কক্সবাংলা ডটকম(২১ সেপ্টম্বর) :: বাংলাদেশে এখন একটা খুবই অস্বাভাবিক পরিস্থিতি দেখা যাচ্ছে, যেখানে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ দলের নেতাদের বিভিন্ন অর্থনৈতিক অপরাধের দায়ে দল থেকে বহিষ্কার ও গ্রেফতার করা হচ্ছে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জেইউ) একটি দুর্নীতির কেলেঙ্কারি নিয়ে এটার শুরু যেটার সাথে ছাত্রলীগের (সিএল) দুই ছাত্রনেতা শোভন আর রাব্বানি জড়িত ছিল। পরে সেটার পরিসর আরও বেড়েছে এবং ঢাকা শহরের বহু অবৈধ ক্যাসিনোর বিরুদ্ধে অভিযান চালানো হয়েছে। এগুলোর অনেকগুলোর মালিক ক্ষমতাসীন দলের যুবলীগ নেতারা যাদের অনেকে এখন গ্রেফতার হয়েছেন।
ছাত্রলীগের দুই নেতাকে পদ থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে, অন্যদিকে ক্ষমতাসীন দলের যুব শাখা যুবলীগের (জেএল) বেশ কিছু নেতাকে আটক করা হয়েছে। যদিও অধিকাংশ মানুষ এতে খুশি, তবে তারা এ প্রশ্নও তুলছেন যে কেন এখন এবং হঠাৎ করেই বা কেন এটা করা হচ্ছে?
ছাত্রলীগ আর যুবলীগ ক্ষমতাসীন দলের সড়কের শক্তির দুর্গবিশেষ এবং দলের প্রয়োজনে তাদের ব্যবহার করা হয়। এই দলগুলোর নেতারা বিশ্বস্ত অনুগত। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুই সপ্তাহ আগে দলের বৈঠকে তাদের অপরাধী কর্মকাণ্ড নিয়ে ক্ষোভ জানিয়েছেন।
এদিকে, যুবলীগের প্রধান ওমর ফারুক চৌধুরী মিডিয়াতে এই প্রশ্ন তুলেছেন যে, কেন এ ধরনের পদক্ষেপ এখন নেয়া হচ্ছে এবং কেন পুলিশ এতদিন ঘুমাচ্ছিল। তিনি এটাকে একটা ‘ষড়যন্ত্র’ হিসেবেও মন্তব্য করেন।
ছাত্রলীগের দুই নেতা অবশ্য দলের নেতার কাছে প্রকাশ্যে ক্ষমা চেয়েছেন যদিও তাদের বহিষ্কারাদেশ এখনও কার্যকর আছে।
বিশ্ববিদ্যালয় কেলেঙ্কারি
বিশ্ববিদ্যালয় কেলেঙ্কারিটি ব্যাপক আলোচনায় আসে, যখন প্রধানমন্ত্রীর কাছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক ফারজানা ইসলাম সরাসরি অভিযোগ করেন যে, বিশ্ববিদ্যালযের বড় একটি নির্মাণ প্রকল্পে বরাদ্দ থেকে ভাগ চেয়েছে ছাত্রলীগের নেতারা।
এই ধরনের প্রকল্প থেকে চাঁদা নেয়াটা এতটাই স্বাভাবিক হয়ে গেছে যে, কেউ এখন আর এটাকে দুর্নীতিই মনে করেন না। কিন্তু এখানে যেটা হয়েছে, সেটা হলো ভাইস চ্যান্সেলর আর ছাত্রলীগ নেতারা উভয়েই এখানে দলের অনুগত, যাদের মধ্যে সঙ্ঘাত লাগে।
অভিযোগ বাড়তে থাকলে, শোভন আর রাব্বানি দাবি করেন যে, ভাইস চ্যান্সেলর আর তার পরিবারের সদস্যরা দুর্নীতিতে জড়িত এবং তার ছেলে ও স্বামী প্রকল্পের বরাদ্দ থেকে ভাগ নিয়েছে। তারা আরও দাবি করেন যে, এই ভাগ চাওয়াটা তাদের ‘ন্যায্য অধিকার’ যেটা সবসময় চর্চা হয়ে আসছে।
এটা স্পষ্ট যে, যদিও সবাই একই দলের তাবুর নিচে আছেন, তবে দলের মধ্যে অন্তর্কোন্দলটা তীব্র হয়ে উঠেছে এবং এটা কোন আদর্শ নিয়ে নয়, বরং অর্থ নিয়ে।
তাদের বিরুদ্ধে অপরাধের অভিযোগ আনা হোক বা না হোক, পারস্পরিক ক্ষতি এখানে অনেক। ভিসি’র সুনাম ধ্বংস হয়ে গেছে। শিক্ষকদের একটা অংশের পক্ষ থেকে পদত্যাগের জন্য চাপ দেয়া হচ্ছে তাকে। তিনি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে গিয়েছিলেন যারা আইন শৃঙ্খলার বিষয়টি দেখে, কিন্তু কেন গিয়েছিলেন, সেটি জানাননি।
ভিসি বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী তাকে পদ ছাড়তে না বলা পর্যন্ত তিনি কাজ চালিয়ে যাবেন। তবে ভিসিকে একইসাথে ক্ষমতাসীন দলের একটা অংশের বিরুদ্ধেও লড়তে হচ্ছে, যারা এটাকে একটা সুযোগ হিসেবে দেখছেন যে, তাকে সরানো গেলে নিজেদের পছন্দের ব্যক্তিকে ওই পদে বসানো যাবে। সবার ছুরি বেরিয়ে এসেছে। একটা শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতির মধ্যে আরও অস্থিরতা তৈরি হতে যাচ্ছে।
ক্যাসিনো যুব লীগ
ইতোমধ্যে, ১৮ সেপ্টেম্বর আরও নাটকীয় পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় যখন আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো অভিযান চালিয়ে বেশ কিছু অবৈধ ক্যাসিনো বন্ধ করে দেয়। এগুলোর মধ্যে অনেকগুলোর মালিক যুবলীগের নেতারা।আর ২০ সেপ্টেম্বর রাজধানীর নিকেতন এলাকায় যুবলীগ নেতা জি কে শামীমের অফিস থেকে ২০০ কোটি টাকা, ডলার, এফডিআরের কাগজ, অস্ত্র ও মদ উদ্ধার করে র্যাব। সিনিয়র যুবলীগ নেতাসহ বেশ কিছু ক্যাসিনো মালিককে গ্রেফতারও করা হয়েছে।
কেউই ভাবেনি যে, এই পর্যায়ের নেতাদের গায়ে হাত দেয়া হবে। প্রধানমন্ত্রী আগের সপ্তাহে যে ইঙ্গিত দিয়েছিলেন, যুবলীগ নেতারা টার্গেট হওয়ার কারণে সেটা স্পষ্ট হয়ে গেছে। আরেকজন যুবলীগের বড় নেতা খালিদ মাহমুদ ভুঁইয়াকেও গ্রেফতার করা হয়েছে, যিনি চাঁদাবাজির জন্য ‘টর্চার সেল’ খুলেছিলেন। ফলে দেখা যাচ্ছে, পুলিশ শুধু অর্থনৈতিক অপরাধের বিরুদ্ধেই লাগেনি।
রাজনীতিবিদ ও রাষ্ট্র
এই ধরনের বহু অবৈধ কর্মকাণ্ড বহুদিন ধরে চলে আসছে কিন্তু যে কারণেই হোক দীর্ঘদিন সেগুলো সহ্য করা হয়েছে। এখন আবার যে কারণেই হোক তাদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু হয়েছে। বহু রাজনৈতিক নেতাই অবৈধভাবে টাকা উপার্জন করছেন যারা জানেন যে, দলের ক্যাডাররা তাদেরকে নিরাপত্তা দেবে।
অভিযান, গ্রেফতার ও বহিষ্কারের মাধ্যমে সুবিধাভোগীরা নাড়া খেয়েছে। রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনা সিস্টেমের মধ্যে রাজনীতিবিদ ছাড়াও বিশেষ করে প্রশাসনের মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর অনেক মিত্র রয়েছে, যারা তার কাছে দুর্নীতির রিপোর্ট দিয়েছেন এবং প্রধানমন্ত্রী ষাঁড়াশি অভিযানের নির্দেশ দেয়ার আগে সেটা দলের নেতাদের সামনে পড়ে শুনিয়েছেন।
এই পদক্ষেপের কারণে জাতীয় রাজনীতির চেহারা উন্নত হয় কি না, সেটা এখনও দেখার বিষয়। তবে দলীয় সদস্যরা চরম অস্বস্তির মধ্যে আছেন, কারণ তারা জানেন না যে, কার উপর কুড়াল নেমে আসবে।
দলের ভেতরে কোন্দল নিঃসন্দেহে বাড়ছে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শুধু ক্ষমতাসীন দলের প্রতিনিধিত্ব করেন না, বরং রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা কাঠামোর অংশ যেমন ব্যবসায়ী সম্প্রদায়, সেনাবাহিনী ও আমলাদেরও প্রতিনিধিত্ব করেন তিনি। তাই এখানে তার একটা শক্তি রয়েছে যেটা রাজনীতিবিদদের কখনও থাকে না।
সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে চাপের বিষয়টি নিঃসন্দেহে কাজ করেছে। একটা শুদ্ধি অভিযানের প্রয়োজন অবশ্যই ছিল কিন্তু এখনও এটা ঠিক স্পষ্ট নয় যে, ঠিক কেন এখনই এটা করা হচ্ছে। এর আরেকটি অর্থ হলো রাষ্ট্রের ব্যবস্থাপনা সিস্টেমের মধ্যে রাজনীতিবিদদের প্রভাব সময়ের সাথে সাথে কমে গেছে। তারা এখন আগের চেয়ে অনেক নড়বড়ে অবস্থার মধ্যে আছেন। আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে আধা-সামরিক বাহিনী র্যাপিড অ্যাকশান ব্যাটালিয়ন (র্যাব) এখন অনেকটাই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। পুলিশ ও সামরিক বাহিনীর সদস্যদের মিলিয়ে এই বাহিনী গড়ে তোলা হয়েছে।
শুদ্ধি অভিযান অ-ছাত্র ও তরুণদের নাড়া দিয়েছে। বেশ কিছু মাঝারি পর্যায়ের আমলা ও পুলিশ সদস্যও তাদের অবৈধ কর্মকাণ্ডের জন্য শাস্তির মুখোমুখি হয়েছেন। সে কারণে যুবলীগ আর ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে গৃহীত এই পদক্ষেপ বিচ্ছিন্ন কিছু নয়।
তাই, বলা যায় যে, সাধারণভাবে একটা শুদ্ধি প্রক্রিয়া চলছে। রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনা সিস্টেম ও ক্ষমতা ভাগাভাগির মধ্যে ভারসাম্য রাখার বিষয় রয়েছে এখানে। নিঃসন্দেহে বহু স্তরের ভাবনা রয়েছে এই পদক্ষেপের পেছনে, যার উদ্দেশ্য এখনও ঠিক স্পষ্ট নয়।
Posted ৫:১১ অপরাহ্ণ | শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০১৯
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta