কক্সবাংলা ডটকম(২২ ফেব্রুয়ারি) :: শিক্ষা প্রশাসনে ব্যাপক বদলির মাধ্যমে লণ্ডভন্ড হয়ে গেছে দুর্নীতির সিন্ডিকেট। প্রথম দফায়ই শিক্ষা প্রশাসনে গেড়ে বসা আলোচিত ২৩ কর্মকর্তাসহ মোট ৩০ জনকে বৃহস্পতিবার ঢাকার বাইরে বদলির মাধ্যমে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের শুদ্ধি কার্যক্রম শুরু হয়। এ যাবৎকালে শিক্ষা প্রশাসনে এটিই সবচেয়ে বড় বদলি। সিন্ডিকেটে ‘পালের গোদা’ হিসেবে চিহ্নিত শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের সাবেক এপিএস মন্মথ রঞ্জন বাড়ৈকে ঢাকা বোর্ড থেকে রাজশাহী কলেজে বদলি করা হয়েছে।
সূত্র জানায়, ২৯ জনকে বদলি করেই থেমে থাকেনি শিক্ষা মন্ত্রণালয়। সিন্ডিকেটের বাকি সদস্যদেরও ঢাকার বাইরে পাঠানোর নথি চূড়ান্ত করা হচ্ছে। বিশেষ করে দীর্ঘদিন ধরে বহাল তবিয়তে থাকা কর্মকর্তারূপী শিক্ষকদের আগামী ‘লটে’ বদলি করা হবে বলে জানা গেছে। প্রশ্নফাঁসে শিক্ষা প্রশাসনের কর্মকর্তাদের জড়িত থাকার অভিযোগের মধ্যে সাম্প্রতিক সময়ে ভোরের কাগজসহ অন্যান্য সংবাদমাধ্যমে আসা প্রতিবেদনে এই কর্মকর্তাদের কয়েকজনের নামও এসেছে।
বদলি হওয়া কর্মকর্তাদের তালিকা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, মাত্র এক বছর সাত মাস আগে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের কলেজ শাখা-৪ এর সহকারী পরিচালক হিসেবে যোগ দেয়া মো. জাকির হোসেনকে গতকাল বদলি করা হয়েছে। কিন্তু দুর্নীতিবাজ হিসেবে অভিযুক্ত মাউশির প্রশাসন শাখার সহকারী পরিচালক জাকির হোসেন এখনো বহাল তবিয়তে রয়েছেন। এ নিয়ে অসন্তোষ রয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন একজন কর্মকর্তা বলেন, যারা দীর্ঘদিন একই কর্মস্থলে এবং যাদের বিরুদ্ধে কিঞ্চিত পরিমাণ অভিযোগ রয়েছে তাদেরই বদলি করা হয়েছে। আগামী সপ্তাহে আরো বড় ধরনের বদলি করা হবে। যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে এবং দীর্ঘদিন একই পদে কর্মরত আছেন কেউই রক্ষা পাবেন না। আমরা অতি গোপনে তালিকাটি করেছি। জানাজানি হলে বিভিন্ন পর্যায়ের তদবির আসে।
সূত্র জানায়, গত বছরের ১০ এপ্রিল শিক্ষা মন্ত্রণালয় আলাদা করে নীতিমালা জারি করে বলেছিল, বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তারা এখন থেকে একই দপ্তর বা সংস্থায় একনাগারে তিন বছরের বেশি সময় থাকতে পারবেন না।
শুধু তা-ই নয়, কোনো কর্মকর্তাকে একটি দপ্তর থেকে অন্য কোনো দপ্তর বা সংস্থায় বদলিও করা যাবে না। সম্প্রতি শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের ব্যক্তিগত কর্মকর্তা (পিও) মোতালেব এবং উচ্চমান সহকারী মো. নাসিরউদ্দিনকে ঘুষ ও দুর্নীতির অভিযোগে গ্রেপ্তারের পর অন্য কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে আলোচনা শুরু হয়।
এর মধ্যে পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় শিক্ষা মন্ত্রণালয় ব্যাপক ভাবমূর্তি সংকটে রয়েছে। মূলত এই ভাবমূর্তি রক্ষায় এখন অভিযোগ থাকা এবং একই পদে দীর্ঘদিন থাকা কর্মকর্তাদের সরিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
বৃহস্পতিবার জারি করা বদলিতে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের শক্তিশালী দুর্নীতির সিন্ডিকেট ভেঙে দেয়া হয়েছে। একসঙ্গে সাতজন কর্মকর্তাকে ঢাকার বাইরে পাঠানো হয়েছে। ঢাকা বোর্ডের ইতিহাসে এ ধরনের ঘটনা আর ঘটেনি। তবে ‘শাহেদ-তপন’ নামে দুই ‘রাঘব বোয়াল’ এখনো ঢাকা বোর্ডের স্বপদে বহাল আছেন।
এ ছাড়া মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) সাতজন, জাতীয় পাঠ্যক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) আটজন এবং অন্যান্য শিক্ষা বোর্ডের ৮ জন কর্মকর্তাকে বদলি করা হয়েছে। এরা সবাই বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তা। তবে প্রেষণে যুগের পর যুগ প্রশাসনিক পদ আঁকড়ে ছিলেন। গড়ে তুলেছিলেন দুর্নীতির ভয়াবহ সিন্ডিকেট। তাদের কারণেই ভাবমূর্তি সংকটে পড়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
বৃহস্পতিবার শিক্ষা মন্ত্রণালয় জারি করা বদলি আদেশে জানা গেছে, ঢাকা বোর্ডের কলেজ পরিদর্শক ড. মো. আশফাকুস সালেহীনকে সরকারি এমএম কলেজে বদলি করা হয়েছে। তিনি ২০০৯ সাল থেকে প্রেষণে শিক্ষা প্রশাসনে কর্মরত ছিলেন। বিদ্যালয় পরিদর্শক এ টি এম মঈনুল হোসেনকে খুলনা সরকারি মহিলা কলেজে বদলি করা হয়েছে।
উপসচিব (প্রশাসন ও সংস্থাপন) মোহাম্মদ নাজমুল হককে শরীয়তপুর সরকারি কলেজে বদলি করা হয়েছে। উপপরীক্ষা নিয়ন্ত্রক মাসুদ বেগমকে বরিশালের বিএম কলেজে বদলি করা হয়েছে। তিনি ২০০৯ সাল থেকে বোর্ডে কর্মরত ছিলেন। বছর কয়েক আগে তিনি প্রধান পরীক্ষককে ডেকে এনে এসএসসি পরীক্ষায় ফেল করা নিজের মেয়েকে অবৈধভাবে পাস করান।
এ নিয়ে তদন্ত কমিটি করেন ঢাকা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ফাহিমা খাতুন। উপপরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অদ্বৈত কুমার রায়কে সরকারি রাজেন্দ্র কলেজে পাঠানো হয়েছে। বোর্ডের উপপরিচালক মো. ফজলে এলাহীকে লক্ষীপুরের রামগঞ্জ সরকারি কলেজে বদলি করা হয়েছে।
বদলি করা কর্মকর্তাদের মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত বোর্ডের উপকলেজ পরিদর্শক মন্মথ রঞ্জন বাড়ৈ। তাকে রাজশাহী কলেজে বদলি করা হয়েছে। তার গড়া সিন্ডিকেটের সদস্যরা মাউশি, শিক্ষা বোর্ডসহ মন্ত্রণালয়ের অধীন বিভিন্ন প্রকল্পে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন।
অভিযোগ রয়েছে, তার ইঙ্গিত ছাড়া শিক্ষা প্রশাসনে কারো বদলি ও পদোন্নতি হতো না। গতকাল তাকেই ঢাকা থেকে বিদায় করে পদ্মাপাড়ে পাঠানো হয়েছে।
বিতর্কিত এই কর্মকর্তা ২০১৩ সাল থেকে বোর্ডের ওই পদটিতে নাজিল হয়েছিলেন। এর আগে তিনি শিক্ষামন্ত্রীর এপিএস এবং মন্ত্রীকন্যার গৃহশিক্ষক ছিলেন। এ সময়ে মন্ত্রণালয়ে ‘দুর্নীতির হাট’ বসিয়ে ছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্দেশে তাকে মন্ত্রণালয় থেকে সরিয়ে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডে ‘প্রাইজ পোস্টিং’ দেয়া হয়। কিন্তু গতকাল আর শেষ রক্ষা হয়নি।
ঢাকা বোর্ডের সাতজনকে বদলি করা হলেও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্বে থাকা বোর্ডের সচিব শাহেদুল খবির ও পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক তপন কুমার সরকারকে বদলি করা হয়নি। অথচ তাদের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ রয়েছে। শাহেদুল খবির ২০০৯ সালে স্কুল পরিদর্শক হিসেবে বোর্ডে প্রেষণে দায়িত্ব পান। পরে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান।
টানা ৯ বছর এই বোর্ডে প্রেষণে আছেন। বিসিএস সাধারণ শিক্ষক সমিতির এই নেতা সংগঠনে অনুমোদন ছাড়াই জাতীয়করণের তালিকায় থাকা বেসরকারি কলেজ শিক্ষকদের পদমর্যাদা নিয়ে আদালতে একটি মামলা করেছেন। যে কারণে প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী সরকারি কলেজবিহীন উপজেলায় একটি করে কলেজ সরকারিকরণ প্রকল্প স্থবির হয়ে আছে।
পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক তপন কুমার সরকার ২০০৯ সালে উপপরীক্ষা নিয়ন্ত্রক হয়ে বোর্ডে আসেন। বর্তমানে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক। এই পদটিও সিনিয়র অধ্যাপক পদমর্যাদার। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে, অর্থের বিনিময়ে অখ্যাত প্রতিষ্ঠানে পাবলিক পরীক্ষার কেন্দ্রের অনুমোদন দেয়ার। প্রশ্নফাঁস হওয়ার বড় কারণ হিসেবে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এটি চিহ্নিত করেছে। তারপরেও তিনি বহাল আছেন স্বপদে।
বৃহস্পতিবার’র জারি করা বদলি আদেশ সূত্রে জানা গেছে, মাউশির পরিচালক (মনিটরিং এন্ড ইভালুয়েশন উইং) মো. সেলিমকে মাদারীপুরের বরহামগঞ্জ সরকারি কলেজে, উপপরিচালক (কলেজ-২) মো. মেসবাহ উদ্দিন সরকারকে আনন্দমোহন সরকারি কলেজে, উপপরিচালক এস এম কামাল উদ্দিন হায়দার মানিকগঞ্জের সরকারি দেবেন্দ্র কলেজে, উপপরিচালক মো. শফিকুল ইসলাম সিদ্দিকিকে ভোলা সরকারি কলেজে, সহকারী পরিচালক (কলেজ-৪) জাকির হোসেনকে ফেনীর জিয়া সরকারি কলেজে, উপপরিচালক (প্রশিক্ষণ) খ ম রাশেদুল হাসানকে সরকারি এম এম কলেজে, সহকারী পরিচালক (কলেজ-২) মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেনকে চট্টগ্রাম সরকারি কলেজে বদলি করা হয়েছে।
এনসিটিবির উৎপাদন নিয়ন্ত্রক প্রফেসর মো. আবদুল মজিদকে রাজশাহী কলেজে, সম্পাদক দিলরুবা আহমেদকে তোলারাম সরকারি কলেজে, বিশেষজ্ঞ ফাতেমা নাসিমা আক্তারকে রাজবাড়ী সরকারি কলেজে, মনিরা বেগমকে ফেনীর জিয়া সরকারি কলেজে, শাহীনারা বেগমকে গুরুদয়াল কলেজে, গবেষণা কর্মকর্তা মারুফা বেগমকে বিয়ানীবাজার সরকারি কলেজে, মো. হাবিবুল্লাহকে নবাবগঞ্জ সরকারি কলেজে, মোহাম্মদ শাহ আলমকে রাজবাড়ী সরকারি কলেজে বদলি করা হয়েছে।
মজিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে পাঠ্যপুস্তক ছাপানোর কমিশন বাণিজ্যের। অন্যরা দীর্ঘদিন আরাম আয়েশে বছরে বাড়তি ছয়টি বোনাসসহ ঢাকায় থাকতে এনসিটিবিতে পদায়ন নিয়েছিলেন। তাদের অবহেলায় প্রতি বছর পাঠ্যপুস্তকে ভুলের ছড়াছড়ি হতো। এই প্রতিষ্ঠানের মোখলেছুর রহমান, মোছাব্বির হোসেন, মনির হোসেনসহ আরো ১০ জন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ রয়েছে। এর মধ্যে শিক্ষামন্ত্রীর একান্ত সচিবের (পিএস) বোন জামাতাও রয়েছেন।
দুর্নীতির আরেক ‘দুর্গ’ পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) সহকারী শিক্ষা পরিদর্শক মো. কাওসার হোসেনকে শুধু ঢাকার বাইরে বদলি করা হয়েছে। যশোর বোর্ডের কলেজ পরিদর্শক অমল কুমার বিশ^াসকে উল্লাপাড়া সরকারি আকবর আলী কলেজে, কুমিল্লা বোর্ডের বিদ্যালয় পরিদর্শক ইলিয়াস উদ্দিন আহমেদকে নওগাঁ সরকারি কলেজে, একই বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক কায়সার আহমেদকে নবীনগর সরকারি কলেজে, বরিশাল বোর্ডের বিদ্যালয় পরিদর্শক মো. আবুল বাশার তালুকদারকে পটুয়াখালী সরকারি কলেজে বদলি করা হয়েছে।
এদিকে, একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনের আলোকে বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের এমপিও দুর্নীতির অভিযোগে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে ৮৬ জন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এরই মধ্যে ১৩ জন জেলা ও উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তাকে বদলি করা হয়েছে। তবে অনেকে নতুন কর্মস্থলে যোগ না দিয়ে প্রভাবশালী মন্ত্রীদের মাধ্যমে বদলি ঠেকাতে তদবির করছেন।
সরকারি আদেশ অমান্য করায় বৃহস্পতিবার কুমিল্লা সদর উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা কাজী ফরিদ আহমেদকে কারণ দর্শানো নোটিস দিয়েছে মাউশি। তাকে তিন কর্মদিবসের মধ্যে জবাব দিতে বলা হয়েছে।
Posted ৩:৩৭ পূর্বাহ্ণ | শুক্রবার, ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৮
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta