কক্সবাংলা ডটকম(৪ জুন) :: বহু বছর ধরে রোহিঙ্গারা নিজ দেশ থেকে তাদের সর্বস্ব হারিয়ে দলে দলে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিয়ে চলেছে। যা এ যাবৎকালে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী অন্তত ১০ লাখে দাঁড়িয়েছে। খুচরা আসার সমাপ্তি এখনো ঘটেনি। এই রোহিঙ্গাদের মধ্যে শতকরা কমপক্ষে ৯০ ভাগই ধর্ম বিশ্বাসের দিক থেকে মুসলিম। বাদবাকি ১০ ভাগ বা তার কিছু কম হিন্দু। যদিও তারা পত্রপত্রিকায় তেমন একটা স্থান পায়নি।
যা হোক এই ১০ লাখের ওপরে আরো ২/৩ লাখ এসেছে অতীতে। তারা চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম, কক্সবাজারসহ পূর্ব ও পূর্ব-দক্ষিণ সীমান্তজুড়ে নিজ নিজ আবাস, ব্যবসা-বাণিজ্য প্রভৃতিও গড়ে তুলে বসবাস করে আসছে। রোহিঙ্গারা অত্যাচারিত নির্যাতিত হয়ে আসছে বার্মায় (বর্তমান মিয়ানমার) নিষ্ঠুর সামরিক সরকারের সামরিক বাহিনীর সদস্যদের দ্বারা এবং অনেকদিন ধরে।
আমাদের অনেকের হয়তোবা এ কথা জানা নেই যে এই দেশত্যাগী রোহিঙ্গারা একদা বার্মায় (মিয়ানমারের) নাগরিক হিসেবে সরকারিভাবেই স্বীকৃত ছিল। কিন্তু বেশ কিছুকাল হলো তারা আর ওই দেশের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃত নয় কারণ তাদের নাগরিকত্ব সরকারিভাবেই বাতিল করা হয়েছে। আমার বিবেচনায় যত প্রকার নির্যাতনই তাদের বিরুদ্ধে আমরা প্রত্যক্ষ করি না কেন যেমন খুন, লুটপাট, বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ, নারী নির্যাতন, নারী ধর্ষণ প্রভৃতি তার চাইতেও নিষ্ঠুর এবং ভয়াবহ নির্যাতন হলো নাগরিকত্ব হরণ।
যেন একেবারে শেকড় উপড়ে ফেলা। পুরোপরি একই রকমের না হলেও অনুরূপ নির্যাতন সইতে হয়েছিল পাকিস্তানি হিন্দুদের যখন ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের উছিলায় পাকিস্তানের তৎকালীন সামরিক সরকার (জেনারেল আইয়ুব) সমগ্র পাকিস্তানে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে তার আওতায় পাকিস্তানের সব প্রদেশের হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানদের সম্পত্তিকে ‘শত্রু সম্পত্তি’ হিসাবে বিবেচনা করে শত্রু সম্পত্তি আইন জারির সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তানের সব অমুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষগুলোকে কার্যত শত্রু হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল।
আইনের বিধান যদিও এমন ছিল যে, যারাই পাকিস্তানের বাইরে বিদেশে অবস্থান করছে তারাই ওই বর্বর আইনের আওতায় পড়বে কিন্তু প্রকৃত প্রস্তাবে দেখা গেল, শুধু ভারতে সাময়িকভাবে থাকা (যেমন পর্যটন, আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে সাময়িকভাবে সাক্ষাতের জন্য, চিকিৎসা বা লেখাপড়ার বা নানাবিধ কাজের জন্যও যারা ওই সময়ে বিদেশে সাময়িকভাবেও অবস্থান (অর্থাৎ ভারতে অবস্থান) করছিলেন, ধর্মীয় সংখ্যালঘু হলেই দেশে থাকা তাদের সম্পত্তি শত্রু সম্পত্তিতে পরিণত করা হয়। শুধু তাই না, দেশে অবস্থানকারী বহু ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুর সম্পত্তিকেও অনুরূপভাবে শত্রু সম্পত্তি বলে ঘোষণা দিয়ে গেজেট প্রকাশ করা হয়। যদিও ওই আইনেও তা বেআইনি বলে বিবেচিত হওয়ার কথা ছিল।
তবে হ্যাঁ, যারা এ দেশে বসবাস করছেন তাদের বাংলাদেশি নাগরিকত্ব তদাপি অস্বীকৃত হয়নি। যেমনটি মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের ক্ষেত্রে ঘটেছে। আজকের বিশে^ এমন ঘটনা কল্পনা করাও দুরূহ। বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গারা অনেকেই ইতোমধ্যে বাংলাদেশের পূর্ব, দক্ষিণাঞ্চলীয় জেলাগুলোতে দিব্যি জমি, বাড়ি, কিনে, ব্যবসা-বাণিজ্য ফেঁদে বসেছেন, নানা কৌশলে তারা এ দেশের নাগরিকত্ব নিয়েও ফেলেছেন এবং বাংলাদেশিদের সঙ্গে দিব্যি বৈবাহিক সম্পর্কও স্থাপন পর্যন্ত করেছেন।
প্রশ্ন স্বভাবতই উঠতে পারে এবং ওঠা অত্যন্ত স্বাভাবিক যে মিয়ানমার থেকে সহায় সম্বলহীন অবস্থায় সবকিছু হারিয়ে রিক্ত হস্তে বাংলাদেশে এসে কোনো জাদুবলে বিদেশের মাটিতে বসে এমন বিত্তশালী হয়ে ওঠা তাদের পক্ষে সম্ভব হলো? এ বিষয়টি সামগ্রিকভাবেই খতিয়ে দেখা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ করণীয় কারণ কোনোক্রমেই মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে কোনো বিত্তহীনের পক্ষেই এত বিশাল বিশাল সম্পদের মালিক হয়ে ওঠা সম্ভব নয়। সৎপথে তো নয়ই।
এই রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশি নাগরিকত্ব ও পাসপোর্ট প্রাপ্তি বিস্ময়কর। অর্থাৎ আমলা ও দালালদের দ্বারা ঘটানো বলে সন্দেহ। তারও যথাযথ তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। বস্তুত প্রায় ২৫ বা ৩০ বছর আগে জামায়াতি এক পরিকল্পনার কথা শুনেছিলাম। পাকিস্তানের সহযোগিতায় বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলের কয়েকটি সীমান্ত জেলা ও মিয়ানমারের মুসলিম অধ্যুষিত আরাকান অঞ্চল মিলে একটি পৃথক ইসলামী রাষ্ট্র গঠন ছিল ওই পরিকল্পনাধীন বিষয়। তখন বাংলাদেশে পাকিস্তানের হাইকমিশনার এবং ওই হাইকমিশন কার্যালয়ের কিছু কর্মকর্তাকে নিয়মিত রোহিঙ্গা বসতিগুলোতে দেখা যেত প্রায়ই।
কক্সবাজার পরিদর্শনের নামে জামায়াতে ইসলামী ওই এলাকার রোহিঙ্গা বসতিগুলোতে অত্যন্ত সক্রিয় ভূমিকা পালন করে দলীয় সংগঠনকে প্রসারিত করা শুরু করে এবং সে কাজটি আজো অব্যাহত। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর অর্থাৎ আওয়ামী লীগ পুনরায় ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকে ওই এলাকায় পাকিস্তানি আনাগোনা হ্রাস পেতে থাকলেও বৈধতার সুযোগে নীরবে জামায়াতে ইসলামী তাদের সংগঠন বিস্তারের কাজ থেকে বিরত হয়নি। সংসদীয় নির্বাচনগুলোতে ভোটের হিসাবেও তার প্রমাণ ওই এলাকাগুলোতে পাওয়া যায়।
যা হোক, মিয়ানমারে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের নেত্রী অং সান সুকির বিগত ভোটে বিপুল ভোটাধিক্য অর্জনের পর থেকে নতুন করে সবার মনে ওই দেশের সব নাগরিকের জন্য মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার প্রত্যাশা স্বাভাবিবভাবেই বৃদ্ধি পায়। কিন্তু সে দেশের সংবিধান অনুযায়ী তিনি সার্বিক ক্ষমতায় অধিকারী হতে পারেননি। ক্ষমতার মূল চাবিকাঠি আজো রয়ে গেছে সে দেশের উগ্র সাম্প্রদায়িক সামরিক বাহিনীর হাতে সুকির হাতে নয়। তাই সামরিক বাহিনীর লালিত সাম্প্রদায়িকতার শিকার রোহিঙ্গারাও সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন হয়ে পড়ে। তাদের মধ্যে উগ্রপন্থিরা ‘আরসা’ নামে একটি সন্ত্রাসী মুসলিম উগ্রপন্থি সংগঠনও গড়ে তোলে। এদের লক্ষ্য মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীকে প্রতিরোধ করা ও ‘ইসলাম ধর্মের প্রসার’ ঘটানো।
এটা করতে গিয়ে তারা হিন্দু, রোহিঙ্গাদেরও ইসলামে ধর্মান্তরিত করতে শুরু করে অস্ত্রের মুখে। এরপরেও যারা ধর্মান্তরিত হতে অস্বীকৃতি জানায় তেমন হিন্দু রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ শিশুকেও তারা নির্মমভাবে হত্যা করে। এ সবের পরিণতিতে মিয়ানমারে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ভয়াবহ রূপ ধারণ করে। ‘আরসা’ কোনো বৃহৎ সংগঠনে পরিণত হতে পারেনি সত্য। কিন্তু নির্মমতা, নিষ্ঠুরতায় তারা অপর যে কোনো সন্ত্রাসী সংগঠনের চাইতে কোনো অংশে কম নয়। রোহিঙ্গা মুসলিমদের একাংশের মধ্যে ‘আরসা’র প্রতি মৌন সমর্থনও লক্ষণীয়। সব কিছু মিলিয়ে মিয়ানমারের পরিস্থিতি অত্যন্ত জটিল আকার ধারণ করেছে। দেশটিতে প্রকৃত প্রস্তাবে নাগরিকদের গণতান্ত্রিক অধিকার, মানবাধিকার প্রভৃতির নামগন্ধও নেই।
গণপ্রতিরোধ গড়ে উঠতে পারতো যদি অং সান সুকির দল সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠতো। কিন্তু তারা তো ওই দেশের সেনাবাহিনীর সঙ্গে শেষ পর্যন্ত আপসরফা করে ক্ষমতায় আসতে পেরেছে বিগত নির্বাচনে জনগণ তাদের বিপুল সংখ্যক ভোটে নির্বাচিত করলেও সেই শক্তির ওপর দাঁড়িয়ে অধিকতর শক্তি সংগ্রহের জন্য উপযুক্ত সংগ্রাম গড়ে তোলায় এখনো তারা নিকৃষ্টই শুধু নয়, সেনাবাহিনীর কর্মকাণ্ডের প্রতি চোখ বুঁজে থেকে নীরব দর্শকের ভূমিকা তারা পালন করছেন।
ফলে পরিস্থিতিটা নৈরাজ্যকর হয়ে দাঁড়িয়েছে। মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ এই নৈরাজ্য গণতন্ত্রহীনতা, আইনের শাসনের নাম নিশানা না থাকা, মানবাধিকারের নিষ্ঠুর এবং নির্দ্বিধায় লঙ্ঘন, ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর নির্মম নির্যাতন তাদের নাগরিকত্ব হরণ, দেশত্যাগে বাধ্যকরণ, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রতিশ্রæতি দিয়ে এবং তারপর বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষরের পরও রোহিঙ্গাদের সসম্মানে ফিরিয়ে না নিয়ে কার্যত চুক্তির বেমালুম লঙ্ঘন প্রভৃতি বিষয়ে আন্তর্জাতিক মহলগুলোর বিশেষত জাতিসংঘ, চীন, ভারতের চরম উদাসীনতা লক্ষণীয়।
এহেন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের ভোগান্তি অনেক দীর্ঘস্থায়ী হয়ে পড়ার সমূহ আশঙ্কা অত্যন্ত দৃশ্যমান। ১০ লাখ বাড়তি মানুষের দীর্ঘ মেয়াদে (বস্তুত অনিশ্চিত মেয়াদে) আহার, বাসস্থান, বস্ত্র, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ সব দিকের ব্যবস্থা করার সঙ্গতি যেমন নেই তেমনই বাংলাদেশে স্থানভিত্তিক অত্যন্ত প্রকট। অতিশয় ছোট আকৃতির দেশ বাংলাদেশ এবং একই সঙ্গে অত্যধিক জনসংখ্যা সংবলিত দেশ বাংলাদেশ। এমতাবস্থায় বিষয়টি জরুরিভিত্তিতে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সক্রিয় বিবেচনার দাবি রাখে। কিন্তু সে পথে না হেঁটে তারা যেন বাংলাদেশেই রোহিঙ্গা বসতি গড়ে তুলতে উৎসাহী।
যতই রোহিঙ্গাদের স্বদেশ প্রত্যাবসন বিলম্বিত হবে, উপরোক্ত সমস্যাগুলো ততই জটিল থেকে জটিলতর হবে। সরকার পরিচালিত মাদকবিরোধী অভিযান ও ইয়াবা চোরাচালানের বিষয় সঠিকভাবে বিবেচনা করলে দেখা যাবে মিয়ানমার সীমান্ত দিয়ে ওই দেশ থেকে লাখ লাখ ইয়াবা ট্যাবলেট প্রতিনিয়ত বাংলাদেশে ঢুকছে এবং ওই চোরাচালানের সঙ্গে বেশ কিছু সংখ্যক রোহিঙ্গা প্রত্যক্ষ-অপ্রত্যক্ষভাবে জড়িত। বিদেশের মাটিতে আশ্রয় নিয়ে সেই দেশের তরুণদের সর্বনাশ ঘটাতে নিয়োজিত থাকা মাদক আমদানির মাধ্যমে যে দুঃসাহসী ব্যাপার সে দুঃসাহসও তারা সঞ্চয় করে ফেলেছে উভয় দেশের সীমান্ত রক্ষীদের হাত করে।
কক্সবাজার, রাঙ্গামাটি, পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকা দিয়ে মাদকবিরোধী অভিযান সৎ পুলিশ, র্যাব-বিজিবি কর্মকর্তাদের মাধ্যমে কঠোরভাবে পরিচালনা করলে একটি ভয়াবহ চিত্র জনসমক্ষে তুলে ধরা এবং অভিযানে একটি বড় ধরনের সাফল্য অর্জনও সম্ভব বলে অনেকেই মনে করেন। শুধু মাদক দ্রব্য নয়, বেআইনি অস্ত্রের চোরাচালানও ওই রুটগুলো দিয়ে রোহিঙ্গাদের একাংশের মাধ্যমে চলছে বলেও অতীতে খবর বেরিয়েছে। তাদের সঙ্গে বাংলাদেশের চেনা কিছু রাঘব বোয়ালরাও জড়িত। রয়েছে তথাকথিত ইসলামি উগ্রবাহিনী ‘আরসা’র সন্ত্রাসী ও জামায়াত শিবিরসহ নানাদলের সন্ত্রাসী মহলগুলোর জড়িত থাকার আশঙ্কা।
বাংলাদেশে জাতীয় সংসদের নির্বাচন আসন্ন। এই নির্বাচনকে সামনে রেখে একদিকে যেমন বেআইনিভাবে যেসব রোহিঙ্গা বাংলাদেশের নাগরিকত্ব গ্রহণ করেছে, বাংলাদেশি পাসপোর্ট করে নিয়েছে। তাদের নাগরিকত্ব ও পাসপোর্ট দ্রুত বাতিল এবং ভোটার তালিকায় তাদের নাম উঠে থাকলে সেগুলোও দ্রুত বাতিল করা জরুরিভিত্তিতে প্রয়োজন।
রোহিঙ্গাদের ব্যাপক অংশ যাতে দ্রুত দেশে সসম্মানে ফিরে যেতে পারে, সেখানে তাদের বাড়িঘর ব্যবসা-বাণিজ্য ফেরত পেতে পারে, তাদের নাগরিকত্ব প্রাপ্তি এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত হতে পারে সে ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকারের ক‚টনৈতিক তৎপরতা আরো জোরদার করা প্রয়োজন। না হয় নির্বাচনে ভোটের ক্ষেত্রেও তার বিস্তর প্রভাব পড়তে পারে। নির্বাচনের পরিবেশ চিহ্নিত করতেও অপরাপর অপশক্তির সঙ্গে গোপনে বেনামে ‘আরসা’ও সম্পৃক্ত হয়ে যেতে পারে জামায়াত-হেফাজতের সহযোগিতায়।
রণেশ মৈত্র : রাজনীতিক, কলাম লেখক।
Posted ১:০৫ পূর্বাহ্ণ | মঙ্গলবার, ০৫ জুন ২০১৮
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta