কক্সবাংলা ডটকম(১৬ জানুয়ারী) :: বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষক সগিরা মোর্শেদা সালাম (৩৪) হত্যা মামলায় চারজনকে অভিযুক্ত করে অভিযোগপত্র জমা দিয়েছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। অভিযুক্তরা হলেন সগিরা মোর্শেদার ভাশুর ডা. হাসান আলী চৌধুরী (৭০), সায়েদাতুল মাহমুদা ওরফে শাহীন (৬৪), আনাস মাহমুদ রেজওয়ান (৫৯) ও মারুফ রেজা।
অভিযুক্ত সবাই পিবিআইয়ের হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার পর আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেওয়ার পর কারাগারে রয়েছেন।
বৃহস্পতিবার দুপুরে ধানমন্ডির পিবিআইয়ের প্রধান কার্যালয় অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানিয়েছেন সংস্থাটির প্রধান ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার।
সংবাদ সম্মেলনে ৩০ বছর আগের সেই হত্যাকাণ্ডস্থল, হত্যার পরিকল্পনাস্থল, হত্যার আগে ভাড়াটে মারুফ রেজা ও আনাসের মোটরসাইকেলযোগে ঘটনাস্থলে যাওয়া, অপেক্ষা, রিকশার পিছু নেওয়া, রিকশার গতিরোধ, ব্যাগ ধরে টানাটানি ও গুলির দৃশ্যের স্কেচ প্রদর্শন করা হয়ে।
এ ছাড়া গুলিবিদ্ধ মোর্শেদাকে একজন চিকিৎসক তার গাড়িযোগে হাসপাতালে নেয়া ও হত্যাকারীদের মোটরসাইকেলের পেছনে রিকশাচালকের ইট নিয়ে হাইজ্যাকার হাইজ্যাকার বলে দৌড়ানোর দৃশ্য প্রদর্শন করা হয়।
এ সময় লিখিত বক্তব্যে বনজ কুমার মজুমদার বলেন, প্রায় তিন দশক আগে ভিকারুননিসা নূন স্কুলের সামনে সগিরা মোর্শেদ সালামকে গুলি করে হত্যা করা হয়। গত বছরের ১৭ আগস্ট এ মামলাটি তদন্ত শুরু করে পিবিআই। হাইকোর্টের নির্দেশে ৬ মাস তদন্ত চলাকালে চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। আসামিরা হাইকোর্টে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছে। সগিরা মোর্শেদকে মূলত তুচ্ছ পারিবারিক দ্বন্দ্ব থেকে হত্যার পরিকল্পনা করেন আসামিরা। পরিকল্পনামাফিক তা বাস্তবায়নের জন্য ভাড়াটে সন্ত্রাসী নিয়োগ দেওয়া হয়।
তিনি জানান, পিবিআইয়ের তদন্তে হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে পারিবারিক ৮ ধরনের দ্বন্দ্বের তথ্য উদঘাটন করেছে। এগুলো হচ্ছে- আসামিরা একই ভবনে বসবাসরে কারণে তৃতীয় তলা থেকে ময়লা আবর্জনা নিচে ফেললে তা মোর্শেদার রান্না ঘর ও বারান্দায় পড়ত। শাশুড়ি বেশি পছন্দ করতেন সগিরা মোর্শেদাকে। সগিরা ছিলেন বেশি শিক্ষিত, সে তুলনায় ডা. হাসান আলী চৌধুরীর স্ত্রী সায়েদাতুল মাহমুদা শাহীন ছিলেন কম শিক্ষিত। সগিরা মোর্শেদ দম্পতির বাসাবাড়ি ডা. দম্পতির বাড়ির তুলনায় বেশি সুন্দর ও পরিকল্পিত ছিল। ‘তুমি’ সম্বোধন নিয়েও দুজনের মধ্যে মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব শুরু হয়েছিল। ছাদ ব্যবহার নিয়েও দ্বন্দ্ব ছিল।
মোর্শেদার কাজের মেয়ে জাহানুরকে মারধর করেছিলেন আসামি ডা. হাসান আলী। এটি নিয়ে পারিবারিক বৈঠক হওয়ায় ক্ষুব্ধ ছিলেন শাহীন। দেখে নেওয়ার হুমকি দিয়েছিলেন মোর্শেদাকে। তাকে ভয়ভীতি, হেনস্তা ও বড় ধরনের অঘটন ঘটানোর জন্য আসামিদের রাজারবাগ বাসার তৃতীয় তলায় হত্যার পরিকল্পনা করেন। পরিকল্পনা মাফিক তা বাস্তবায়নের জন্য আসামি ডা. হাসান আলী চৌধুরী তার প্রাইভেট প্র্যাকটিস ৪০০, নিউ ইস্কাটনের যমুনা ফার্মেসিতে আসামি মারুফ রেজার সঙ্গে ২৫ হাজার টাকার চুক্তি করেন।
পূর্ব পরিকল্পনা মাফিক ১৯৮৯ সালের ২৫ জুলাই আসামি মারুফ রেজা, আনাস মাহমুদ ওরফে রেজওয়ান সিদ্ধেশ্বরীতে প্রকাশ্য দিবালোকে গুলি করে সগিরা মোর্শেদকে হত্যা করে।
হত্যার ৫ দিন পর আসামি মারুফ রেজা আসামি ডা. হাসান আলী চৌধুরীর চেম্বারে দেখা করলে চুক্তিকৃত ২৫ হাজার টাকার মধ্যে ১৫ হাজার টাকা পরিশোধ করে। বাকি ১০ হাজার টাকা পরে দেওয়া হবে বললেও আসামি ডা. হাসান আলী চৌধুরী অদ্যাবধি তা পরিশোধ করেননি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মনিটরিং পলিসি বিভাগের তথ্যের বরাত দিয়ে বনজ কুমার জানান, ১৯৮৯ সালের ২৫ হাজার টাকার বর্তমান মূল্যমান ৬ লাখ ১৫ হাজার ৫৪৪ টাকা।
তিনি আরও জানান, আসামি মারুফ রেজা তার জাতীয় পরিচয়পত্রে তার বয়স ২৯/০৮/১৯৭২ সাল উল্লেখ করে তার প্রকৃত বয়সকে গোপন করত উক্ত মামলায় কিশোর অপরাধী হিসাবে সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা করেছেন। তদন্তে বের হয়ে আসে, আসামি মারুফ রেজার প্রকৃত জন্ম সাল ১০/০৩/১৯৭১। সগিরা মোর্শেদ হত্যার সময় মারুফ রেজার বয়স ছিল ১৮ বছর ৪ মাস ১৫ দিন। সগিরা মোর্শেদ হত্যার ঘটনাস্থলটি মারুফ রেজার সিদ্ধেশ্বরী ৬৭ নম্বর বাড়ি থেকে আনুমানিক ৪০০ গজ উত্তরে-পশ্চিমে অবস্থিত।
বনজ কুমার মজুমদার জানান, সগিরা মোর্শেদকে হত্যায় ব্যবহৃত মোটরসাইকেল ঘটনার পরবর্তীতে চুরি হওয়ায় উদ্ধার করা যায়নি। উক্ত মোটরসাইকেল সংক্রান্ত ড্রাইভার মো. আনোয়ার হোসেন সাক্ষী হিসাবে আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন। হত্যায় ব্যবহৃত রিভলবারটির মালিক মনু মিয়া ওরফে মুন্না ওরফে হরর মুন্না রূপগঞ্জে গত ২০০৫ সালের ২৮ নভেম্বর আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে মারা যান। তার বিরুদ্ধে রূপগঞ্জ থানায় দুটি মামলা ছিল।
বনজ কুমার মজুমদার বলেন, পারিবারিক তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে আসামিরা একই উদ্দেশ্যে পরিকল্পিতভাবে সগিরা মোর্শেদাকে হত্যা করে । বিষয়টি গোপন করার উদ্দেশ্যে ছিনতাইয়ের মতো নাটক মঞ্চস্থ করে। ওই আসামিরা সগিরা মোর্শেদকে হত্যার পরবর্তীতে গত ৩০ বছর ধরে হোয়াইট কালার অপরাধী হিসাবে সমাজে পরিবার পরিজন নিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করে আসছে।
তদন্তে সাক্ষ্য প্রমাণের সগিরা মোর্শেদ হত্যায় আসামি ডা. হাসান আলী চৌধুরী ও মারুফ রেজার বিরুদ্ধে খুনের পরিকল্পনা করা, খুন করা, অপরাধীদের গোপন করার জন্য অপরাধের সাক্ষ্য অদৃশ্য করে দেওয়া, এবং মামলা নিয়ে বাড়াবাড়ি না করার জন্য বাদীকে অপরাধমূলক ভয়ভীতি প্রদর্শন করা এবং আসামি সায়েদাতুল মাহমুদা ওরফে শাহিন ও আসামি আনাস মাহমুদ ওরফে রেজওয়ানের বিরুদ্ধে একই উদ্দেশ্য সাধনকল্পে খুনের পরিকল্পনা করা, খুন করা, অপরাধীদের গোপন করার জন্য অপরাধের সাক্ষ্য অদৃশ্য করার অপরাধ প্রমাণিত হয়েছে।
মামলাটির তদন্ত কর্মকর্তা হলেন- পিবিআইয়ের ঢাকা মেট্রো দক্ষিণের পরিদর্শক রফিকুল ইসলাম। তদারককারী হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন পুলিশ সুপার মো. শাহাদাত হোসেন।
বনজ কুমার জানান, হত্যার পর এই মামলা ২৫ জন তদন্ত কর্মকর্তা তদন্ত করেন। দীর্ঘদিনের এই তদন্ত চলাকালে তারা মোট ২৫ জন ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করেছিলেন। তবে হত্যা রহস্য উদঘাটন করতে পারেননি। সর্বশেষ মিন্টু নামে একজনকে আসামি করে চার্জশিট দেওয়া হলেও তিনি এই হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে কিছুই জানতেন না। ৩০ বছর পর ২০১৯ সালের ১৭ জুলাই মামলার তদন্তের ভার পড়ে পিবিআইয়ের ওপর।
মামলার সংক্ষিপ্ত বিবরণে জানা যায়, ১৯৮৯ সালের ২৫ জুলাই সগিরা মোর্শেদ ভিকারুননিসা নূন স্কুল থেকে মেয়েকে আনতে যাওয়ার পথে দুর্বৃত্তের কবলে পড়েন। একপর্যায়ে দৌড় দিলে তাকে গুলি করা হয়। পরে হাসপাতালে নেওয়ার পথে সগিরা মোর্শেদ মারা যান। সেদিনই রমনা থানায় অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মামলা করেন তার স্বামী সালাম চৌধুরী। প্রত্যক্ষদর্শী রিকশাচালক জড়িত দুজনের কথা বললেও মিন্টু ওরফে মন্টু নামের একজনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। ১৯৯১ সালের ১৭ জানুয়ারি মন্টুর বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়। নেওয়া হয় সাতজনের সাক্ষ্য। বাদীপক্ষের সাক্ষ্যে আসামি মন্টু ও তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদুল হাসানের নিকটাত্মীয় মারুফ রেজার নাম আসে। পরে রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৯১ সালের ২৩ মে বিচারিক আদালত অধিকতর তদন্তের আদেশ দেন। এ আদেশের বিরুদ্ধে মারুফ রেজা হাইকোর্টে আবেদন করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৯১ সালের ২ জুলাই হাইকোর্ট রুল দিয়ে অধিকতর তদন্তের আদেশ স্থগিত করেন। পরের বছরের ২৭ আগস্ট অপর এক আদেশে হাইকোর্ট ওই রুল নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত স্থগিতাদেশের মেয়াদ বাড়ান। এতে থমকে যায় মামলার কার্যক্রম।
বিষয়টি নজরে এলে ওই স্থগিতাদেশ প্রত্যাহারের জন্য উদ্যোগ নেয় রাষ্ট্রপক্ষ। শুনানি নিয়ে গত বছরের ২৬ জুন হাইকোর্টের একই বেঞ্চ মামলার অধিকতর তদন্ত আদেশে ইতিপূর্বে দেওয়া স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করেন। একই সঙ্গে ৬০ দিনের মধ্যে ওই মামলার অধিকতর তদন্ত শেষ করতে পিবিআইকে নির্দেশ দেন।
১৪ নভেম্বর পিবিআইয়ের সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, পারিবারিক বিরোধের জের ধরে সগিরা মোর্শেদার ভাশুর, ভাশুরের স্ত্রী ও শ্যালক মিলে তাকে (সগিরা) হত্যার পরিকল্পনা করেন। তারা ভাড়াটে সন্ত্রাসী দিয়ে তাকে হত্যা করান।
Posted ১২:০০ পূর্বাহ্ণ | শুক্রবার, ১৭ জানুয়ারি ২০২০
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta