কক্সবাংলা ডটকম :: বাণিজ্য ক্ষেত্রে শুরু হচ্ছে নতুন অধ্যায়। রুপিতে লেনদেনে সম্মত হয়েছে ঢাকা ও দিল্লি। মূলত নস্ট্রো অ্যাকাউন্ট খুলে হবে লেনদেন। বাংলাদেশি তিনটি ব্যাংক এরই মধ্যে ভারতীয় ব্যাংকে বৈদেশিক মুদ্রায় হিসাব খুলেছে। এ ধরনের হিসাবকে বলা হয় ‘নস্ট্রো’ হিসাব। চাহিদা পেলে ছাড় হবে অর্থ।
আপাতত ভারতীয় ব্যাংকের বাংলাদেশে এ ধরনের হিসাব খুলতে হবে না। কেননা, ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে এখন শুধু রুপিতে লেনদেন হবে।
তবে ভারতীয় মুদ্রা রুপিতে লেনদেন হলেও উন্মুক্ত থাকবে মার্কিন ডলারে বাণিজ্য। প্রশ্ন হচ্ছে, এমন উদ্যোগে লাভবান হবে কোন দেশ? ঢাকঢোল পিটিয়ে যে উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে, তার সুফল নিয়ে আছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। বলা হচ্ছে, এমন উদ্যোগে লাভবান হবে ভারত। কারণ বাণিজ্য ক্ষেত্রে এগিয়ে রয়েছে দেশটি। সে কারণে রুপির চাহিদা বাড়বে, শক্তিশালী হবে এই মুদ্রা।
নিট পোশাক রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, শুধু রুপিতেই নয়, টাকাতেও এমন লেনদেনের সুযোগ থাকা উচিত। তা না হলে একপক্ষীয় অবস্থা তৈরি হবে। দীর্ঘ মেয়াদে সুবিধা করা যাবে না।
যেভাবে লেনদেন
রুপিতে লেনদেনের বিষয়ে খোলাসা করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক। তিনি বলেন, ‘ভারতের ব্যাংকের সঙ্গে নস্ট্রো ব্যাংক অ্যাকাউন্ট করবে বাংলাদেশের ব্যাংক। যেসব পণ্য ভারতে রপ্তানি করা হয়, সেসব বিল নস্ট্রো অ্যাকাউন্টে জমা থাকবে। আমরা যখন আমদানি করব, তখন ওই অ্যাকাউন্টে যে রুপি জমা থাকবে সেখান থেকে রুপির মাধ্যম আমদানি ব্যয় পরিশোধ করা হবে।’
তিনি বলেন, ‘ইতিমধ্যে ব্যাংকগুলোকে ঋণপত্র নিষ্পত্তির অনুমতি দেয়া হয়েছে। তারা কাজও শুরু করেছে। ধারণা করা হচ্ছে, এতে আমাদের লেনদেন খরচ কমে যাবে। বলা হয়, এতদিন অন্য কোনো অনুমোদিত কারেন্সিতে লেনদেন করতে চাইলে টাকাকে সেই মুদ্রায় রূপান্তর করতে হতো। পরবর্তী সময়ে সেই কারেন্সি আবার রূপান্তর করে ভারতের রুপিতে পরিশোধ করতে হতো। এখানে সরাসরি একটি কারেন্সির মাধ্যমে পরিশোধ করার কারণে কস্ট অব বিজনেস কমে যাবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘বিভিন্ন মাল্টি কারেন্সি’র ওপর যে নির্ভরতা ছিল, সেটাও কমে আসবে। পারস্পরিক কারেন্সির ওপর নির্ভরতা বাড়বে। বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে বাণিজ্য সুবিধা এই পারস্পরিক কারেন্সির মাধ্যমে নেয়া যাবে। এ লেনদেন টাকা ও রুপির মাধ্যমে করা যাবে।
চলমান পাইলট কার্যক্রম
পাইলট কার্যক্রম হিসেবে প্রাথমিকভাবে দুই দেশের চারটি ব্যাংকের মাধ্যমে এই লেনদেন চালু হওয়ার কথা রয়েছে। সেগুলো হচ্ছে, বাংলাদেশের সোনালী ব্যাংক ও ইস্টার্ন ব্যাংক এবং ভারতের স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া ও আইসিআইসিআই।
কিন্তু নিজস্ব মুদ্রায় লেনদেনের এই উদ্যোগ এক দশক আগেই নেয়া হয়েছিল। সে সময় নানা ঝুঁকি বিবেচনায় প্রস্তাবটি বাস্তবায়নে নিরুৎসাহিত হয় দুই দেশ। বর্তমানে ভারতে প্রায় ২ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করে বাংলাদেশ। বিপরীতে দেশটি থেকে বাংলাদেশের আমদানির পরিমাণ প্রায় ১৪ বিলিয়ন ডলারের পণ্য।
বাণিজ্য ঘাটতি এবং বাংলাদেশের হাতে যেহেতু যথেষ্ট পরিমাণ রুপি নেই, এ কারণে দুই দেশের মধ্যে সর্বোচ্চ ২০০ কোটি ডলারের সমপরিমাণ রুপিতে বাণিজ্যিক লেনদেন করা সম্ভব হবে। ফলে বাংলাদেশকে আমদানি মূল্যের বাকি অংশ ডলারের আমদানি ব্যয় আগের মতোই মার্কিন ডলারে পরিশোধ করতে হবে।
কতটা টেকসই হবে এই উদ্যোগ
ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি প্রায় ১২ বিলিয়ন ডলার। তাই রুপি ও টাকার লেনদেনের প্রস্তাব তত্ত্বগতভাবে ঠিক মনে হলেও বাস্তবে লাভবান হবে ভারত। বাংলাদেশের তেমন সুবিধা থাকবে না।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ভারতে এমন অনেক পণ্য আছে, যার কাঁচামাল তাকে ডলারে অন্য দেশ থেকে আমদানি করতে হয়। ওই ধরনের পণ্য বাংলাদেশে রপ্তানি করতে গেলে রপ্তানিকারকরা বেশি দাম নির্ধারণ করতে পারে। ফলে ডলারসংকটের কারণে যে উদ্দেশ্যে ভারতীয় মুদ্রায় লেনদেনের কথা বলা হচ্ছে, সেটি দিন শেষে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের জন্য লাভজনক থাকবে কি না, সন্দেহ আছে।
এ ছাড়া একবার রুপি ও টাকায় লেনদেনে গেলে একপর্যায়ে সেটি একপক্ষীয় মুদ্রা বা রুপিভিত্তিক বিনিময় কাঠামোয় রূপ নিতে পারে। বাণিজ্যিক ঘাটতি থাকা অবস্থায় লেনদেনে গেলে ভারতের ওপর নির্ভরশীলতা বেড়ে যেতে পারে।
ব্যবসায় শঙ্কা
বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ভারতের রুপিতে লেনদেন চালু হলে বাংলাদেশের টাকার লেনদেনও প্রচলন করা উচিত। রুপির পাশাপাশি টাকাতেও যেন লেনদেন করা যায়, সে বিষয়টিও দেখতে হবে। কারণ ভারত থেকে আমদানি অনেক বেশি। সে তুলনায় রপ্তানি অনেক কম। আমদানির তুলনায় রপ্তানি ১০ ভাগের ১ ভাগ। এখানে ইনব্যালান্স রয়েছে।
তবে রুপিতে লেনদেনে চালুর ফলে কস্ট অব বিজনেস কিছুটা কমে যাবে। টাকাতে লেনদেন চালু হলে আরও সুবিধা হবে। তবে এই ব্যবসায়ী নেতা বলেন, শুধু ভারতই নয়, চায়নিজ কারেন্সি ইউয়ান মুদ্রারও এ সুযোগ দেয়া উচিত।
বিশ্লেষকরা যা বলেন
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) জ্যেষ্ঠ গবেষণা ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান বলেন, ‘ভারতের সঙ্গে আমাদের বৈদেশিক লেনদেনের বড় পার্থক্য রয়েছে। ফলে আমাদের রপ্তানি, ভারত থেকে আমদানি ও অন্যান্য যে লেনেদেন রয়েছে, সেটার সুবিধা সীমিত আকারে পাওয়া যাবে। বড় পরিসরে এটার গুরুত্ব নেই।’
অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ নূরুল আমিন বলেন, ‘যদি রুপি ও টাকা দুটোই চালু করা হতো, তাহলে সুবিধা হতো। কারণ আমদানি করা হয় ১৪ বিলিয়ন ডলার, কিন্তু রপ্তানি এক বা দুই বিলিয়ন ডলার। এখন এই দুই বিলিয়ন ডলারও যদি রুপিতে নিষ্পত্তি করা যায়, তাতে বৈদেশিক মুদ্রার ওপর চাপ কমবে। এ ছাড়া আগামীতে রপ্তানি আরও বাড়াতে পারলে তখন সুযোগ বাড়বে। সীমিত পরিসরে কিছুটা সুবিধা পাওয়া যাবে।’
বিকল্প মুদ্রায় লেনদেন চিন্তায় প্রথমে ভারত
আন্তর্জাতিক লেনদেনে ডলারের ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে রুপি ছাড়াও বিকল্প মুদ্রা নিয়ে ভাবছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ ব্যাংক ইতোমধ্যে চীনা মুদ্রায় এলসি খোলার অনুমতি দিয়েছে ব্যাংকগুলোকে। বিশেষ করে রাশিয়ার অর্থায়নে বাংলাদেশে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরি করা হচ্ছে, সেটার ঋণ চীনা মুদ্রা ইউয়ানে পরিশোধের ব্যাপারে বাংলাদেশ ও রাশিয়া সম্মত হয়েছে।
এদিকে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক লেনদেনে বিকল্প নেটওয়ার্ক ব্যবহারের সুযোগ আইনে যুক্ত করার জন্য একটি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠিয়েছে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই। লেনদেনের ক্ষেত্রে ডলার ছাড়া যেসব মুদ্রা ব্যবহারের প্রস্তাব দিয়েছে এফবিসিসিআই, তার মধ্যে রয়েছে পাউন্ড, রুপি, ইউরো, ইয়েন ও রুবল। এসব মুদ্রা ব্যবহারে ‘বিনিময় চুক্তি’ ও ‘কারেন্সি সোয়াপ’ পদ্ধতির কথাও বলা হয়েছে।
বাংলাদেশের মোট আমদানির ৪০ শতাংশই হয় চীন ও ভারত থেকে। এর মধ্যে ২৬ শতাংশ চীন এবং ১৪ শতাংশ ভারত থেকে আসে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, মোট রপ্তানির ২৬ শতাংশ এবং আমদানির সাড়ে ৩ শতাংশ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে। মোট রপ্তানির ৫৬ শতাংশ এবং আমদানির ৮ শতাংশ হয় ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে।
Posted ৯:০৯ অপরাহ্ণ | শনিবার, ০৮ জুলাই ২০২৩
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta