শুক্রবার ৩রা মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ২০শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

শিরোনাম

শুক্রবার ৩রা মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

শিরোনাম

রবীন্দ্র জীবীরা কেমন ?

মঙ্গলবার, ২১ আগস্ট ২০১৮
514 ভিউ
রবীন্দ্র জীবীরা কেমন ?

কক্সবাংলা ডটকম(২১ আগস্ট) :: পীরতন্ত্রে মুর্শিদ বিনে পরম মেলে না। ফলে, পথের চেহারাটা আর নির্বিশেষ থাকে না, স্থান-কাল-পাত্র অনুযায়ী গুরুমশায়রাই তার সন্ধান বাৎলে দেন। মহান সাহিত্যিকদেরও এই কারণে কখনো কখনো গতি অথবা দুর্গতির শিকার হতে হয়, ব্যাখ্যাকাররাই তাকে হাজির কিংবা গরহাজির করেন।

রবীন্দ্রনাথের মতো বিরাট মাপের ব্যক্তিত্বের বেলায় এই বিপদ বেড়ে অজস্রগুণ হয়েছে। শত শত প্রবন্ধে তিনি যদিও নানান বিষয়ে তার মত স্পষ্টাকারে প্রকাশ করেছেন, আধোস্পষ্টাকারে বলেছেন আরও অনেক কবিতা-গল্প-উপন্যাসে, তারপরও আধুনিক-নাগরিক-সমাজ হয়ে না উঠতে পারা আমাদের সমাজে ‘রবীন্দ্রজীবীরা’ই রবীন্দ্রনাথের ভাবমূর্তির নির্ধারক হয়ে আছেন।

ব্যাখ্যা, টীকা এবং তেড়ে আসা লাঠি সমেত তো বটেই, কখনো কখনো এই গুরুমশায়দের নিতান্তই ব্যক্তিগত রাজনৈতিক চিন্তা ও পক্ষপাত জনমানসে রবীন্দ্রনাথের অক্ষাংশ ও দ্রাঘিমাংশ নির্ধারণ করে দিয়েছে, দিচ্ছে। আমাদের দুর্বল নাগরিক সাংস্কৃতিক জীবনে রবীন্দ্রনাথ একটা বড় প্রতীক বলে রবীন্দ্রনাথ আক্রান্ত হলে প্রায়ই অসাম্প্রদায়িকতা, বাঙালি সংস্কৃতি, পরমত সহিষ্ণুতা, এমনকি জনজীবনে স্থিতিশীলতা পর্যন্ত বিপর্যস্ত বলে বোধ হয়।

এই রকম যে কোনো আক্রমণের দৃষ্টান্তে প্রতিদ্বন্দ্বী দুই শিবিরে যে বিপুল জমায়েত দেখা দেয়, তাদের বড় অংশেরই কিন্তু বাস্তব রবীন্দ্রসাহিত্য ধর্তব্য নয়, বরং তার প্রতীকটি কাদের হাতে ব্যবহৃত হতে পারছে, কারা তাকে শত্রুজ্ঞান করছে, এটিই।

রবীন্দ্রনাথ বিষয়ে অধিকাংশ বাঙালী মুসলমান আশৈশব যে অভিযোগটি শুনে আসছেন, সেটা হলো নোবেল পুরস্কারখানা আসলে নজরুলের পাওনা ছিল। সামান্য কম প্রচারিত দ্বিতীয় কাহিনীটি হলো, প্রমীলাদেবী-নজরুলের বিয়েটা একটা হিন্দুয়ানী চক্রান্ত, তাকে থামাবার কিংবা নিজেদের ধর্মশিবিরে আটকে ফেলাটা ছিল উদ্দেশ্য, এবং ইত্যাদি আরও কিছু গালগল্প।

যতই হাস্যকর ঠেকুক, সমাজের নিম্নমধ্যবিত্ত কিংবা সাংস্কৃতিকপ্রান্তে অবস্থিত জনমানসে এই অভিমতের একটা সমাজতাত্ত্বিক তাৎপর্য আছে, রবীন্দ্রনাথ কিংবা প্রমীলা দেবীর দায় তাতে একেবারেই না থাকুক। মনোবিজ্ঞান আর সমাজবিজ্ঞানের হাতিয়ার ছাড়া এই জনমনস্তত্বের গভীরে আমরা যেতে পারবো না, কিন্তু সেই বিশ্লেষণও আমাদের বিদ্যায়তনে বরাবর অনুপস্থিত দেখি।

সত্যি বলতে কি, রবীন্দ্রজীবীরাই বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক অভিজাতদের মাঝে সবচে শক্তিশালী হলেও তার রস সামান্যই চুঁইয়ে পড়েছে আমজনতার মাঝে, ফলে রবীন্দ্রজীবীতা এখানে খুবই গণ্ডীবদ্ধ। এমনকি মধ্যবিত্তের মাঝেও তা ছায়ানটকেন্দ্রিক বিচ্ছিন্ন, একাকী একটি বর্গ আকারে দিন দিন হাজির হচ্ছে। ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ, ভুলও হতে পারে, কিন্তু রবীন্দ্রনাথকে এখানকার মানুষ শ্রদ্ধা যতটা করেন, ভালো ততটা বাসেন না। অন্যদিকে নজরুলের প্রতি ভালোবাসাটা বিস্তর। অথচ মজার বিষয় হলো, নতুন প্রজন্মের কাছে উভয়েই দিন দিন আরও কম পঠিত এবং দূরের ব্যক্তিতে পরিণত হচ্ছেন।

এই পাঠ ও পাঠকের স্বতন্ত্র ভাষ্য যতটা কমছে, ততই রবীন্দ্রনাথের ওপর রবীন্দ্রজীবীদের একচেটিয়া কর্তৃত্ব বাড়ছে, কিন্তু শেষ বিচারে পাঠকের সংখ্যাহ্রাসের কারণে ঘটে যাচ্ছে সামাজিক প্রভাবের প্রকট অভাব—আর তার সুনিশ্চিত শেষ ফল হলো রবীন্দ্রজীবীদের পতন। কেউ কেউ আশঙ্কা করছেন, তা আমাদের খানিকটা অজ্ঞাতে তা ইতিমধ্যেই ঘটে গিয়েছে, কেবল আনুষ্ঠানিক ঘোষণাটা বাকি আছে। কেউ কেউ দেখতে পেয়েছেন অবক্ষয়।

দুই.

পূর্ববাংলায় রবীন্দ্রনাথের প্রতি ভালোবাসার নতুন সূচনা হলো আয়ুবী শাসনে, তারপর মুক্তিযুদ্ধে ‘আমার সোনার বাংলা’র আকাঙ্ক্ষায় তা চরমে পৌঁছেছিল। কিন্তু দেশটা যখন স্বাধীন হলো, দেশবাসী যখন ‘আমি’ আর ‘তুমি’তে বিভক্ত হলেন, তখন তোমরা কারা, আমরা কারা এই প্রশ্নটা আবারও আসলো। রবীন্দ্রজীবীদের কি মানুষ আমাদের সারিতে পেলো, না তোমাদের সারিতে দেখলো? উত্তর দিতে ভয় হয়!

রবীন্দ্রজীবীরা বরাবরই প্রকৃতিপ্রেমী। একজনের কথা স্মরণ করতে পারি, যিনি ঢাকার সড়কে সড়কে কেন বুনো আমগাছ রোপন করা হয় না, সেই নিয়ে দুঃখ করে লিখেছিলেন নব্বই দশকের শেষ দিকে। এই দেশীয় বুনো প্রজাতিগুলো তবে টিকে যেতে পারতো, পথচারী আর দরিদ্র শিশুরাও আম খেতে পেতো। চিন্তাটি বর্তমান লেখকের ভাবনাকেও আজ পর্যন্ত ব্যাকুল করে, এটা সত্যি।

এটি উদাহরণ মোটে, এমন নিসর্গ আর প্রকৃতিপ্রেমের পরিচয় রবীন্দ্রজীবীদের মাঝে আরও দেখা যাবে; রবীন্দ্রনাথ পাঠে যেমন এমন সংবেদনশীল মনের জন্ম হতে পারে, কিংবা হৃদয় এত সংবেদনশীল বলেই রবীন্দ্রনাথের সাথে এমন প্রেম সম্ভব হয়। কিন্তু পাঠক, বলুন তো, এই বাংলা বদ্বীপের সবচে বড় মানবসৃষ্ট প্রাকৃতিক বিপর্যয় কোনটি? পারছেন না! সামান্য সাহায্য করি: বলুন তো আম্রকাননেরই জন্য বিখ্যাত অঞ্চলটি মরুপ্রায়, তাপদগ্ধ হয়ে গেলো কোনো নদীর প্রবাহ অদৃশ্য হওয়ায়? ঠিক, পদ্মা নদীর কথা হচ্ছে, হচ্ছে ফারাক্কা বাঁধের কথা।

আপনার হৃদয়ে যদি এই অস্বস্তি, এই সংশয় জাগে যে, ফারাক্কা নামের এই বিপুল প্রাকৃতিক বিপর্যয় তেমন কোনো বেদনা, কোনো কষ্ট জাগায়নি রবীন্দ্রজীবীদের হিদয়ে, আপনি কি একই মানুষ থাকবেন? মনে রাখবেন, সচেতন মনে আমরা যা যা ভাবি, আমাদের অচেতন মন তারচেয়ে বহু সহস্রগুণ সক্রিয়, সমষ্টির গোপন চেতনার হিসেব নেয়াটা হবে আরও কঠিন। সমাজের যৌথমনস্ততত্ত্বে তারা গোপনে গোপনে রূঢ় বার্তা ঠিকই দিতে থাকে।

তিন.

পাঠক যুক্তি দিতেই পারেন, রাস্তার টোকাইদের নিয়ে, বুনো আম গাছ নিয়ে ভেবেছেন বলেই তাকে ফারাক্কার রাজনীতি নিয়ে বলতেই হবে কেনো? সেক্ষেত্রে আপনাকে শ্রদ্ধা পাঠক, আপনি সৌন্দর্যপিপাসু, রবীন্দ্রসাহিত্যের সমঝদার। আপনাকে সালাম জানিয়েই আমাদের আলাপটা আরেকটু আগাবার স্বার্থে বলি, পাঠক, রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং এই ‘সাহিত্যিক সমঝদারিত্বে’র চাইতে বেশ অনেকটা বেশি কিছু। টোকাই শিশুটি কেনো পথেরই বাসিন্দা, সেই অনুসন্ধানে তো রবীন্দ্রনাথ কখনো আপত্তি করেননি, সম্পদের নিষ্ঠুর বণ্টন নিয়ে বহুবার তিনি বলেছেন, রক্তকরবী তো তার উৎকৃষ্ট নিদর্শন। ফলে ওই ‘বেশিকিছুটার’ খানিকটা সন্ধানে যাদের আগ্রহ, সেই গুটিকতককে সাথী করেই আমরা আরেকটু আগাতে পারি। সৌন্দর্যপিপাসাও উচ্চতর সত্যের সন্ধানে প্রথম বাধা হয়ে আসতে পারে, তাই তো  ৯০০ বছর আগে ফরিদ উদ্দীন আত্তার লিখেছিলেন তার ‘পাখীদের সভা’য়:

“প্রথমে যে পাখিটি এ অভিযাত্রা থেকে ফিরে যেতে চাইল সে হল বুলবুল। গোলাপের প্রেমে মাতোয়ারা বুলবুল তার মধুর সুরে বিভোর থাকে। সে বলল, ‘আমিতো গোলাপের প্রেমসাগরে হাবুডুবু খাচ্ছি দিবানিশি। আমার কোনো নিজস্ব অস্তিত্বই আজ আর বাকি নেই। আমার মতো এক খুদে পাখি কি করে সি-মোরগের মতো শাহী দরবার ও চেহারার আলো বরদাশত করতে পারে? আমার জন্য গোলাপের প্রেমই যথেষ্ট” (ফার্সী থেকে সারানুবাদ: মোহাম্মদ ফরিদ উদ্দিন খান, ৪ নভেম্বর, ২০১৬, দৈনিক যুগান্তর)

রবীন্দ্রনাথ নিজে বাঁধ নিয়ে, বাঁধের রাজনীতি নিয়ে বিশদে ভেবেছিলেন, রবীন্দ্রজীবীরা যা নিয়ে ভাবতে গররাজি। ‘মুক্তধারা’ নামে তার এই নাটকটির প্রেক্ষাপট অবশ্য ভিন্ন, রাজনীতির পথ বিষয়ে, ভারতবর্ষের মুক্তির সাধনা বিষয়ে কংগ্রেসের সাথে তার মতপার্থক্য প্রকাশে এই নাটকটি রচিত হয়, প্রায় একশত বছর আগে বাংলা ১৩২৮ সালে। নাটকটির পাঠে আত্মমুক্তির সাধনার খুঁটিনাটি বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের সাথে ভিন্নমত আপনারও হয়তো ঘটবে, হয়তো আপনি যে রাজনীতিবিদদের বিরোধিতায় এই সাহিত্যকর্মটি রচিত, তাদের সাথেই একমত হবেন। কিন্তু এগুলো আজকের আলোচনায় তুচ্ছ খুঁটিনাটি, নাটকটির প্রেক্ষাপটটা আপনাকে চমকে না দিয়ে পারে না! মনে হবে গঙ্গা বা তিস্তা নদীর ওপর বাঁধ দিয়ে প্রতিবেশীকে বঞ্চিত করা, তাকে করায়ত্ত রাখার রাজনীতি নিয়েই রবীন্দ্রনাথ আলাপ করেছেন, মনে হবে তিনি ভবিষ্যত দ্রষ্টা:

“পথিক। আকাশে ওটা কী গড়ে তুলেছে? দেখতে ভয় লাগে।

নাগরিক। জান না? বিদেশী বুঝি? ওটা যন্ত্র।

পথিক। কিসের যন্ত্র?

নাগরিক। আমাদের যন্ত্ররাজ বিভূতি পঁচিশ বছর ধরে যেটা তৈরি করছিল, সেটা ওই তো শেষ হয়েছে, তাই আজ উৎসব।

পথিক। যন্ত্রের কাজটা কী?

নাগরিক। মুক্তধারা ঝরনাকে বেঁধেছে।

পথিক। বাবা রে। ওটাকে অসুরের মাথার মতো দেখাচ্ছে, মাংস নেই, চোয়াল ঝোলা। তোমাদের উত্তরকূটের শিয়রের কাছে অমন হাঁ করে দাঁড়িয়ে; দিনরাত্তির দেখতে দেখতে তোমাদের প্রাণপুরুষ যে শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাবে।

নাগরিক। আমাদের প্রাণপুরুষ মজবুত আছে, ভাবনা করো না।

পথিক। তা হতে পারে, কিন্তু ওটা অমনতরো সূর্যতারার সামনে মেলে রাখবার জিনিস নয়, ঢাকা দিতে পারলেই ভালো হত। দেখতে পাচ্ছ না যেন দিনরাত্তির সমস্ত আকাশকে রাগিয়ে দিচ্ছে?

নাগরিক। আজ ভৈরবের আরতি দেখতে যাবে না?

পথিক। দেখব বলেই বেরিয়েছিলুম। প্রতিবৎসরই তো এই সময় আসি, কিন্তু মন্দিরের উপরের আকাশে কখনো এমনতরো বাধা দেখি নি। হঠাৎ ঐটের দিকে তাকিয়ে আজ আমার গা শিউরে উঠল—ও যে অমন করে মন্দিরের মাথা ছাড়িয়ে গেল এটা যেন স্পর্ধার মতো দেখাচ্ছে। দিয়ে আসি নৈবেদ্য, কিন্তু মন প্রসন্ন হচ্ছে না।”

বিদেশী পথিকের সামনে নাগরিকের এই স্পর্ধাটাটুকু কি খেয়াল করেছেন, পাঠক? সেই যে সে দাবি করছে, তাদের প্রাণপুরুষ যথেষ্ট মজবুত? সত্যই খুব মজবুত না হলে এই জলআটকাবার রাজনীতি প্রাণের পরে অষ্টপ্রহর সুইয়েরই মতো বেধবার কথা। হ্যাঁ, জল আটকাবার রাজনীতি নিয়েও বলেছেন রবীন্দ্রনাথ:

“দূত। শিবতরাইয়ের প্রজারা এখন এ খবর জানে না। তারা বিশ্বাস করতেই পারে না যে, দেবতা তাদের যে জল দিয়েছেন কোনো মানুষ তা বন্ধ করতে পারে।

বিভূতি। দেবতা তাদের কেবল জলই দিয়েছেন, আমাকে দিয়েছেন জলকে বাঁধবার শক্তি।

দূত। তারা নিশ্চিন্ত আছে, জানে না আর সপ্তাহ পরেই তাদের চাষের খেত—

বিভূতি। চাষের খেতের কথা কী বলছ?

দূত। সেই খেত শুকিয়ে মারাই কি তোমার বাঁধ বাঁধার উদ্দেশ্য ছিল না?

বিভূতি। বালি-পাথর-জলের ষড়যন্ত্র ভেদ করে মানুষের বুদ্ধি হবে জয়ী এই ছিল উদ্দেশ্য। কোন্‌ চাষির কোন্‌ ভুট্টার খেত মারা যাবে সে-কথা ভাববার সময় ছিল না।

দূত। যুবরাজ জিজ্ঞাসা করছেন এখনো কি ভাববার সময় হয়নি?

বিভূতি। না, আমি যন্ত্রশক্তির মহিমার কথা ভাবছি।

দূত। ক্ষুধিতের কান্না তোমার সে ভাবনা ভাঙাতে পারবে না?

বিভূতি। না। জলের বেগে আমার বাঁধ ভাঙে না, কান্নার জোরে আমার যন্ত্র টলে না।

দূত। অভিশাপের ভয় নেই তোমার? ”

এই তো মুক্তধারায় বাঁধ দেয়া রাষ্ট্র উত্তরকূট আর তার উজানে থাকা শিবতরাইয়ের কাহিনীতে কেমন যেন বাংলাদেশ-ভারতের সম্পর্ক, পানিদস্যুতারই আগাম ইঙ্গিত। এমনকি যে প্রাণরোধী যন্ত্রসভ্যতার পুজার মনোবৃত্তির আগাম অনুসন্ধান এইখানে রবীন্দ্রনাথ করছেন, তা হুবহু মিলে গেলো, ১৯৬৫ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নেহেরু বাঁধ উদ্বোধন করতে গিয়ে বলেছিলেন, বাঁধ হলো আধুনিক ভারতের মন্দির! এই কথার মধ্য দিয়ে নেহেরু আধুনিক ভারতের যন্ত্রসাধনার কথাই তুলেছিলেন।

জনপ্রিয় রাজনীতিতে যা ঘটে, পরকে দমন আর নিজের জয়কে ঐশ্বরিক মহিমা প্রদান, জাতীয়তাবাদের আশ্রয় গ্রহণ। মুক্তধারা নাটকেও তার ব্যত্যয় নেই:

“বিশ্বজিৎ। কী নিয়ে মহোৎসব? বিশ্বের সকল তৃষিতের জন্য দেবদেবের কমণ্ডলু যে জলধারা ঢেলে দিচ্ছেন সেই মুক্ত জলকে তোমরা বন্ধ করলে কেন?

রণজিৎ। শত্রুদমনের জন্যে।

বিশ্বজিৎ। মহাদেবকে শত্রু করতে ভয় নেই?

রণজিৎ। যিনি উত্তরকূটের পুরদেবতা, আমাদের জয়ে তাঁরই জয় । সেইজন্যেই আমাদের পক্ষ নিয়ে তিনি তাঁর নিজের দান ফিরিয়ে নিয়েছেন। তৃষ্ণার শূলে শিবতরাইকে বিদ্ধ করে তাকে তিনি উত্তরকূটের সিংহাসনের তলায় ফেলে দিয়ে যাবেন।

বিশ্বজিৎ। তবে তোমাদের পূজা পূজাই নয়, বেতন।”

এর পেছনের জাতীয়তাবাদী প্রচারণার যে যাগযজ্ঞ চলে, চলে শিক্ষাপ্রদান, তার নমুনা দেখুন, চিনতে পারেন কি না:

“রণজিৎ। তোমরা কোথায় যাচ্ছ?

গুরু। আমাদের যন্ত্ররাজ বিভূতিকে মহারাজ শিরোপা দেবেন তাই ছেলেদের নিয়ে যাচ্ছি আনন্দ করতে। যাতে উত্তরকূটের গৌরবে এরা শিশুকাল হতেই গৌরব করতে শেখে তার কোনো উপলক্ষ্যই বাদ দিতে চাই নে।

রণজিৎ। বিভূতি কী করেছে এরা সবাই জানে তো?

ছেলেরা। (লাফাইয়া হাততালি দিয়া) জানি, শিবতরাইয়ের খাবার জল বন্ধ করে দিয়েছেন।

রণজিৎ। কেন দিয়েছেন?

ছেলেরা। (উৎসাহে) ওদের জব্দ করার জন্যে।

রণজিৎ। কেন জব্দ করা?

ছেলেরা। ওরা যে খারাপ লোক।

রণজিৎ। কেন খারাপ?

ছেলেরা। ওরা খুব খারাপ, ভয়ানক খারাপ, সবাই জানে।

রণজিৎ । কেন খারাপ তা জান না?

গুরু। জানে বৈকি, মহারাজ। কী রে, তোরা পড়িস নি— বইয়ে পড়িস নি— ওদের ধর্ম খুব খারাপ—

ছেলেরা। হাঁ, হাঁ, ওদের ধর্ম খুব খারাপ।

গুরু। আর ওরা আমাদের মতো—কী বল্‌-না—(নাক দেখাইয়া)

ছেলেরা। নাক উঁচু নয়।

গুরু। আচ্ছা, আমাদের গণাচার্য কী প্রমাণ করে দিয়েছেন—নাক উঁচু থাকলে কী হয়?

ছেলেরা। খুব বড়ো জাত হয়।

গুরু। তারা কী করে? বল্‌-না—পৃথিবীতে—বল্‌—তারাই সকলের উপর জয়ী হয়, না?

ছেলেরা। হাঁ, জয়ী হয়।

গুরু। উত্তরকূটের মানুষ কোনোদিন যুদ্ধে হেরেছে জানিস?

ছেলেরা। কোনোদিনই না।

গুরু। আমাদের পিতামহ-মহারাজ প্রাগ্‌জিৎ দুশো তিরেনব্বই জন সৈন্য নিয়ে একত্রিশ হাজার সাড়ে সাতশো দক্ষিণী বর্বরদের হটিয়ে দিয়েছিলেন না?

ছেলেরা। হাঁ, দিয়েছিলেন।

গুরু। নিশ্চয়ই জানবেন, মহারাজ, উত্তরকূটের বাইরে যে হতভাগারা মাতৃগর্ভে জন্মায়, একদিন এই-সব ছেলেরাই তাদের বিভীষিকা হয়ে উঠবে। এ যদি না হয় তবে আমি মিথ্যে গুরু। কতবড়ো দায়িত্ব যে আমাদের সে আমি একদণ্ডও ভুলি নে। আমরাই তো মানুষ তৈরি করে দিই, আপনার অমাত্যরা তাঁদের নিয়ে ব্যবহার করেন। অথচ তাঁরাই বা কী পান আর আমরাই বা কী পাই তুলনা করে দেখবেন।

মন্ত্রী। কিন্তু ওই ছাত্ররাই যে তোমাদের পুরস্কার।

গুরু। বড়ো সুন্দর বলেছেন, মন্ত্রীমশায়, ছাত্ররাই আমাদের পুরস্কার। আহা, কিন্তু খাদ্যসামগ্রী বড়ো দুর্মূল্য—এই দেখেন-না কেন, গব্যঘৃত, যেটা ছিল—”

এই গব্যঘৃতটাই উগ্রজাতীয়তাবাদী অহম আর পরকে দংশনের মনস্তত্ব তৈরির সারকথা; এই গব্যঘৃতই শিক্ষক, চিকিৎসক, পুরোহিত, সংবাদকর্মী, বুদ্ধিজীবী সকলকে রাষ্ট্রের চাকাতে বেঁধে ফেলে। কিন্তু বাংলাদেশের পরিণতি আরও হয়তো মর্মান্তিক, এই ক্ষেত্রে পিপাসার জলের প্রবাহটুকু বন্ধ হলেও উত্তরকূটের পক্ষ থেকে শিবতরাই নামের দেশে সংস্কৃতিজীবীদের প্রতি গব্যঘৃতের প্রবাহটা সম্প্রসারিত হয়েছে।

এতটা হয়তো রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং কল্পনা করতে পারেননি, রবীন্দ্রজীবীরা তার কল্পনার সীমা অতিক্রম করেছেন। ওদিকে রবীন্দ্রনাথ কিন্তু পর্যুদস্ত শিবতরাইয়ের লোকেরা নিজেরাও উত্তরকূটের মানুষদের সম্পর্কে কী কী ভাবে, তাদেরকে কতটা অপবিত্র জ্ঞান করে, তারও চিত্র আঁকতে কসুর করেননি। বাংলাদেশ-ভারতের পারস্পরিক জনমানসের, সাম্প্রদায়িকতার মুখচ্ছবি যেন সেই ছবি।

চার.

রবীন্দ্রনাথ বিষয়ে সাম্প্রদায়িকতার ‘সাম্প্রদায়িক নালিশ’গুলো নিয়েও বিস্তারিত আলাপ করা যেতো, স্থানস্বল্পতায় সংক্ষেপে কিছু বলি। রবীন্দ্রজীবীরা আশ্চর্য একটা গাণিতিক নিয়মে সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে রবীন্দ্রনাথের আলাপগুলো বাজারে তোলেন না বলেই রবীন্দ্রনাথকে সাম্প্রদায়িক হিসেবে প্রদর্শন করার ডানপন্থী প্রচারণাগুলো এখানে বাজার পায়। তবে আজকে রবীন্দ্রজীবীদের নিয়ে এই আলাপে মুসলিম ডানপন্থি প্রচারণা নিয়ে কথা কইতে চাই না, বরং এই গোপন করায় রবীন্দ্রজীবীদের স্বার্থটা কি সেই ইঙ্গিতই সামান্য দিতে চাই।

বাংলাভাষার প্রচলিত ইতিহাস চর্চায় শিক্ষিত মুসলমান সমাজকে একটা চিরকালের অপরাধবোধে আক্রান্ত রাখা হয়েছে, সেটা দেশভাগ সংক্রান্ত। সেটা সাম্প্রদায়িকতার প্রাবাল্য সংক্রান্ত। সেটা কংগ্রেসী রাজনীতিতে মুসলমানদের যুক্ত হতে না চাওয়ার মানসিকতা সংক্রান্ত। আমাদের রবীন্দ্রজীবীরা ইতিহাসের এই জনপ্রিয় হিন্দু ডানপন্থী প্রচারণার বড় খদ্দের।  সেটা তাদের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-জাতীয়তাবাদী আদর্শের সাথে সঙ্গতিপূর্ণও বটে।

এই কারণেই গোটা কয়েক বই মিলবে দেশভাগের ইতিহাসের ভিন্ন অথচ সবল পাঠ সম্বলিত, যাদের মাঝে উল্লেখযোগ্য হলো বদরুদ্দীন উমর এর ‘বঙ্গভঙ্গ ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতি’, জয়া চট্টপাধ্যায়ের ‘বাংলা ভাগ হলো’। রবীন্দ্রজীবীদের ইতিহাসবোধের বিপরীতক্রমে রবীন্দ্রসাহিত্য ঘেটে বারংবার উলটো এই আশ্চর্য নির্দশনটিই মিলবে যে, কৃষক আর প্রজারূপী বাঙালি মুসলমানকে তিনি জমিদার ও অভিজাত শ্রেণির—যাদের বড় অংশটই হিন্দু সম্প্রদায়ভুক্ত—শোষণ আর অপমানের শিকার হিসেবেই বারংবার দেখিয়েছেন।

কংগ্রেসী হিন্দু রাজনীতিতে তাদের যুক্ত না হবার আদিকারণকে রবীন্দ্রনাথই বলা যায় প্রথম উদ্‌ঘাটন করেছেন। আজকের রবীন্দ্রজীবীরা হাওরের বিষক্রিয়ার সম্ভাবনায় চোখ বন্ধ করে সৌন্দর্য সাধনা করে নিজেদের জনবিচ্ছিন্ন অভিজাত বানিয়েছেন, রবীন্দ্রনাথকেও সেই পতনের শিকারে পরিণত করছেন। রবীন্দ্রনাথ কিন্তু সমকালীন প্রতিটি প্রশ্নে কণ্ঠ তুলেছেন, নিজেকে সর্বদা ‘তোমাদেরই লোক’ বানাতে চেয়েছেন। গান্ধীকে তিনি ‘অন্ধকারের শক্তি’ ঘোষণা করে নিজের সাথে তার পার্থক্য নির্দেশ করেছেন, বিহারের ভূমিকম্পের জাগতিক কারণই গ্রহণ করেছেন

পাঁচ.

কেউ যদি রসিকতা করেও বলেন: ‘সংস্কৃতিজীবীরা পরের বাড়িতে নেমন্তন্ন খাবার লোভে দেশবাসীর অন্নসংস্থানের বিপর্যয় বেমালুম চেপে গেলেন, এবং যাচ্ছেন’ তাকে কতটা দোষারোপ করবেন আপনি? বাংলাদেশ তাই সেই বিয়োগান্তক পরিণতির দেশ, যেখানে তারটা খেয়ে তারটা পরে পরের গীত গাওয়া সাহিত্যিকরা অঢেল। এই সুপ্রাচীন তিস্তা অববাহিকা, পদ্মা অববাহিকার শুকিয়ে কাঠ হবার, বিবর্ণ হবার ব্যথা কে প্রকাশ করবে?

বলেছিলাম, মুক্তিযুদ্ধের সময়ে আমার সোনার বাংলা গাইতে গাইতেই রবীন্দ্রনাথের প্রতি প্রেম চূড়ান্ত হয়েছিল। কোনো প্রেমই চিরকাল চরম দশায় থাকে না, সেটা স্বাভাবিকত্বের লক্ষণ নয়। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের যে স্বাভাবিক ভালোবাসাটুকু পাওনা ছিল, তার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ালেন রবীন্দ্রজীবীরা, যদিও তারাও একটি আর্থ-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক দশার ফলমাত্র।

প্রকৃত রবীন্দ্রনাথকে এরা গোপন করে নিজেদের মতো করে বাজারে চালিয়েছেন, এবং তাদের নিজস্ব সক্রিয়তা ও সুনির্বাচিত ক্ষেত্রে নিষ্ক্রিয়তা রবীন্দ্রনাথের সূর্যকে অনেকখানিই ধুলোয় ধূসর করেছে। রবীন্দ্রআলোচনা এখন পর্যবসিত হয়েছে বিমূর্ত অস্পষ্ট বাস্তবতাহীন আত্মসাধনায়। “তোমার পথ ঢাইকাছে গুরুতে মুর্শিদে”। লাঠি হাতে তেড়ে আসা এই গুরুমশায়রাই রবীন্দ্রনাথে সাথে মানুষের চেতনার মিলনে বড় বাধা।

সুদূরের পিয়াসী রবীন্দ্রনাথে সাহিত্যিক-কল্পনা বাঁধের, মানুষের ওপর যন্ত্রের প্রাবল্যের পতন দেখেছিলো, সেই স্বপ্ন দুই পাড়েরই হৃদয়বান মানুষের মাঝে নিশ্চয়ই একদিন জেগে উঠবে রাজনীতির নিয়মে।

রবীন্দ্রজীবীদের এড়িয়েই হযতো মানুষ রবীন্দ্রনাথকে ভালোবাসতে শিখবে মানুষের হস্তক্ষেপে প্রতিবেশগত মহাবিপর্যয় বিষয়ক পৃথিবীর অন্যতম প্রথম সাহিত্যটির জনক হিসেবেও, ভালোবাসতে শিখবে পিপাসার জল আটকে কারবালা প্রান্তরের রাজনৈতিক মঞ্চস্থকরণের আগাম প্রতিবাদকারীটিকে, ভালোবেসে বহুবার গাইবে যন্ত্রের শ্রেষ্ঠত্বের বিরুদ্ধে লেখা এই অসাধারণ সঙ্গীতটি : ‘আমি মারের সাগর পাড়ি দেবো বিষম ঝড়ের বায়ে আমার ভয়হারা এই নায়’ এই পথ রবীন্দ্রনাথই আমাদের দেখিয়েছেন।

তিনি আমাদের চান। আমাদের শুধু অভয় মনে তরী ছাড়তে হবে… এই বিপর্যস্ত দুঃখদিনের রক্তকমলটিকে রক্ষা করতেই হবে ছায়া-বটের ছায়ে পৌঁছে দিতে।

514 ভিউ

Posted ৬:০৮ অপরাহ্ণ | মঙ্গলবার, ২১ আগস্ট ২০১৮

coxbangla.com |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

এ বিভাগের আরও খবর

Editor & Publisher

Chanchal Dash Gupta

Member : coxsbazar press club & coxsbazar journalist union (cbuj)
cell: 01558-310550 or 01736-202922
mail: chanchalcox@gmail.com
Office : coxsbazar press club building(1st floor),shaheed sharanee road,cox’sbazar municipalty
coxsbazar-4700
Bangladesh
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
বাংলাদেশের সকল পত্রিকা সাইট
Bangla Newspaper

ABOUT US :

coxbangla.com is a dedicated 24x7 news website which is published 2010 in coxbazar city. coxbangla is the news plus right and true information. Be informed be truthful are the only right way. Because you have the right. So coxbangla always offiers the latest news coxbazar, national and international news on current offers, politics, economic, entertainment, sports, health, science, defence & technology, space, history, lifestyle, tourism, food etc in Bengali.

design and development by : webnewsdesign.com