গোলাম সারওয়ারের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এছাড়াও বিভিন্ন রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং পেশাজীবী সংগঠনের নেতৃবৃন্দ তার মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেন।
সোমবার বিকেলে শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে করোনারি কেয়ার ইউনিটে (সিসিইউ) চিকিৎসাধীন গোলাম সারওয়ারকে লাইফ সাপোর্টে নেয়া হয়। পরে বাংলাদেশ সময় রাত ৯.২৫ মিনিটে তার লাইফ সাপোর্ট খুলে নেওয়া হয়।
গত ৩ আগস্ট মধ্যরাতে সমকাল সম্পাদককে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে সিঙ্গাপুরে নেওয়া হয়। পরদিন সকালে তাকে সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে চিকিৎসার পর তার শারীরিক অবস্থার কিছুটা উন্নতিও হয়েছিল।
নিউমোনিয়া সংক্রমণ হ্রাসের পাশাপাশি ফুসফুসে জমে থাকা পানিও কমে গিয়েছিল। হার্টও স্বাভাবিকভাবে কাজ করছিল। কিন্তু গত রোববার হঠাৎ করে তার রক্তচাপ কমে যায়। কিডনিও স্বাভাবিকভাবে কাজ করছিল না। এ অবস্থায় সোমবার বিকেলে তাকে লাইফ সাপোর্টে নেওয়া হয়।
এর আগে গত ২৯ জুলাই মধ্য রাতে সাংবাদিক, সম্পাদক পরিষদের সভাপতি গোলাম সারওয়ার রাজধানীর ল্যাবএইড হাসপাতালে ভর্তি হন।
স্বনামধন্য সাংবাদিক ও কলাম লেখক গোলাম সারওয়ার ১৯৪৩ সালের ১ এপ্রিল বরিশালের বানারীপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৬৩ সালে দৈনিক পয়গম দিয়ে তার সাংবাদিকতা জীবন শুরু হয়। এরপর যুক্ত ছিলেন দৈনিক সংবাদ, দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক যুগান্তর, দৈনিক সমকালের মত শীর্ষস্থানীয় দৈনিকে।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পর্যন্ত দৈনিক সংবাদে বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। মহান মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণের পর বানারীপাড়া ইউনিয়ন ইনস্টিটিউশনে কিছুদিন প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
এরপর ১৯৭৩ সালে দৈনিক ইত্তেফাকের সিনিয়র সহ-সম্পাদক হিসেবে যোগদান করেন গোলাম সারওয়ার। ইত্তেফাকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত প্রধান সহ-সম্পাদক, যুগ্ম-বার্তা সম্পাদক ও বার্তা সম্পাদক পদে কর্মরত ছিলেন তিনি।
ইত্তেফাকে দীর্ঘ দুই যুগ কর্মরত থাকার পর ১৯৯৯ সালে দৈনিক যুগান্তরের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক হিসেবে যোগ দেন। এর ৬ বছর পর ২০০৫ সালে প্রতিষ্ঠা করেন দৈনিক সমকাল। জীবনের শেষ কর্মদিবস পর্যন্ত এই পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন।
সাংবাদিকতায় অবদানের জন্য ২০১৪ সালে গোলাম সারওয়ারকে দেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান একুশে পদক দেয়া হয়। এছাড়াও তিনি ২০১৬ সালে কালচারাল জার্নালিস্টস ফোরাম অব বাংলাদেশ (সিজেএফবি) আজীবন সম্মাননা এবং ২০১৭ সালে আতাউস সামাদ স্মারক ট্রাস্ট্রের আজীবন সম্মাননা অর্জন করেন।
গোলাম সারওয়ারের বর্ণাঢ্য কর্মময় জীবন
বাংলাদেশের সংবাদপত্রের ইতিহাসে গোলাম সারওয়ার উজ্জ্বল এক নাম। মুক্তচিন্তা, প্রগতিশীল মূল্যবোধ আর মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে সোচ্চার এ মানুষটি সাংবাদিকতা জগতের প্রতিষ্ঠানতুল্য ব্যক্তিত্ব। ষাটের দশকে সাংবাদিকতার শুরু থেকে একটানা পাঁচ দশকের বেশি সময় তিনি এই পেশায় মেধা, যুক্তিবোধ, পেশাদারিত্ব, দায়িত্বশীলতা, অসাম্প্রদায়িক চিন্তা-চেতনার নিরবচ্ছিন্ন চর্চায় নিজেকে এবং বাংলাদেশের সংবাদপত্রকে অনন্য উচ্চতায় প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
প্রতিষ্ঠান হিসেবে সংবাদপত্রের অন্যতম প্রধান স্তম্ভ বার্তা বিভাগে গোলাম সারওয়ারের সৃজনশীলতা, সংবাদবোধ ও তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা এদেশের সংবাদমাধ্যম জগতে উদাহরণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। দৈনিক ইত্তেফাকে দীর্ঘ ২৭ বছর বার্তা সম্পাদকের দায়িত্ব পালনকালে তিনি একাধারে সৃজনশীল ও পেশাদার সাংবাদিকতায় অতুলনীয় দক্ষতার স্বাক্ষর রাখেন। সত্তরের দশকের প্রথমার্ধে দৈনিক ইত্তেফাকের বার্তা সম্পাদকের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি তিনি সাপ্তাহিক পূর্বাণীর নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে কাজ করেন। পূর্বাণীতে তারই সম্পাদনায় এদেশে প্রথম ম্যাগাজিন আকারে বৃহদায়তনের ঈদসংখ্যা প্রকাশের রীতি শুরু হয়। তার নেতৃত্বে সাংস্কৃতিক সাপ্তাহিক হিসেবে পূর্বাণী অভূতপূর্ব জনপ্রিয়তা অর্জন করে।
এসব কৃতিত্বের ধারাবাহিকতায় তিনি দেশের দুটি সেরা দৈনিক ‘যুগান্তর’ ও ‘সমকাল’-এর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক হিসেবে নজিরবিহীন সাফল্য অর্জন করেন। ১৯৯৯ সালে প্রকাশিত দৈনিক যুগান্তরের সম্পাদক এবং এর ছয় বছর পর ২০০৫ সালে আরেকটি নতুন দৈনিক সমকালের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন তিনি। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত পালন করে যান সে দায়িত্ব। তার সুযোগ্য নেতৃত্ব, ক্ষুরধার মেধা ও অসামান্য সাংগঠনিক দক্ষতা পত্রিকা দুটিকে দ্রুততম সময়ে পাঠকপ্রিয় করে তোলে।
মেধা, নিষ্ঠা ও দক্ষতার কারণে গোলাম সারওয়ারকে অনেকেই সাংবাদিকদের শিক্ষক হিসেবে অভিহিত করেন। তার হাতে গড়া অন্তত পাঁচ শতাধিক সাংবাদিক এখন দেশের বিভিন্ন পত্রিকা ও টেলিভিশন মাধ্যমে নিজ নিজ দক্ষতার স্বাক্ষর রেখে চলেছেন। তার হাতে সরাসরি কাজ শেখা বেশ কয়েকজন সাংবাদিক বর্তমানে দৈনিক পত্রিকা ও টেলিভিশন মাধ্যমের সম্পাদক বা প্রধান সম্পাদক হিসেবে যোগ্যতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছেন। তারা অনেকেই গর্বভরে নিজেদের পেশার শিক্ষক হিসেবে গোলাম সারওয়ারের অবদানের কথা উল্লেখ করেন।
বাংলাদেশের সংবাদপত্রের বিকাশ ও ক্রমপরিণতির ইতিহাসে গোলাম সারওয়ারের নাম অতিগুরুত্ব ও স্পষ্টতার সঙ্গে উচ্চারিত হবে বারবার। শৌখিন, কুটিরশিল্পসদৃশ সংবাদপত্রের ক্ষীণ বলয় থেকে বৃহৎ কলেবরের সংবাদপত্রের অভিযাত্রার অন্যতম সফল পথিকৃৎ সম্পাদক গোলাম সারওয়ার। তিনিই প্রথম এদেশে প্রতিদিন রঙিন খেলার পাতা, বিনোদন পাতা, নানা স্বাদের গুচ্ছ গুচ্ছ ফিচার প্রকাশ করার রীতি প্রবর্তন করে দৈনিক পত্রিকার চেনা অবয়বকে পাল্টে দিয়ে একটি দৈনিককে পরিবারের সব সদস্যের উপযোগী করে তোলার পরিকল্পনাকে সফলভাবে বাস্তবায়িত করেন। সংবাদকে তার উপযুক্ত গুরুত্ব দিয়ে যথাযথ ট্রিটমেন্টে প্রকাশ করায় তার সমতুল্য কোনো সম্পাদক এদেশে নেই- এটি অপরাপর সম্পাদকের ভাষ্যেই বহুবার জানা গেছে। গোলাম সারওয়ার এদেশের সংবাদপত্রের সাফল্য ও পেশাদারিত্বের প্রতীক।
তার জন্ম ১৯৪৩ সালের ১ এপ্রিল বরিশালের বানারীপাড়ার এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে। বাবা মরহুম গোলাম কুদ্দুস মোল্লা ও মা মরহুম সিতারা বেগম দম্পতির জ্যেষ্ঠ সন্তান গোলাম সারওয়ার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে স্নাতক সম্মানসহ এমএ ডিগ্রি অর্জন করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবস্থায় ১৯৬২ সালে চট্টগ্রামের দৈনিক আজাদীর বিশ্ববিদ্যালয় সংবাদদাতা হিসেবে তার সাংবাদিকতা পেশার সূচনা। একই বছর দৈনিক সংবাদের সহসম্পাদক হিসেবে যুক্ত হন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পর্যন্ত সংবাদে চাকরিরত ছিলেন। এরপর মহান মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। মুক্তিযুদ্ধে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন নিজ এলাকা বানারীপাড়ায়। মুক্তিযুদ্ধের পর কয়েক মাস বানারীপাড়া ইউনিয়ন ইনস্টিটিউশনে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন। তার পরপরই ১৯৭২ সালে ইত্তেফাকে সিনিয়র সহসম্পাদক হিসেবে যুক্ত হন। ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত যথাক্রমে প্রধান সহসম্পাদক, যুগ্ম বার্তা সম্পাদক ও বার্তা সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি বাংলাদেশের দৈনিক সংবাদপত্রগুলোর সম্পাদকদের সংগঠন বাংলাদেশ সম্পাদক পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি।
সৃজনশীল সাহিত্যে গোলাম সারওয়ারের অকৃত্রিম আগ্রহ ও উদ্যোগ তার সৃষ্টিশীলতা ও প্রাণময়তার আরেক ক্ষেত্র। দৈনিক পত্রিকায় সাহিত্যকে তিনি মানে ও মর্যাদায় স্বতন্ত্র করেছেন। তার গদ্য স্বাদু-অনায়াস দক্ষতায় তিনি রাজনীতির বক্র বিষয়াদির সঙ্গে সমকালীন বাস্তবতা ও ধ্রুপদী সাহিত্যের মেলবন্ধন ঘটিয়ে দেন। তিনি দক্ষ ছড়াকার; ষাটের দশকে অসংখ্য ছড়া লিখেছেন। সত্তরের দশকেও ছড়ায় সচল রেখেছিলেন নিজের কলম। ‘রঙিন বেলুন’ নামে শিশু একাডেমি থেকে প্রকাশিত ছড়ার বইটি তার ছড়া সৃষ্টির উজ্জ্বল নিদর্শন। বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ও সঙ্গীত জগতে একসময় তিনি ছিলেন ঘনিষ্ঠ। তার লেখা বেশ কয়েকটি গান আজও শ্রোতাহৃদয়ে শিহরণ জাগায়। তার রচিত গ্রন্থের মধ্যে ‘সম্পাদকের জবানবন্দি’, ‘অমিয় গরল’, ‘আমার যত কথা’, ‘স্বপ্ন বেঁচে থাক’ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। সাংবাদিকতায় জীবনব্যাপী অনন্য ভূমিকার জন্য তিনি ২০১৪ সালে একুশে পদকে ভূষিত হন।