শিব শংকর মোদক(১২ নভেম্বর) :: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের (টিএসসি) মিলনায়তনে অভ্যাগতদের সামনে নিজের শিক্ষাজীবনের বর্ণনা তুলে ধরছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান প্রথম বর্ষের ছাত্র মশিউর রহমান। ঝালকাঠির একটি প্রান্তিক পরিবার থেকে উঠে আসা মশিউরের বাবা-মা দু’জনই নিরক্ষর। বাবা টেম্পোচালক। স্কুল-কলেজে সন্তানকে পড়ানো
সম্ভব নয় বলে বাবা ছেলেকে মাদ্রাসায় পাঠান। সেখানে দাখিল পরীক্ষায় মশিউর জিপিএ ৫ পেলে তিনি তাকে বরিশাল অমৃতলাল দে কলেজে ভর্তি করেন। বরিশালে রেখে সন্তানের লেখাপড়ার খরচ জোগাতে বাবা একবেলা না খেয়ে অর্থ জমাতেন।
এ কথা জানতে পেরে মশিউরও দুপুর-রাত মিলিয়ে একবেলা খাবার খেতে শুরু করেন। এইচএসসিতেও তিনি জিপিএ ৫ পান। বরিশালের একটি কোচিং সেন্টারের মালিক তাকে ফ্রি বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি কোচিং করান। মশিউর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজবিজ্ঞান বিভাগে স্থান করে নেন। এলাকাবাসীর সহায়তা নিয়ে ভর্তি হন বিশ্ববিদ্যালয়ে।
মশিউর রহমান বলেন, তার গ্রামে গত ২৫ বছরের মধ্যে তিনিই প্রথম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ পেয়েছেন।
মশিউর শনিবার বিকেলে টিএসসি মিলনায়তনে এসেছিলেন ঢাকা ইউনিভার্সিটি অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের বৃত্তি নিতে। আবেগাপ্লুত কণ্ঠে মশিউর বলেন, ‘আজ যেমন বৃত্তি নিতে এসেছি, সকলের কাছে দোয়া চাই, আমিও যেন এমনি করেই একদিন এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বৃত্তি দিতে পারি।’ অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন শনিবার ৫২৫ দরিদ্র মেধাবী শিক্ষার্থীকে বৃত্তি দিয়েছে।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী। বৃত্তির জন্য নির্বাচিতরা প্রতি মাসে দুই হাজার ৫০০ টাকা করে চার বছর এ অর্থ পাবেন।
অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও ঢাকা ইউনিভার্সিটি অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের প্রধান পৃষ্ঠপোষক অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর এস কে সুর চৌধুরী।
সভাপতিত্ব করেন সংগঠনের সভাপতি এ. কে. আজাদ। অনুষ্ঠানে বৃত্তিপ্রাপ্ত ৫২৫ ছাত্রছাত্রীর মধ্যে তিন শিক্ষার্থী তাদের অনুভূতি ব্যক্ত করেন।
সংস্কৃতি বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী উম্মে তাসকিয়া জানান, কুষ্টিয়ায় পদ্মাপাড়ের এক নিভৃত পল্লীতে তার জন্ম। জন্মের আগেই বাবা হারিয়েছেন। পাঁচ ভাইবোনের সংসারে তার মা অন্যের বাড়িতে কাজ করে তাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছেন।
তিনি জানান, এ বৃত্তি না পেলে হয়তো শিক্ষাজীবন থেকে ঝরে যেতেন। তিনি কৃতজ্ঞতা জানালেন অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের প্রতি। রাজশাহীর পুঠিয়ার ছেলে রবিউল ইসলামের গল্প আরও ভিন্ন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস প্রথম বর্ষের এই ছাত্র জানালেন, তার বাবা দিনমজুর। অতিদরিদ্র পরিবারে চার ভাইবোন। তিনি অষ্টম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় বাবা স্ট্রোক করেন। দশম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় বাবা দ্বিতীয়বার স্ট্রোক করে পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়েন। বাধ্য হয়ে কিশোর রবিউলকে সংসার চালাতে দিনমজুরি করতে হয়। ইটভাটার শ্রমিক ও মিষ্টির দোকানের কর্মচারী হিসেবেও
তিনি কাজ করেন। অতিকষ্টে পড়ালেখা চালিয়ে এসএসসি পাস করেন। মায়ের একমাত্র ছাগলটি বিক্রি করে কলেজে ভর্তি হয়ে মাত্র ছয় মাস পড়ালেখা করে কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হন। এর পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ পান।
শিক্ষার্থীদের এসব বক্তব্য সবার হৃদয়ে ছুঁয়ে যায়। অনুষ্ঠানের বিশেষ অতিথি উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো, আখতারুজ্জামান বলেন, ‘তোমরা মন খারাপ করো না। তোমাদের উপাচার্যও এ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী থেকে উঠে আসা একজন ছাত্র।’
স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী বলেন, অ্যালামনাইয়ের বর্তমান কমিটি মাত্র দেড় বছরে বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থীকে বৃত্তি দিতে পেরেছে। এটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ।
স্পিকার বলেন, জ্ঞাননির্ভর সমাজ গড়তে শিক্ষায়ই হবে অনন্য বিনিয়োগ। আজকের বিশ্বায়নের পৃথিবীতে জ্ঞাননির্ভর সমাজ ব্যবস্থার কোনো বিকল্প নেই। সেইসঙ্গে তথ্যপ্রযুক্তি আয়ত্ত করে অত্যাধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হবে। সঙ্গে প্রয়োজন প্রশিক্ষণের মাধ্যমে নিজেকে যোগ্য করে গড়ে তোলা। তিনি শিল্পপতিদের প্রতি ঢাবির শিক্ষার্থীদের ইন্টার্নশিপ প্রদানের মাধ্যমে প্রশিক্ষিত করে তুলতে আহ্বান জানান।
ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী বলেন, এ দেশের তরুণদের মেধা ও যোগ্যতার কোনো ঘাটতি নেই। সুযোগ করে দিলে তারা সারাবিশ্বে মেধার অনন্য স্বাক্ষর রাখতে পারে।
উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান বলেন, অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের বৃত্তি কার্যক্রমের নেপথ্যে একটি চেতনা, একটি দর্শন আছে। তারা চান, আজকের বৃত্তিপ্রাপ্ত ছাত্রছাত্রীরা যেন আগামী দিনে দাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এটিই সৌন্দর্য, দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সন্তানরা এখানে পড়তে আসেন। বৃত্তি কার্যক্রমের জন্য ঢাকা ইউনিভার্সিটি অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনকে ধন্যবাদ জানিয়ে তিনি বলেন, এ কার্যক্রমে বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্বসূরিদের সঙ্গে উত্তরসূরিদের অপূর্ব মেলবন্ধে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর এস কে সুর চৌধুরী বলেন, সামাজিক দায়বদ্ধতার অংশ হিসেবে বহু ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান এগিয়ে এসেছে। এটি শুভলক্ষণ। এই কার্যক্রমকে আরও বেগবান করতে হবে।
অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এ. কে. আজাদ বলেন, বিশ্বের বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো চলে অ্যালামনাইদের টাকায়। গত বছর সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে একটি ছাত্র শীতের সময়ে বারান্দায় বসবাসের কারণে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান। তার পরিবারকে আর্থিক সহায়তা দিতে গেলে তার ট্যাক্সিচালক বাবা সে অর্থ গ্রহণ করে তা বিশ্ববিদ্যালয়কেই দিয়ে দেন, যেন আবাসন সংকটে তা কাজে লাগে। টিএসসি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মেডিকেল সেন্টারের উন্নয়নেও অ্যাসোসিয়েশন কিছু পদক্ষেপ হাতে নিয়েছে।
তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীসহ মন্ত্রিসভার বহু সদস্য এ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের পিছিয়ে থাকার কথা নয়। নিজের বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের সংক্ষিপ্ত স্মৃতিচারণ করে তিনি শিক্ষার্থীদের পরামর্শ দেন, নিজেকে কখনও ছোট মনে করো না। তোমরাই একদিন দেশের প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি ও স্পিকারের দায়িত্ব নেবে।
অনুষ্ঠানে স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর হাতে ঢাকা ইউনিভার্সিটি অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের আজীবন সদস্য কার্ড (নম্বর ৯২৪২) তুলে দেওয়া হয়।
অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য দেন রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির চেয়ারম্যান হাফিজ আহমেদ মজুমদার, এসিআই লিমিটেডের চেয়ারম্যান আনিস উদ দৌলা, ইস্টার্ন ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও আলী রেজা ইফতেখার, অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব রঞ্জন কর্মকার, সাংস্কৃতিক সম্পাদক মাহফুজা রহমান চৌধুরী বাবলী, অর্থ উপকমিটির আহ্বায়ক আনোয়ার উল আলম চৌধুরী পারভেজ, পূবালী ব্যাংকের পরিচালক রানা লায়লা হাফিজ, সিনহা পিপলস এনার্জি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আরিফুর রহমান সিনহা। উপস্থিত ছিলেন সফটটেক্স সোয়েটার ইন্ডাস্ট্রি প্রাইভেট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রেজওয়ান সেলিম এবং জমির উদ্দিন খান ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক আবুল বাশার খান।
স্বাগত বক্তব্য দেন অ্যাসোসিয়েশনের সিনিয়র সহসভাপতি মোল্লা মোহাম্মদ আবু কাওছার এবং ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন বৃত্তি উপকমিটির আহ্বায়ক আবদুস সালাম।
Posted ৫:৫৭ অপরাহ্ণ | রবিবার, ১২ নভেম্বর ২০১৭
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta