কক্সবাংলা ডটকম(২১ মার্চ) :: গোটা বিশ্বে মহামারির আকার নিয়েছে করোনা ভাইরাস। ক্রমশ ভয়ঙ্কর থেকে আরও ভয়ঙ্করতম হয়ে উঠছে পরিস্থিতি। মৃতের সংখ্যায় চিনকেও ছাপিয়ে গিয়েছে ইতালি। এখনও পর্যন্ত করোনা ভাইরাসের কোনও ভ্যাকসিন না থাকায় ক্ষতির পরিমাণও বাড়ছে। মারা যাচ্ছে হাজার হাজার মানুষ, আক্রান্ত হচ্ছে লাখ লাখ।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা করোনাভাইরাসকে অনেকগুলি ভাইরাসের একটি ‘ভয়ঙ্কর-গ্রুপ’ হিসেবে জানাচ্ছে। যা সাধারণ সর্দি ও তীব্র শ্বাস কষ্ট থেকে শুরু করে মানুষের মধ্যে বিভিন্ন রোগের জন্ম দেয়। প্রাণঘাতি ভাইরাসটি আক্রান্ত ব্যক্তিকে অতি দ্রুত মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়।
করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে এখনও পর্যন্ত বিশ্বে ১৩ হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। প্রাণঘাতী এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন ২ লক্ষ ৫০ হাজার। বিগত ১০০ বছরে বিশ্বে বহু মহামারী ও ভাইরাস আক্রমণ করেছিল। কিন্তু এতটা মারাত্মক হয়নি।
এদিকে নভেল করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের জেরে সারা বিশ্বের বড় বড় আয়োজন স্থগিত করা হয়েছে। খেলা, কনসার্ট, ধর্মীয় জমায়েতসহ সব ধরনের জনসমাগম নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কিন্তু এরপরও বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশে এসব পরামর্শ ও নিষেধাজ্ঞা যথাযথভাবে মানা হচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে অব্যাহতভাবে মৃত্যু বেড়ে যাওয়ায় লকডাউন কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করতে গত শুক্রবার থেকে সেনাবাহিনী মোতায়েনে বাধ্য হয়েছে ইতালি সরকার।
এ ধরনের মহামারীর কালে প্রশাসন বা সাধারণ মানুষের উদাসীনতা বড় বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। এর জাজ্জ্বল্যমান উদাহরণ ১৯১৮ সালের স্প্যানিশ ফ্লু মহামারী। ওই বছরের সেপ্টেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের ফিলাডেলফিয়া শহর কর্তৃপক্ষ লিবার্টি লোন প্যারেডের আয়োজন করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের তহবিল সংগ্রহে সরকারি বন্ড বিক্রির প্রচারণার অংশ হিসেবে এ প্যারেডের আয়োজন করা হয়।
অথচ ওই সময় এইচওএন১ ভাইরাসের ব্যাপক সংক্রমণে সৃষ্ট ঐতিহাসিক স্প্যানিশ ফ্লু ততোদিনে শহরে চলে এসেছে। ১৭ লাখ জনসংখ্যার শহরটি তখন ভয়ঙ্কর মহামারি ঝুঁকিতে। এ ভাইরাস ১৯১৮ থেকে ১৯১৯ পর্যন্ত ব্যাপক প্রাণহানি ঘটায়। তৎকালীন বিশ্বের মোট জনসংখ্যার এক তৃতীয়াংশ অর্থাৎ প্রায় ৫০ কোটি মানুষ এ ফ্লুতে আক্রান্ত হয়। যুক্তরাষ্ট্রের রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্রের (সিডিসি) হিসাবে, স্প্যানিশ ফ্লুতে মারা যায় ৫ কোটি মানুষ। এক বছরেও কেউ এ রোগের ভ্যাকসিন তৈরি করতে পারেনি।
ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভানিয়া আর্কাইভস আন্ড রেকর্ড সেন্টারের তথ্য অনুযায়ী, ওই সময় স্পেনের ৮০ শতাংশ মানুষ এইচ১এন১ ভাইরাসে সংক্রমিত হয়। এটি ইউরোপ এবং এশিয়াতেও ছড়িয়ে পড়ে।
সিডিসির তথ্য মতে, স্প্যানিশ ফ্লু ১৯১৮সালের বসন্তের আগে মার্কিন সেনাবাহিনীর সদস্যদের মধ্যে সংক্রমিত হয়নি। মার্কিন সেনারা যখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ থেকে বাড়ি ফিরতে শুরু করে তখন বোস্টনের মতো আরো কয়েকটি শহরে এ ফ্লুর বিস্তার শুরু হয়। ফিলাডেলফিয়াতে ভাইরাসটির বিস্তার ঘটে সেপ্টেম্বরের ১৯ তারিখে। মূলত ফিলাডেলফিয়ার নেভি ইয়ার্ডের মাধ্যমে। মাত্র কয়েকদিনের মধ্যে ৬০০ নৌসেনা এ ভাইরাসে আক্রান্ত হন।
কিন্তু এরপরও ফিলাডেলফিয়া কর্তৃপক্ষ লিবার্টি লোন প্যারেড বাতিল করেনি। প্রথম আক্রান্ত শনাক্তের এক সপ্তাহ বা কিছু সময় পরই এটি আয়োজন করা হয়। যুদ্ধকালে জাতীয় ঐক্যের ভিত্তি হিসেবে দেশপ্রেমকে মোক্ষম অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এটি ইতিহাসে সব সময় হয়ে এসেছে। ফিলাডেলফিয়া কর্তৃপক্ষও সেটিই করতে চেয়েছে এবং তারা ২৮ সেপ্টেম্বর আয়োজিত প্যারেডে ২ লাখ মানুষ জড়ো করে।
এর ফলাফল হয় মারাত্মক। ১ অক্টোবর ফিলাডেলফিয়াতে নতুন করে ৬৩৫ জন স্প্যানিশ ফ্লুতে আক্রান্ত হয়। ওই সময় যুক্তরাষ্ট্রে আক্রান্ত শহরগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল ফিলাডেলফিয়া। মাত্র ছয় সপ্তাহের ব্যবধানে এখানে ১২ হাজারের বেশি মানুষ মারা যায়। আক্রান্ত হয় প্রায় ৪৭ হাজার মানুষ। ছয় মাসের মধ্যে মহামারিতে মারা যায় প্রায় ১৬ হাজার এবং আক্রান্ত হয় ৫ লাখের বেশি মানুষ।
অবশ্য ফিলাডেলফিয়াতে স্প্যানিশ ফ্লুর ব্যাপক বিস্তারের জন্য শুধু সেই প্যারেডকেই দায়ী করা যায় না। জনসংখ্যা এবং দরিদ্র শ্রমিক শ্রেণির জীবনযাপনের নিম্নমানসহ আরো কয়েকটি কারণ এখানে উল্লেখ করা যায়।
যুক্তরাষ্ট্রের সিডিসির বৈশ্বিক অভিবাসন ও সঙ্গনিরোধ বিভাগ বলছে, মহামারীর কালে কী করা উচিত নয় সে সম্পর্কে ফিলাডেলফিয়ার ওই ঘটনা একটি শিক্ষা হয়ে থাকতে পারে। ওই সময় কিন্তু সেইন্ট লুইস একই ধরনের প্যারেড স্থগিত করেছিল। ফলত এ শহরে মৃতের সংখ্যা ৭০০ ছাড়ায়নি।
সিডিসি বলছে, বৈশ্বিক মহামারীর সময় জনসমাবেশ বন্ধ করা এবং সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার মতো ব্যবস্থা ও নিয়ম মেনে চললে কতোটা উপকার হতে পারে তার বাস্তব উদাহরণ এই ফিলাডেলফিয়া এবং সেইন্ট লুইস।
এক নজরে সেই ভয়ঙ্কর ভাইরাসগুলি-
গুটি (১৯০০)- গুটি বিগত শতাব্দীতে বিভিন্ন সময় প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছিল। এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রায় ৫৬ মিলিয়ন মানুষের প্রাণহানি ঘটিয়েছিল। প্রধানত উত্তর আমেরিকায় এটির প্রার্দুভাব ঘটেছিল। আক্রান্তদের মধ্যে মৃত্যুর হার ৩০ শতাংশ পর্যন্ত ছিল।
স্প্যানিশ ফ্লু (১৯১৮- ১৯১৯)- এটি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর প্রধানত ইউরোপের শহরগুলিতে ছড়িয়ে পড়ে। যদিও পরে গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। যেখানে আধুনিক পরিসংখ্যান অনুসারে প্রায় ৫০০ মিলিয়ন লোক সংক্রামিত হয়েছে এবং ৫০ মিলিয়ন থেকে ১০০ মিলিয়ন মানুষ এই রোগে মারা যায়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যারা মারা গিয়েছিল তাদের দ্বিগুণের সমতুল্য।
এশিয়ান ফ্লু (১৯৫৬)- এই ধরণের ইনফ্লুয়েঞ্জা ১৯৫৬ সালে প্রথমে চিনে ছড়িয়ে পড়ে। এরপর ১৯৫৭ সালে সিঙ্গাপুরে পাড়ি জমায়। সারা বিশ্বের প্রায় এক মিলিয়নেরও বেশি লোকের মৃত্যু হয় রোগটিতে।
এইডস (১৯৮১)- প্রথম ১৯৮১ সালে আবিষ্কার করা হয়েছিল এই রোগটি। তখন থেকে রোগটি বিশ্বব্যাপী ২৫ মিলিয়ন থেকে ৩৫ মিলিয়ন লোকের জীবন নাশ করেছিল। এর মধ্যে ২০১৭ সালেই মারা গিয়েছে ১ লক্ষ ৪০ হাজার লোক। ২০০৪ সালে, বিশ্বব্যাপী প্রায় ৩৬.৯ মিলিয়ন মানুষ এইচআইভিতে আক্রান্ত হয়েছিল।
সোয়াইন ফ্লু (২০০৯)- ভাইরাসটি শূকর থেকে মানবদেহে সংক্রামিত হয়। এরপর সেটি ধীরে ধীরে কৃষক এবং পশু চিকিৎসকের মাধ্যমে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। ২০০৯ সালে একটি গবেষণায় দেখা যায়,শূকরের সঙ্গে না মিশলেও এটি মানুষের শরীরে প্রবেশ করতে পারে।
২০০৯ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও মেক্সিকোয় এই মহামারী দেখা দিয়েছে। সেখান থেকে এটি বিশ্বের সমস্ত দেশে ছড়িয়ে পড়ে। ১৮,৫০০ জনের প্রাণহানি ঘটায়। এতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২০১০ সালে জরুরি অবস্থা জারি করতেও বাধ্য হয়।
ইবোলা (২০১৪)- ২০১৪ সালে পশ্চিম আফ্রিকাতে ভাইরাসটি দেখা দিয়েছিল। এবং তারপরে আফ্রিকার বেশ কয়েকটি প্রতিবেশী দেশ এবং বিশ্বের কয়েকটি দেশে ছড়িয়ে পড়ে। ২০১৪ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে ১১ হাজারেরও বেশি মানুষ মারা গিয়েছিল।
Posted ২:৫০ পূর্বাহ্ণ | রবিবার, ২২ মার্চ ২০২০
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta