিম ২০০ টাকা, টমেটো ৯০ থেকে ১০০ টাকা। প্রতি কেজি লম্বা বেগুন ৬০ টাকায় বিক্রি হলেও গোল বেগুন ৮০ টাকা কেজি। পটোল ৫০ থেকে ৫৫ টাকা কেজি। প্রতি পিস লাউ
বিক্রি হচ্ছে ৬০ থেকে ৬৫ টাকায়। পাশাপাশি মিষ্টি কুমড়া প্রতি কেজি ৪০ টাকা, গাজর প্রতি কেজি ১২০ টাকা, শসা প্রতি কেজি ৫০ টাকা আর কাঁচা মরিচ প্রতি কেজি ১৫০ থেকে ১৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এ ছাড়া কাঁচা কলা প্রতি হালি ৪০ থেকে ৫০ টাকায়, মুলা প্রতি কেজি ৫০ টাকা, ধুন্দল ৫০ টাকা, কচুরমুখি প্রতি কেজি ৬৫ থেকে ৭০ টাকা এবং কচুর লতি প্রতি কেজি ৭৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
অন্যদিকে দেশি পেঁয়াজ প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ৭৫ টাকায় আর আমদানি করা পেঁয়াজ প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ৬৫ টাকায়। এ ছাড়া প্রতি ডজন ডিম বিক্রি হচ্ছে ১৫০ টাকায়।
মূল্যবৃদ্ধির আঁচ লেগেছে ব্রয়লার মুরগিতেও। গত সপ্তাহেও ১৮০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হওয়া ব্রয়লার কেজিতে ১০ টাকা করে বেড়ে গেছে। রোস্টের মুরগি বিক্রি হচ্ছে ৩২০ থেকে ৩৩০ টাকা কেজিতে। স্বস্তি নেই মাছের বাজারেও। মাছের বাজার ঘুরে দেখা যায়, গত কয়েক সপ্তাহের ব্যবধানে প্রায় প্রতিটি মাছের দাম বেড়েছে। দাম বেড়েছে পাঙাশ ও তেলাপিয়ারও। প্রতি কেজি পাঙাশ ২১০ থেকে ২২০ টাকায় বিক্রি হলেও প্রতি কেজি তেলাপিয়া মাছ বিক্রি হচ্ছে ২৪০ টাকায়। কিছুদিন আগে ৩২০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হওয়া রুই মাছ কেজিপ্রতি ৫০ থেকে ৬০ টাকা বাড়িয়ে ৩৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
মাঝারি আকারের চিংড়ি ১০০০ থেকে ১২০০ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে। ভরা মৌসুমেও মাঝারি সাইজের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ১২০০ থেকে ১৪০০ টাকা কেজিদরে। বড় সাইজের ইলিশ কেজিপ্রতি বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার থেকে শুরু করে ২ হাজার ৮০০ টাকা পর্যন্ত, তবে ছোট সাইজের কিছু ৮০০ টাকা কেজিদরে পাওয়া যাচ্ছে। গত সপ্তাহে ৩৫০ টাকায় পাওয়া গেলেও গতকাল কেজিপ্রতি ৪০০ টাকা করে বিক্রি হচ্ছে বাটা মাছ। মিনিকেট চাল প্রতি কেজি ৬২ থেকে ৬৪ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আঠাশ চাল কেজি প্রতি ৫৪ টাকা। এক কেজি নাজিরশাইল চাল বিক্রি হচ্ছে ৬২ থেকে ৬৫ টাকায়।
ঋণের জালে জর্জরিত ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা, নিম্নবিত্তরা দিশাহারা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী কাওসার আহমেদ। স্ত্রী, দুই সন্তান নিয়ে চার সদস্যের পরিবার তার। আগে ব্যবসায় থেকে যে আয় হতো তাতে তাদের সংসার ভালোভাবে চলে যেত। মাস শেষে কিছু টাকা সঞ্চয়ও করতে পারতেন। কিন্তু বর্তমানে মূল্যস্ফীতির কষাঘাতে সেই জমানো সঞ্চয়টুকুও শেষ হয়ে গেছে। এখন ঋণ করে সংসার চালাতে হয়। একদিকে পুঁজি খেয়ে ফেলছে, অন্যদিকে ঋণের জালে জড়িয়ে পড়ছে। এমন কঠিন পরিস্থিতিতে শহরে টিকে থাকাই চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই কঠিন সময় কত দিনে শেষ হবে, সেই উত্তরও তার অজানা।
একই অবস্থা অটোরিকশা চালক মনির হোসেনের। জানতে চাইলে এই অটোরিকশাচালক মনির হোসেন বলেন, স্ত্রী, ছেলেমেয়ে নিয়ে ছয় সদস্যের সংসার তার। সারা দিন অটোরিকশা চালিয়ে তার সংসার চলে না। মাসের মধ্যেও পরিবারের সদস্যদের জন্য একটু মাংস কিনতে পারে না। ভালো জামা-কাপড়ও দিতে পারে না স্ত্রী-সন্তানদের। সারা দিনে যা আয় হয় তা থেকে মহাজনকে জমা দেওয়ার পাশাপাশি গ্যাস খরচসহ অন্যান্য খরচ মেটাতেই হিমশিম খেতে হয়। সংসারের জোগান দেওয়া তার পক্ষে কঠিন হয়ে পড়েছে। এর আগে দিনে ১ হাজার টাকা আয় হলেও সংসার ভালোভাবে চলে যেত। বর্তমানে দেড় হাজার টাকা আয় করেও সংসার চালাতে পারছেন না। এহেন দুর্বিষহ পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণ পেতে চান তিনি।
শাহজাহান আলী বেসরকারি চাকরিজীবী। তার মাসিক আয় পঁয়তাল্লিশ হাজার টাকা। রাজধানীর মিরপুর এলাকায় থাকতে মাসে তাকে বাড়ি ভাড়া গুনতে হয় পনেরো হাজার টাকা। তিনজনের পরিবারে মাসে বাজার খরচ হয় পনেরো হাজার টাকা। গ্যাস-বিদ্যুৎ এবং আনুষঙ্গিক মিলে খরচ হয় পাঁচ হাজার টাকা। সন্তানের লেখাপড়া বাবদ মাসে খরচ হয় দশ থেকে এগারো হাজার টাকা। এ ছাড়া ওষুধ, পোশাক, দাওয়াত রক্ষাসহ অন্যান্য খরচ মিলিয়ে বাড়তি প্রায় দশ হাজার টাকা মাসে খরচ হয় তার। বাড়তি এই খরচ মেটাতে হচ্ছে সঞ্চয় ভেঙে। কোনো কোনো মাসে করতে হচ্ছে ঋণ। আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি হয়ে যাচ্ছে বিধায় তিনি ভীষণ দুশ্চিন্তায় আছেন কীভাবে এ ঋণ শোধ করবেন।
জানতে চাইলে পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান বলেন, বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আছে। নিয়ন্ত্রণে না থাকলে খাদে পড়ে যেত। বাংলাদেশের অবস্থা ভালোই আছে। আমরা দেশের মানুষের খরচ করার যে সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছি। তবে গরিব মানুষের কষ্ট হচ্ছে স্বীকার করে এমএ মান্নান বলেন, গরিবের কষ্ট হচ্ছে, কিন্তু তাদের কষ্ট লাঘবে আমরা কম দামে চাল, ডাল, তেলসহ অন্যান্য পণ্য দিচ্ছি। সরকার তাদের পাশে দাঁড়িয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে যেসব উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে তাতে আগামীতে মূল্যস্ফীতি কমবে বলেও আশা করেন তিনি।
এদিকে এক অনুষ্ঠানে পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম বলেন, দেশের অভ্যন্তরীণ কারণে মূল্যস্ফীতি বাড়েনি। এটি বাইরে থেকে এসেছে। তিনি বলেন, মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশে নামতে এক বছর সময় লাগবে। চলমান মূল্যস্ফীতি দেশের অভ্যন্তরীণ কোনো কারণে ঘটেনি এবং এর হার আগের পর্যায়ে নামতে এক বছরের মতো সময় লাগবে। তবে খাদ্য মূল্যস্ফীতি দ্রুতই কমতে শুরু করবে। আগামী অক্টোবর-নভেম্বর মাসের মধ্যে খাদ্য মূল্যস্ফীতি কমতে শুরু করবে।
শামসুল আলম আরও বলেন, মূল্যস্ফীতি এখন বড় আলোচনার বিষয়। সবাই এটি নিয়ে চিন্তিত। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে নীতি সুদহার বাড়ানোসহ নানা উদ্যোগ নিয়েছে সরকার।
এদিকে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, বিশে^র অন্যান্য দেশে মূল্যস্ফীতি কমলেও বাংলাদেশে কেন বাড়ছে তা আমার বুঝে আসছে না। তবে একটি বিষয় আছেÑ মধ্যত্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য থামাতে হবে। তারা সরবরাহ সংকুচিত করে পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেয়। এ প্রবণতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইনের যথাযথ প্রয়োগ করতে হবে। পাশাপাশি তিনি এমন হুশিয়ারিও দেন যে, ব্যবসায়ীদের বেশি চাপ দিলে হিতে বিপরীত হয়, বাজার থেকে পণ্য উধাও হয়ে যায়। এ দিকেও খেয়াল রেখে সরবরাহ বাড়ানোর চেষ্টা করতে হবে সরকারকে।
দেশখ্যাত এই অর্থনীতিবিদ আরও বলেন, যেহেতু বিশ^বাজারে পণ্যের দাম কমেছে। তাই আমদানির ওপর শুল্ক কর কমাতে হবে। শুল্ক কর কমালে আমদানি খরচ কম হবে। এর ফলে মূল্যস্ফীতি কমার সম্ভাবনা থাকবে। তিনি আরও বলেন, নিম্ন আয়ের মানুষ অনেক কষ্টে আছে। মূল্যস্ফীতিতে সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত হয় প্রান্তিক জনগোষ্ঠী। কাজেই তাদের সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় নিয়ে আসতে হবে এবং সহায়তা হিসেবে তাদের জন্য বরাদ্দকৃত নিত্যপণ্য সুষ্ঠুভাবে বিতরণের পাশাপাশি কীভাবে তাদের জীবনযাত্রার মান বজায় রাখা যায়, সেই চেষ্টা করতে হবে।
কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, নিম্ন ও মধ্যবিত্তরা খুব কষ্টে আছেন। আয়-ব্যয়ের হিসাব মেলাতে পারছেন না তারা। তিনি বলেন, সরকারের উচিত হবে যারা অর্থনীতি নিয়ে কাজ করেন তাদের নিয়ে জরুরি আলোচনা করা। এর বাইরে কোনো সুযোগ নেই।
তিনি বলেন, পৃথিবীর সব দেশ কীভাবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনল সেটা দেখা দরকার। পৃথিবী চলে একদিকে আর আমরা চলি অন্যদিকে। সাধারণ মানুষের কষ্ট প্রধানমন্ত্রী বুঝলেও মন্ত্রীরা বোঝেন না।
Posted ১২:৫৩ পূর্বাহ্ণ | রবিবার, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta